পুরুষতন্ত্রের নতুন অস্ত্র- নৈর্ব্যক্তিকতা!

শারমিন শামস্: একজন সুহৃদের লেখা নিয়ে ক্ষ্যাপেছেন আমার বন্ধুরা। বন্ধু মানে যারা লেখালেখি করি, ভাবনা শেয়ার করি, আড্ডা দেই। আমার জীবনের অসংখ্য বন্ধু সার্কেলের মধ্যে এটি অন্যতম।

লেখাটি ক্ষ্যাপার মতোই। রাগ করার মতোই। কিন্তু এই রাগকে যদি লড়াইয়ের মাঠে ছুটে আসা ধনুক হিসেবে দেখি তবে পাল্টা ধনুক ছোঁড়াই যথোপযুক্ত। কারণ যে ধনুক তিনি ছুঁড়েছেন, তা খাদে ভরপুর। তাই আমি বিশ্বাস করি, আমার ছোঁড়া পাল্টা ধনুক তাকে নতুন করে ভাবতে সাহায্য করবে।

moonmoon-4
শারমিন শামস্

একজন মানুষ সবসময় শতকরা শতভাগ সঠিক চিন্তা করতে পারবেন এটা যেমন সত্য নয়, তেমনি নদীর ওইপাড়ে বসে এপারের জ্বালা যন্ত্রণা অনুভব করার মত সংবেদনশীলও সবাই নয়। বাস্তবতা হলো, সকলেই নিজ জীবনের অভিজ্ঞতা আর জীবনযন্ত্রণা থেকেই জ্ঞানপ্রাপ্ত হয়। ফলে আজকের নারীদের যে সাহসী উচ্চারণ, প্রতিবাদের ভাষা, যে সত্যপ্রকাশ, তা তাদের জীবন দিয়ে অর্জিত অভিজ্ঞতার ফসল, যা এই সমাজে অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই ঘুরে ফিরে ঘটে। ফলে আমার এক বন্ধু যখন অফিসে নিজের যৌনহয়রাণির কথা বলে, আমি তখন সহজেই তা রিলেট করতে পারি নিজের সাথে, কারণ আমিও তার শিকার হয়েছি। আরেকজন যখন বলে সে স্বামীর হাতে মার খায়, অন্য আরেক নারী অন্তর দিয়ে অনুভব করতে পারে তার আঘাতটা, অপমানটা।

এখন কোন পুরুষের পক্ষে সম্ভব নয় এইসব অনুভবের মধ্য দিয়ে যাওয়ার। ভিড়ের ভিতরে কোন লোক স্তনে চাপ দিয়ে চলে গেলে কেমন গা ঘিনঘিনে অনুভূতি হয়, তা যাদের স্তন নেই তা তারা বুঝবেন কীভাবে? নারীর পুরো শরীরটাই তো একটি মাংসপিন্ড, সেই মাংসপিন্ডকে পুরুষ নেড়েচেড়ে দেখতে চায় বিনোদনের জন্য। এখন যেকোন পুরুষের শরীরের প্রতিই নারীর সেই টান নেই। হয়তো নারী প্রাকৃতিকভাবেই সভ্য বলে এটা ঘটে। যে কারণেই ঘটুক, যেহেতু নারী পুরুষের শরীর ঘাটতে ভিড়ের ভিতরে হাত বাড়ায় না, শরীর পেতে বেশিরভাগ নারীই পুরুষের মত পাগলপারা হয় না, তাই শরীরের জন্য কোন নারী একটু আগ্রহ দেখালেই অধিকাংশ পুরুষ বর্তে যায়। নারীর সেই আমন্ত্রণ এড়ানো অধিকাংশ পুরুষের ক্ষেত্রে প্রায় অসম্ভব। এখন পুরুষের এই পাগলপারা ভাবটিকেই নারীর প্রতি ‘বিগলিত’ হওয়া বোঝানো যেতে পারে।

