‘পুরুষ’ না হয়ে ‘মানুষ’ হোন

সুরাইয়া আবেদীন: আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম ‘পুরুষটাকে’ … বলা চলে আমরা সবাই মিলে দেখলাম। মিলা বলেছিল ‘দেখিস, কল্পনাও করতে পারবি না এই লোক এই কাজ করছে’। আমরা গিয়েছিলাম মূলত ‘পুরুষ’টিকে দেখতে। অজুহাত দিয়েছিলাম সংবিধানের জটিল এক ব্যাপার বুঝছি না। ‘পুরুষ’টি যদি একটু বুঝিয়ে দিতেন।  

suraiya-3
সুরাইয়া আবেদীন

মিলার মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষে থাকাকালীন আমরা জানলাম খুব ভাল এক স্যার আছেন সংবিধানের ব্যাপারগুলো চমৎকার করে বুঝিয়ে দিতে পারেন। মিলার সাথে এক সেমিনারে আলাপ হয়েছিল তার। বিসিএস দিয়েছেন, টিকেছেন, চমৎকার সরকারি চাকরির পাশাপাশি ছুটির দিনগুলোতে বিভিন্ন সেমিনারে ক্লাস নেন তিনি…   
যাই যাচ্ছি করেও আমাদের যাওয়া হয়ে উঠলো না। কিন্তু মিলা উনার কাছ থেকে পড়া বুঝে নিত। কখনো ফেসবুকে, কখনো ফোনে।
এভাবেই আলাপ। পরিচয়। পরিণয়। প্রেম।   
পরিণয়ের এক পর্যায়ে ঘুরতে যাবার নাম করে সিএনজিওয়ালার সামনেই মিলাকে তিনি আধা রেপ করে দিলেন। বুকে, ঘাড়ে পিঠে, হাতে যতটা শক্তি দিয়ে পারা যায়, ততটা শক্তি দিয়ে মিলাকে আঁচড়ে-খামচে দিলেন…
আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া মিলাকে আমরা ফিরিয়ে আনলাম। বাঁচিয়ে তুললাম এবং এক শুক্রবার গেলাম সেই ‘পুরুষ’টিকে দেখতে…।

আহা কী সৌম্য চেহারা!!
সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা বিভাগ থেকে পাশ করা বিসিএস দেয়া একজন!! রুমে ঢুকতেই কী হাসি।
কী বিনয়!
আমাদের বুঝিয়ে দিলেন সংবিধানের ব্যাপারগুলো।
যদিও আমরা ভেতরে ভেতরে ক্রোধে ফেটে পড়ছিলাম…  

আমি শুধু দেখছিলাম উনার ‘হাত’।
আচ্ছা এই হাত দিয়েই তো উনি নিজের মেয়েকে আদর করেন, তাই না? এই হাত দিয়েই তো আল্লাহর কাছে মোনাজাত করেন নামাজ শেষে? এই হাত দিয়েই তো কুরআন শরীফের পাতা উল্টান তেলাওয়াতের সময়? এবং এই সেই একই হাত যে হাত মিলার বুক থেতলে দিয়েছিল?
ফেরার সময় আমরা কেউ কিছু না করলেও শায়নি আচমকা উনার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরেছিল।
হতভম্ব উনি তাকিয়ে ছিলেন।
শায়নি বলল -এই চড়টা মিলার সেদিন দেবার কথা ছিল। ও দিতে পারেনি। ওর হয়ে আমি দিয়ে গেলাম।
ঝড়ের বেগে শায়নি বের হলো, সাথ সাথে আমরাও…

বাসার কাছেই এক সুপার শপে সপ্তাহের বাজার করি, প্রায়ই দেখি কাউন্টারের মেয়েগুলো যখন প্রোডাক্টের হিসাব করে, বাপের বয়সী লোকগুলো মেয়েদের বুকের দিক তাকিয়ে থাকে… আচ্ছা এই চোখ দিয়ে নিজের মেয়েকে দেখার সময়ও কি মেয়ের বুকে তাকান সামনে দাঁড়ানো এই ভদ্রলোক(!!) নিজের মেয়ের বুক আর এই মেয়ের বুকে কী এমন তফাৎ?
নারীদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার সাহসের কেন এতো অভাব পুরুষের?  

চেক আপের জন্য নিয়ে গেলাম ভাবিকে। সাত মাসের প্রেগন্যান্ট ভাবি বসে আছেন। অসুস্থ, ক্লান্ত। ঐখানে আরও রোগী ছিলেন। নিজের ওয়াইফ ডক্টরের রুমে ঢোকামাত্র সে রোগীর স্বামী অর্থাৎ ‘পুরুষ’টি অন্য নারীদের পেটের দিকে, শরীরের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকা শুরু করেন, একই শারীরিক অবস্থা যে নিজের স্ত্রীরও, কে বলবে! এদের দেখলে মনে হয় এই প্রথমবারের মতো ‘প্রেগন্যান্ট’ কাউকে দেখছে!
বিস্মিত হই!
এই একটু আগেই স্ত্রী পাশে থাকা অবস্থাতেই এক রূপ, আর স্ত্রী না থাকতেই ভিন্ন কেউ!  
মুহূর্তেই নিজের এতো পরিবর্তন মনে হয় অক্টোপাসও করতে পারবে না…

এরা কেউই কিন্তু অশিক্ষিত না। চমৎকার জব করা, পোশাকে, শিক্ষায় একদম ফার্স্ট ক্লাস। অথচ ডাস্টবিনের নোংরামি এরা ধারণ করে হাতে, মুখে, চোখে, অভিব্যক্তিতে।  
বাসের হেলপার যে স্কুলে যেতে পারেনি তার মানসিকতা আর বিসিএস দেয়া একজন, যে কিনা সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে কাজ করে, কিংবা কোনো ব্যাংকের প্রথম দিকের কর্মকর্তা- এদের মানসিকতার মধ্যে পার্থক্য পাই না কোনো। এদের অবস্থান, পরিচয় সব কিছু মিথ্যা হয়ে যায় কোনভাবে যদি এক মেয়ের শরীরে হাত দেবার সুযোগ সামনে আসে…
রেপ চলে চোখে, কথায়, ভাষায়, হাসিতে অথবা ইঙ্গিতে…
আপনাদের মত পুরুষদের বলি- what goes around comes around। একদিন নিজের মেয়েকে, পরিবারের নারী সদস্যদের ভিকটিম হতে দেখবেন আপনাদের তৈরি করা নিয়মে, আপনাদের মতোই ‘শিক্ষিত’ কারোর হাতে।
নিজের মেয়ের চোখের পানি দেখে হয়তো কিছুটা অনুধাবন করবেন অন্যের মেয়ের সাথে কী জঘন্য ব্যবহার আপনি করেছেন।

তাই বলি কি ‘পুরুষ’ না হয়ে ‘মানুষ’ হন। সমাজে যে নোংরামি নিজে চালু রেখেছেন সমমনাদের নিয়ে তা বন্ধ করুন।
সমাজে আপনারা কি করেন? আপনারা তো আনসিভিলাইযড বলতে যা বোঝায় তাই।
আপনাদের ‘পুরুষ’ পরিচয় যখন ‘মানুষ’ পরিচয়কে ছাপিয়ে উঠে তখনই আপনারা জন্ম দেন অনাচার, অন্যায় আর অসমাজিক শিষ্টাচারের।
পুরুষ সত্ত্বা যখন ‘মানুষ’ সত্ত্বাকে পিশে ফেলে তখন আপনারা প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হলে কুপিয়ে মারেন, মেয়ের সমবয়সী একজনের বুকের দিকে তাকিয়ে থাকেন, পাশ দিয়ে কেউ যাবার সময়  জঘন্য মন্তব্য করেন, নির্দোষ আলাপের মাঝে হোটেলে যাবার অফার করে বসেন, আর বাগে পেলে তো কথাই নাই! মুখোশ খুলে ফেলতে চিন্তা পর্যন্ত করেন না…  
আবার ঠিক আপনার মতোই আরেকজন ‘পুরুষ’ যখন নারীকে ‘মানুষ’ হিসেবে দেখে, বুকে না তাকিয়ে চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলে, সকল অবস্থায় নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান দিয়ে চলে, হাত, মুখ, চোখ, কথা নিয়ন্ত্রণে রাখে- তখন তার ‘পুরুষ’ সত্ত্বার অন্ধকার ঢাকা পড়ে ‘মানুষ’ সত্ত্বার আলোতে।      
‘পুরুষ’ পরিচয় বড় অন্ধকারের।  
তাই অনুরোধ করি ‘পুরুষ’ না হয়ে ‘মানুষ’ হন।
আমাদের সমাজে ‘পুরুষ’ এর অভাব নাই, কিন্তু ‘পুরুষ’ এর মধ্যে ‘মানুষ’ এর বড় অভাব…..।

শেয়ার করুন: