শারমিন শামস্: আমি কনসিভ করার পর আমার বসকে গিয়ে বললাম, ‘…’ ভাই আমি কনসিভ করেছি। এটি নিঃসন্দেহে একটা সুসংবাদ। কিন্তু সেটা শুনে আমার সেই বসের যে চেহারা হয়েছিল, আমার স্মৃতিতে এটাই এখন পর্যন্ত আমার দেখা কোন মানুষের সবচেয়ে কুৎসিত চেহারা। লোকটা চোখমুখ কুঁচকে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো এবং একটু পর মাথা নামিয়ে গুম হয়ে বসে রইলো।
এর কারণ কি? কারণ হলো, সেই সময় অফিসে আরো তিন/চারজন মেয়ে প্রেগনেন্ট, ফলে তারা শিগগিরই মাতৃত্বকালীন ছুটিতে যাবে। তো এর মধ্যে আমার মাতৃত্বের খবর বসের ঘুম হারাম করেছে। কিন্তু সে যদি আসলেই রক্ত মাংসের মানুষ হইতো, তবে অবশ্যই এই সংবাদ তার মুখে হাসি ফোটাতে পারতো, অন্তত ভান করে হলেও সেই মুহূর্তে আমার সামনে তিনি হাসতেন। লোকটা সেসবের ধার ধারেনি। আমি এমনিতেই সেনটিমেন্টাল। তার উপরে গর্ভকালীন সময়ের নানা হারমোনাল কারনে আমার মন আরো সংবেদনশীল হয়েছিল।

আমি প্রায় কষ্টে ফেটে পড়ে তাকে বললাম, ‘এই সংবাদে আপনার অফিস নিয়ে নানা টেনশন হয়তো হতে পারে। কিন্তু তার মানে এই না এরকম একটা সংবাদ দেবার পর আপনি হবু মায়ের সামনে এরকম চেহারা বানিয়ে রাখবেন। অন্তত এই মুহুর্তে তাকে আপনার অভিনন্দন জানানোর কথা। দোআ আশীর্বাদ করার কথা।’
মাথামোটা লোকটার এই কথায় কোন ভাবান্তর হয়নি বলাই বাহুল্য। আমি তীব্র মন খারাপ নিয়ে অফিসের বাথরুমে ঢুকে কেঁদেছিলাম।
তারপর যা হইলো তা ইতিহাস। গর্ভবতী কোন মেয়েকে এভাবে অপমান আর মানসিক শারীরিক কষ্ট দেয়া যেতে পারে, সেই অফিসে কাজ না করলে স্বয়ং বিধাতাও যদি এসে আমারে এসব বলত, আমি তা বিশ্বাস করতাম না। যাই হউক, এইসব আমার এবং অন্য গর্ভবতী মেয়েদের উপর দিয়ে গেল। তবে দু’একজন বাদে। কারন তারা বসের ‘প্রিয়পাত্রী’ ছিল।
যাই হোক, মনে আছে, তীব্র মনোকষ্টের মুহূর্তে আমি বারবার অফিসের বাথরুমে ঢুকে কাঁদতাম আর ভাবতাম, এই লোকগুলির প্রত্যেকেরই একটা বা দুটা করে কন্যা সন্তান আছে। একদিন তারাও চাকরি বাকরি করবে। বিয়ে করবে। সন্তান ধারণ করবে। তখন তাদের মেয়েরা কোন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাবে? আমি তো শুনেছি, প্রত্যেকের কর্মফল ফিরে আসে। প্রকৃতির নিয়মেই আসে। তবে কি তাদের জীবনেও তাই হবে যা আমার সাথে তারা করছে?
আজ কন্যা শিশু দিবস গেল। দিবস টিবসে আমার কোন বিশ্বাস নাই। কিন্তু দিবস পালনের ঘটা দেখে সেইসব কন্যাসন্তানের পিতাদের কথা মনে পড়ে গেল, যারা নিজের কন্যাকে মাথায় তুলে রাখেন বটে কিন্তু অন্য কারো কন্যাকে যতধরনের হেনস্থা সম্ভব, করে যান।
অফিসে পথে ঘাটে দোকানে বাজারে পার্কে যে লোকেরা মেয়েদের হরহামেশা অপমান আর হয়রানি করে, তারাও কন্যা সন্তানের পিতা হয়। যে লোকটা বউকে তিনবেলা পিটায়, সেই বউয়ের গর্ভেও তার কন্যা সন্তান হয়। যে লোকটা ধর্ষণ করে, ভিড়ের ভিতরে মেয়েদের শরীরে হাত দেয়, সেও হয়তো বাড়িতে রেখে এসেছে নিজের মেয়েকে। যে শ্বশুর ছেলের বৌকে দুবেলা খোঁটা দেয় যৌতুকের জন্য, তারও এক বা একাধিক কন্যা সন্তান থাকতে পারে। আমি আমার ফেসবুকে এমন অনেক লোকের ছবি দেখি, যে নিজের কন্যা সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ছবি তুলেছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে একটা দানব, কারন সে অন্য কোন পিতার কন্যাকে নানাভাবে হয়রানি করেছে, কষ্ট দিয়েছে এবং দিয়েই চলেছে। এইসব লোক কোন মেয়েকে হয়রাণি বা অত্যাচার করার সময় মনে রাখেনা, তার কন্যাও একদিন এরকম কোন কুৎসিত মুহূর্তের মুখোমুখি হতে পারে।
তনুকে যারা ধর্ষণ করেছে, মিতুকে যারা হত্যা করেছে, আফসানাকে যারা খুন করেছে, রুমানা মঞ্জুরকে যারা অন্ধ করে দিয়েছে, তারা কোন না কোনভাবে নারীর সাথে সম্পর্কযুক্ত। তারাও কোন এক নারীর নাড়ি ছিঁড়ে দুনিয়ায় এসেছে, দুধ পান করেছে, কোন নারীকে হয়তো ভালোও বেসেছে, হয়তো কেউ কন্যার পিতাও হয়েছে। কিন্তু তীব্র জিঘাংসা নিয়ে অন্য কোন নারীর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ার সময় তাদের নিজের আপন সেইসব নারীদের কথা মনে আসেনি। কেন আসেনি? তবে কি নিজের মা বা কন্যাকেও তারা একটা তুচ্ছ নারী, একটা নিম্নশ্রেণির প্রাণি ছাড়া আর কিছুই ভাবেনি, যে নারীর ব্যাথা নেই, বেদনা নেই, কষ্ট নেই, অপমানবোধ নেই, এমনকি মৃত্যুযন্ত্রণাও নেই!
আমি মেয়েদের কষ্টের কথা লিখেছিলাম। মেয়েদের নানাভাবে যৌনহয়রাণি করা হয়, সেই কথা লিখেছিলাম। আমার অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলাম। পরিচিত একটি সুবিধাবাদী লোক সেখানে এসে বড় মুখ করে কথা বলতে শুরু করে। তার বক্তব্যের সারকথা হল, আমি যা বলছি তা ভুল। এই সমাজে, এই দেশে, বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমি যৌনহয়রাণির যে কথা বলছি, তার পুরোপুরি সত্য নয়। আমি লোকটির সাথে কথা বলেই বুঝলাম, সে উদ্দেশ্যমূলকভাবেই বিষয়টির বিরোধিতা করছে। তাতে তার কী স্বার্থ হাসিল হচ্ছে তা আমার জানা নাই। যাই হোক, ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমি তাকে বললাম, ‘আপনি খুব নিষ্পাপ চিন্তা করছেন বটে, তবে মনে রাখবেন আপনার ঘরেও একটা কন্যা সন্তান আছে। আপনার এই নিষ্পাপ চিন্তার জন্য কখনো তার যেন আবার কোন ক্ষতি না হয়ে যায়, সেটা খেয়াল রাখবেন।’
আমার এই কথার পর লোকটি চুপ শুধু নয়, বলা যায় স্তব্ধ হয়ে গেল। কেন গেল? নিজের মেয়ের কথা ভেবে? তাহলে এই যে সমাজে এত এত মেয়ে, যাদের কষ্টের কথা যখন বলা হচ্ছিল, নিজের আখেরের স্বার্থে তখন তিনি সেসব অস্বীকার করছিলেন কেন? তবে তিনি আসলে কোন শ্রেণির পুরুষ? কেমন ধরণের মানুষ? তিনি কি আসলেই মানুষ?
দানবদের কথা বলবো বলে লেখার শুরু। সেইসব দানব যারা কন্যাসন্তানের পিতা, কিন্তু তবু নারীকে মানুষ বলে ভাবতে শেখেনি, নারীর ওপর নির্যাতন চালাবার সময় নিজের কন্যাসন্তানের কথাও মনে রাখেনি। আবার কেউ কেউ নারীর ওপর নির্যাতন, সহিসংসতাকে অস্বীকার করে যায়, কারন তাতে তাদের সুবিধা হয়। কিন্তু যখন নিজের ঘরে কন্যা সন্তান আসে, তখন তারা কী করে? তারা কি কখনো নিজের সন্তানকে নির্যাতিত সেই মেয়েটার জায়গায় বসিয়ে ভাবে, কতটা কষ্ট আর যন্ত্রণার ভেতর দিয়ে যায় এক একটা মেয়ে!
আমি জানি না। দানব কখনো পিতা হয় কিনা। দানব কখনো কন্যা সন্তানের বাবা হয় কি না। আমি জানি না, দানবদের জন্য প্রকৃতি তার উপযুক্ত জবাবের ডালা সাজিয়ে বসে আছে কি না। তবে আমার খুব জানার ইচ্ছা।