আমাদের সুহৃদ বন্ধুটি লিখেছেন, এই বিগলিত ভাবই দক্ষিন এশীয় পুরুষদের সমালোচিত হবার মূল কারণ। এটি কাটিয়ে উঠতে পারলেই নাকি পুরুষ নারীর প্রতি নির্ভরতা কমিয়ে আনতে পারবে, নারীর প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টাবে। তার কথায় যুক্তি আছে, কিন্তু তা এক মন চালে দুটো দানার মত। হয়তো তিনি প্রেম, বিবাহ, যৌনহয়রানির বাইরে ভাবেননি, এবং এই তিনটি ক্ষেত্রেও খুব সীমিত গণ্ডিতে ভেবেছেন। ফলে, এই একটিমাত্র আদুরে কারণ চিহ্নিত করেই তিনি ভেবে বসেছেন, সব রোগ ডায়াগনসিস শেষ, এখন চিকিৎসা হলো পুরুষকে অতি নারীপ্রেম থেকে দূরে রাখা। আমি বলতে বাধ্য হচ্ছে, তার যুক্তি, তার বিশ্লেষণ খুবই অপরিনত এবং যথেষ্ট পরিমান গবেষণা ছাড়াই হুট করে এটা লিখে ফেলা হয়েছে বলেই আমি মনে করি। যদি তা না হত, তবে নারী নির্যাতন ও নারীর বিরুদ্ধে অসমতার পিছনে এ ধরনের বালখিল্য টাইপ বিশ্লেষণ তিনি প্রকাশ করতেন না।    

নারীর যন্ত্রণা আর নির্যাতিত হবার ইতিহাস অনেক পুরোনো, তবু আদিকাল থেকে যেভাবে নারীকে নিগৃহিত করা হয়েছে, এই আধুনিক যুগেও তার কোন রকমফের ঘটেনি। বরং আধুনিক জীবনে নতুন নতুন নির্যাতনের পদ্ধতি সৃষ্টি হয়েছে। আমি যদি সকাল থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়া অবধি আমার ওপর পিতৃতন্ত্রের প্রাত্যাহিক নির্যাতন আর অন্যায়ের কথা লিখতে বসি, যদি আমি আমার একার জীবনেই ঘটে যাওয়া নানা অভিজ্ঞতার কথা বলি, তবেই তো একখানা ঢাউস লেখা লিখে ফেলতে পারি। কিন্তু আমি তো লেখাপড়া করা, রোজগার করা, বাবা মা পরিবারের সমর্থণ পাওয়া, শহরে বাস করা একজন নারী। কিন্তু বিষয়টা তো শুধু আমাকে নিয়ে নয়। এদেশের হাজার হাজার গ্রাম, মফস্বল আর শহরাঞ্চলের কোটি কোটি নারীর জীবন আর যন্ত্রণার কথা বাদ দিয়ে কি নারীর কথা বলা সম্ভব, নাকি সেটা উচিত? সেটা কি সঠিক? সেটা কি যথেষ্ট?

আমার সুহৃদ বন্ধুটি নারীর প্রতি পুরুষের অতি আগ্রহ কমাতে ছেলে শিশুদের লেখাপড়ার পাশাপাশি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত করে ফেলার পরামর্শ দিয়েছেন। সৃজনশীল কর্মকাণ্ড মানুষকে মানবিকগুনসম্পন্ন মানুষ হিসেবে গড়ে তোলে, এটি সত্য। কিন্তু যে সমাজ নারীকে মানুষ হিসেবেই নিরূপন করতে শেখেনি, যে সমাজের মনের গভীরে চেতন অবচেতনে পুরুষতন্ত্র গেঁড়ে বসে আছে, সেখানে মানবিক সাংস্কৃতিক সব গুন উপস্থিত থাকলেও, নারীর প্রতি সম্মান এবং লৈঙ্গিক সমতায় তার শতভাগ সমর্থণ থাকবে, এমনটা কখনোই বলা যা্য় না।  

যদি তাই হতো, তবে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের নারীকে নিয়ে সাহিত্য রত্ন হাসনাত আবদুল হাই অশ্লীল গল্প ফেঁদে বসতেন না, চলচ্চিত্র, নাটক, মডেলিং জগতে কাজ করতে আসা নারী পরিচালক, আর্ট ডিরেক্টরসহ অন্যান্য সৃষ্টিশীল(!) লোকের দ্বারা নিয়মিত নিগ্রহের শিকার হত না, মিডিয়া হাউসগুলোতে নারীকে প্রতিদিন হেনস্তা করার ঘটনা ঘটতো না।

পাড়ার কিশোরীকে যখন কোন পুরুষ উত্যক্ত করে, সেটির পেছনে পুরুষটির নারীর প্রতি অতি প্রেম বা আগ্রহের বিষয়টি কাজ করে বটে, তবে সেটি নিতান্তই তুচ্ছ ও গৌণ একটি কারণ। প্রেম বা আগ্রহ তাকে নিয়ে যায় নারীটিকে উত্যক্ত করার পর্যায়ে, কখনো কখনো সেটি বদরুলের মত কোপাকুপির মত পর্যায়ে চলে যায়। এর পেছনে নারীর প্রতি তার প্রেম নয়, কাজ করে নারীকে ব্যাক্তিগত সম্পত্তি ভাবার মানসিকতা, নারীকে পুরুষের চেয়ে নিচের স্তরের প্রাণি ভাবার শিক্ষা এবং নারীর নিজের মতামত ও সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা থাকতে পারে- এটি ভাবতে এবং মেনে নিতে না পারা। যে কিশোর আজ পাড়ার নারীকে উত্যক্ত করে, মননশীল বৃহত্তর সমাজে প্রবেশ করিয়ে দিলেই সে ব্যস্ত হয়ে পড়বে ঠিকই, কিন্তু তার ভিতরে গেঁড়ে বসা আদিম পুরুষতন্ত্র কি তাতে নির্মূল হবে? যদি নির্মূলই হত তবে সমাজের উচ্চ মহলে, বড় বড় সাংস্কৃতিক অঙ্গনে নারী নির্যাতন আর অসমতার চিত্র এত প্রকট হয়ে উঠতো না। উত্যক্তকারী কিশোর বড় হয়ে সুশীল পুরুষ হয়ে ওঠে বাইরের জগতে, কিন্তু অবচেতনের পুরুষতন্ত্র তাকে উৎসাহ যোগায় ঘরে ফিরে বউ পিটাতে আর বউকে নিয়ন্ত্রণ করতে।

পুরো লেখাটিকেই আমি একটি লেখা হিসেবে ধরে নিয়ে এড়িয়ে যেতে পারতাম। পারিনি নিচের এই একটি মাত্র প্যারার কারণে। তিনি লিখেছেন,

‘দক্ষিণ এশীয় পুরুষ সমাজ এখানকার নারী সমাজ কর্তৃক যে মানসিক নির্যাতনের স্বীকার হয়; তা অদৃশ্য; ফলে প্রতিদিন অসংখ্য পুরুষের মানসিক হত্যা চলে আদিম কূট-কৌশলে। বেশীরভাগ পুরুষই নারীদের মতো বাকপটু হয় না। ফলে হয় নীরবে সহ্য করে বা একদিন ধারাবাহিক মানসিক অত্যাচারে সহিংস হয়ে ওঠে। এই জায়গাটিতে পুরুষ সমাজকে খুবই সচেতন হতে হবে। কোনভাবেই কোন সহিংসতায় জড়াতে নেই। সহিংসতার কোনো ক্ষমা নেই। ক্ষমা নেই মানসিক হত্যারও। দক্ষিণ এশিয়া গ্রাম্য সমাজ বলে এখানে মানসিক নির্যাতনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার চল নেই’।

পুরুষ নারীকে যেমন মানসিক নির্যাতন করে, নারীও পুরুষকে মানসিক নির্যাতন করে। এই কথা সত্য। আর স্বামী স্ত্রী বা প্রেমিক প্রেমিকার বাগবিতন্ডা, ঝগড়া চলতে চলতে এ পর্যায়ে গায়ে হাত তোল কোন কোন পুরুষ। লেখক বুঝাতে চেয়েছেন, দীর্ঘদিনের মানসিক নির্যাতনে পুরুষ সহিংস হয়ে ওঠে। অবশ্য তিনি এই সহিংসতাকে নিরুৎসাহিত করেছেন, নিষেধ করেছেন। কিন্তু সেটি করার আগে সহিংসতার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন, নির্যাতনকারী পুরুষটির প্রতি সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এটি একটি বিস্ময়ের জায়গা আমার কাছে। আমি আমার সুহৃদ লেখক বন্ধুকে কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই।

যে পুরুষ প্রতিদিন নারীকে সকালে বিকেলে হাটে ময়দানে নোংরা কথা ছুঁড়ে দিয়ে চলেছে যুগের পর যুগ ধরে, সেটি কি মানসিক নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে? যে মেয়েটিকে বিয়ের পর আর পড়তে দেয়া হয় না, চাকরি করতে দেয়া হয় না সেটি কি মানসিক নির্যাতন? অফিসে নারী বলে যার বেতন কম হয়, প্রমোশন আটকে থাকে, সেটি কি মানসিক নির্যাতন? বিয়ের পর বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনতে বলা হয় যৌতুকের নামে, সেটি কি মানসিক নির্যাতন? কালো রং আর চেহারার জন্য বিয়ে হয় না, পাত্রপক্ষের সামনে গরুর মত সেজে বসতে হয়, সেটি কি মানসিক নির্যাতন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, অফিসের বস নিয়ম করে বিছানায় আসার আহ্বান জানায়, সেটি কি মানসিক নির্যাতন? রাতের অন্ধকারে কাজের মেয়ের শয্যায় শুয়ে পড়ে স্বামী, সেটি কি স্ত্রীর জন্য মানসিক নির্যাতন? সেটি কি কাজের মেয়েটির জন্য মানসিক নির্যাতন? মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে অপমান আর বঞ্চনা করা হয় বড় বড় অফিসে, সেটি কি মানসিক নির্যাতন? প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হলে হুমকি ধমকি তুলে নিয়ে যাবার ভয় দেখানো হয় মেয়েকে, সেটি কি মানসিক নির্যাতন? খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, সাহিত্য চর্চা সর্বত্র নারীকে নানা অসমতা আর বৈষম্যের কাঁটাতার পেরোতে হয়, সেটি কি মানসিক নির্যাতন? পোশাক আশাক জীবনাচরণ দেখে চরিত্র নির্ধারণ করা হয় মেয়ের, সেটি কি মানসিক নির্যাতন?

আমি যদি এভাবে লিখতেই থাকি, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ভরে যাবে, শেষ হবে না। আমার শেষ প্রশ্নটি তাই করে যাই।

এইসব যদি মানসিক নির্যাতন হয়ে থাকে, তবে যুগের পর যুগ ধরে নারী কেন সহিংস হয়ে ওঠেনি পুরুষের বিরুদ্ধে? কেন স্কয়ার হাসপাতালের বেডে নিঃস্বার শুয়ে আছে খাজিদা, কেন বদরুল নয়?

নারীর যন্ত্রণাকে অনুভব করতে চাই বিশাল একটি হৃদয়। এই হৃদয় পুরুষতন্ত্রের তত্ত্ব দিয়ে অর্জন সম্ভব নয়! আর নৈর্ব্যক্তিকতা? সমতাহীন, বৈষম্যময় পরিস্থিতে নৈর্ব্যক্তিকতা অর্থহীন, অবান্তর। এটি পুরুষতন্ত্রের একটি নতুন হাতিয়ার মাত্র, আর কিছু নয়।

শেয়ার করুন: