সংসারে টিকে থাকাটাই চরম সার্থকতা নয়

সাদিয়া নাসরিন: লিখতে বসেছি, সংসার ধরে রাখা অথবা পবিত্র বিবাহ বন্ধন টিকিয়ে রাখা নিয়েব্যক্তিগতভাবে আমি সংসার এবং পরিবার বলতে একমাত্র বৈবাহিক সম্পর্ককেই বুঝি না। একটা সংসার বা পরিবারের জন্য একজন মানুষের সাথে বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াতে হবে এমনও মনে করি না। মূলত সব মানুষই সংসারি এবং সবারই একটা পরিবার আছে

যাঁদের স্বামী/স্ত্রী নেই, কিন্তু সন্তান আছে, অথবা সন্তানও নেই, যাঁরা পরিবারের অন্য সদস্যদের সাথে বসবাস করেন, অথবা একা থাকেন, তাঁদেরও কিন্তু সংসার থাকে। হাঁড়ি-পাতিল, বাজার-সওদা, আতিথেয়তা-সামাজিকতাসহ আর সবার মতো সংসার ধর্ম  তাঁরাও পালন করেন। এমনকি আশ্রমে যাঁরা থাকেন, তাঁরাও নিজের জন্য একটি ‘গৃহকোন’ বানিয়ে তাতেই সংসার সাজিয়ে বসেন। এটিই মানব ধর্ম।

sadia-11
সাদিয়া নাসরিন

কিন্তু সংসার বা পরিবারকে বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে আবদ্ধ করে যদি ধরে রাখা বা টিকিয়ে রাখার কথা আসে, তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হতে পারে। বিশ শতকের নারীবাদের প্রবক্তা সিমোন দ্য বোভোয়ার, জ্যাঁ পল স্যাঁত্র’র সাথে আমরণ সম্পর্কে আবদ্ধ ছিলেন। এই সম্পর্ক না ছিল বৈবাহিক, না ছিল “একত্র বাস”’বিশ শতকের অন্যতম এই দুই দার্শনিক পরস্পরকে প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত করেছিলেন তাদের মুক্তিকামি দর্শন এবং নিজ নিজ চিন্তা ও কাজের দ্বারাতাঁরা উভয়েই বিশ্বাস করেছিলেন, যে সমাজ লৈঙ্গিক বৈষম্যকে লালন-পালন করে থাকে, সে সমাজে আর যাই হোক বিয়ের মতো সামাজিক বন্ধন মানায় না। আবার একত্রবাসও পারস্পরিক সম্পর্কগুলো অন্যের আধিপত্য থেকে মুক্ত রাখতে পারে না।

এই লেখা পড়তে পড়তে কেউ যদি মনে করে থাকেন, আমি বৈবাহিক সম্পর্কের বিপক্ষে, তাহলে ভীষণ অবিচার করা হবে তবে, বৈবাহিক বা অবৈবাহিক দুই ধরনের সম্পর্কই পারস্পরিক আধিপত্যমুক্ত থাকাটা জরুরী বলে মনে করি আমিসংসার টিকিয়ে রাখার জন্য “যোগ্যতার” চাইতে গায়ের চামড়াটা একটু মোটা করতে পারাটা অনেক বেশী দরকার বলে মনে হয় আমার যুগ যুগ ধরে আমাদের মা-চাচি-দাদীরা তাদের মোটা গায়ের চামড়া দিয়েই সংসার ‘ধরে’ রেখেছেন সগৌরবেপ্রয়োজনমাফিক গালি-উষ্ঠা যেমন খেয়েছেন, কর্তার মর্জিমাফিক প্রেম ভালোবাসাও করেছেন।

কর্তারা খুশি হয়ে তেল সাবান দিলে তা গায়ে মেখে ভাতের বাসন সাজিয়ে দাঁড়িয়েছেন। আমি তাতে বিশেষ কোন ক্ষতিও দেখি না। কারণ তাঁরা স্বামীদেরকে মালিক বা প্রভু মেনে নিয়ে এই দাসজীবনকে অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করেছেন।

আপাতদৃষ্টে বৈবাহিক সম্পর্কটা হলো ইলাস্টিকের মতো। যেকোনো একজন একমাথা ছেড়ে না দেওয়া পর্যন্ত তা টানাটানি করে কেয়ামততক লম্বা করা যায়। বলাই বাহুল্য, এই টেনে ধরে রাখার শক্তি এবং দায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর। তো বিয়ের এই ইলাস্টিক মরণ পর্যন্ত টেনে নিয়া যাওয়ার জন্য যোগ্যতা কতটুকু লাগে আমি জানি না, তবে নিজের ‘স্বাতন্ত্র্যবোধ’ বিসর্জন দিতে হয় তা হলফ করে বলতে পারিদুইজন মানুষ উভয়েই নিজের সম্মান একই মাপে বজায় রেখে, পরস্পরের পূর্ণ শ্রদ্ধায় বৈবাহিক ইলাস্টিক টেনে ধরে রাখা কঠিন। যাঁরা পেরেছেন বা পারছেন তাঁরা নমস্য।

Gender-inequality-in-US-03সংসার নামক কর্মকাণ্ড দুইজন মানুষের সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমেই পূর্ণতা দেওয়ার পক্ষে আমিকিন্তু বাস্তবে ঠিক সেরকম তো ঘটেই না, কাছাকাছিও খুব কম ঘটেবিবাহিত বা অবিবাহিত উভয় সম্পর্কই মূলতঃ ভয়াবহরকম নিয়ন্ত্রণকামী হয়ে উঠে নারী-পুরুষ উভয়েই সমানভাবে এই সম্পর্ক উপভোগ করতে পারে না। দুই সম্পর্কেই একজন ‘কর্তা’ হয়ে উঠতে থাকে, আর অন্যজনকে পরিণত করতে চায় ‘কর্মে’

বলা বাহুল্য, এই পুরুষতান্ত্রিক সিস্টেমে স্বামী বা পুরুষটিই কর্তার স্থান দখল করেন। সেক্ষেত্রে নারী বা স্ত্রীরা গায়ের চামড়াটা মোটা করে নিজেকে “কর্তার ইচ্ছা-ই কর্ম” এই ফরমেটে ফেলতে পারলেই সেই সম্পর্ক টিকে যায়। তার জন্য বিশেষ কসরত দরকার হয় না। শুধু কষ্ট করে নিজের শরীরের “তেল”গুলো পানি করে ফেলতে হয়

যেসব নারী এখনো সংসার বলতে কেবল একজন অর্থনৈতিকভাবে সক্ষম পুরুষকেই বোঝেন এবং সেই পুরুষ অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান করবেন বলে নিশ্চিন্তে থাকেন এবং মাঝে মাঝে দুই-চার লাত্থি খেয়ে খুশিতে বাকবাকুম করেন, তাদের নিয়ে এই আলোচনা না। এটিই বাজার দরে খোরপোষের “পবিত্র বন্ধন” এবং পুরুষতন্ত্রের দাবি(?)।

গরুর দুধ দুইতে গেলে মাঝে মাঝে গরুর লাথি খেতে হবে, এটা বোঝার জন্য আইনস্টাইন হতে হয় না। কিন্তু যে গরু নিয়মিত দুধ দেয়, আবার নিয়ম কইরা লাথিও খায়, সেই গোয়াল ধরে রাখার বিষয়ে কথা হওয়া প্রয়োজনএকজন আর্থিকভাবে সক্ষম মানুষ সংসারে সমান অর্থের (বেশী বা পুরাটাই) যোগান দিয়েও আর একজনের হাতে নিয়ন্ত্রিত হবে, অন্যজনের আধিপত্য মেনে নিবে কোন যুক্তিতে?

আমি আবার রিপিট করি, “নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য”না, মহান কোন শব্দ ভান্ডার দিয়ে এই শব্দগুলোকে মহিমান্বিত করার কিছু নাই। একজন মানুষ একজন মানুষকে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করার পেছনে কোন ধরনের ভালোবাসা, আবেগ, নির্ভরতা ইত্যাদি কাজ করে না। নিয়ন্ত্রণ করা হয় শুধু মাত্র একটি ধারণা থেকে, তা হলো “কর্তার ইচ্ছাই কর্ম”। সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ যদি কোনভাবে একজনের হাতে চলে যায়, সংসার, পরিবার, বা বিয়ে যে নামেই হোক না কেন, সে সম্পর্ক আমার কাছে অসম্মানের। সেই সংসার টিকিয়ে রাখার মধ্যে কোন যোগ্যতা আমি দেখিনা। আমি এটাকে ‘আপোষ’ বলি। আর আপোষ করার জন্য ধৈর্য দরকার হলেও যোগ্যতার কোনো দরকার নাই।

যে সম্পর্ক দুজনেই সমানভাবে উপভোগ করতে পারে, পরস্পরের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল থাকতে পারে, সে সম্পর্কের সৌন্দর্যে আমার পূর্ণ শ্রদ্ধা। সেজন্য দুজন সঙ্গীর সমান বোঝাপড়া জরুরীএমন আপোষ বা ত্যাগ করতে হলেও তা হওয়া উচিত ‘পারস্পরিক’। একপক্ষীয় আপোষ বা ত্যাগ  আর দাসজীবনের মাঝে আমি কোন পার্থক্য দেখি না। বরং সংসারে দুজনের সমান অবস্থান তৈরি করার জন্য সঙ্গীর কাছ থেকে সমান আপোষ আদায় করতে পারার মধ্যে আমি যোগ্যতা দেখি। আমি বিশ্বাস করি, দুজন মানুষ সমান দায়িত্ব পালন করলে, সংসার নামক কর্মকাণ্ডে সমানভাবে অংশগ্রহণ করতে পারলে সেই সম্পর্কে একজন আরেকজনকে নিয়ন্ত্রণ বা দমন করার কোন সুযোগ থাকে না।

প্রশ্ন হলো এই ‘সমান অংশগ্রহণ’যদি দুজনই আর্থিকভাবে সমান সক্ষম হয়ে থাকেন, দুজনই সংসারের ব্যয় সমানভাবে বহন করেন, তবে সংসারে অবস্থানও দুজনের সমান হতে হবে এটিই ন্যায্য। যদি টাকা কামানোও আপনার কাজ হয়, আবার চুলা ঠেলাও আপনারই কাজ হয়, ঘরে ঢুকতেই “উনার” চাঁদমুখের দিকে তাকিয়ে মেজাজের মিটার মেপে কথা বলতে হয়, উনার জমি বলে যখন খুশি চাষ করতে দিতে হয়, তাহলে সেই ‘সংসার’ ধরে রাখার ‘যোগ্যতা’ অর্জন না করাই সক্ষম এবং সামর্থ্যবান নারীদের জন্য মঙ্গলজনক বলে মনে করি আমি।   

মনে রাখবেন, মানুষ ভিন্ন হতে পারে, সংসার আলাদা হতে পারে, সম্পর্ক ও স্বতন্ত্র হতে পারে, কিন্তু নারীকে নিয়ন্ত্রণ করার পুরুষালী কৌশল বা ধান্দা সারাবিশ্বে এক ও অভিন্নসুতরাং সন্তানের জন্য, সমাজের জন্য কৌশলে করতে গিয়ে নিজের নিয়ন্ত্রণ অন্যের হাতে তুলে দিয়ে আপাতত ‘ঝামেলা’ হয়তো যায়। কিন্তু যে সন্তান, সমাজের নাম করে যেকোনো উপায়ে আপনি সংসার ধরে রাখছেন, তাতে যদি সম্মান না থাকে, মানবিক সমতা না থাকে, তবে সেই সন্তান-সমাজও আপনাকে সম্মান দিবে না, বড়জোর করুণা করবে।

আমার কাছে সমান মানে সমান। আমার নিয়ন্ত্রণ আমার হাতেএইখানে কোন ধরনের মায়া-মমতা-আবেগের জায়গা নেই সে এক কোমর নামলে প্রয়োজনে এক গলা নামতে প্রস্তুত আমি, কিন্তু সংসারের শান্তি রক্ষার নামে তাঁকে ডাঙ্গায় বসিয়া আমাকে হাত পা বাইন্ধা নদীতে ফেলিয়া সাঁতারের দক্ষতা বিচার করিতে আমি দিতে রাজি না।

না, কথার কথা বলছি নাআমাদের সংসারের এ-ই নিয়মআমি এক পা নামলে সেও এক পা নামে। সংসারে যতটুকু ছাড় দিতে হয়, দুজনই দিইসবসময় আপোষে সব ঘটে না, মাঝে মাঝে দুজনই “নিয়ন্ত্রণকামী” হয়েও উঠি। প্রচণ্ড মেঘ করে ঝড়ও উঠে কখনো-সখনোকিন্তু সেই ঝড় দুজনেই সমান হাতে সামলাই। ঝড় থেকে ঘরের চাল বাঁচানোর দায় আমি একা বহন করি না কখনো।

আমি বরং বলি, যখনই অন্যায় দেখবেন, প্রতিরোধ করুনঅন্যায়, সে আয়তনে- ওজনে যতোই ছোট হোক না কেন, তা এখনই থামান। চোখে চোখ রেখে কথা বলুন। আপনি যে বিষয়টা পছন্দ করছেন না তা পরিষ্কার করে উচ্চারণ করুন। আপনি যা বিশ্বাস করেন তাও পরিষ্কার ভাষায় বলুন। অন্যজনকেও বলতে দিনহয়তো বিরোধ তৈরি করবে আপাতত

বিরোধ হতে দিন, তর্ক হোকগলা উঁচা করে হোক বা নিচু, কথা আপনাকে বলতেই হবেমনে রাখবেন, আপনি চোখ বন্ধ করে রাখলেও প্রলয় কিন্তু বন্ধ হবে না। বিরোধ-উচ্চারণ-মীমাংসার পর যদি সংসার সমান অবস্থানে এসে দাঁড়াতে পারে তবে তাতেই টিকে থাকার সার্থকতা।

আর যদি সমান অবস্থানে আসতে নাই পারেন,  তবে কষ্ট হইলেও একলা চলুনবিসর্জনের জীবনে আর যাই থাকুক না কেন, সম্মান বলে কিছু থাকে না। অন্যের কাছে তো না-ই, নিজের কাছেও না। এখানে যোগ-বিয়োগের অঙ্ক কষবার কিছু নেইমনে রাখবেন, একলা জীবন মানেই “অসুখী জীবন” নয়। আবার দাম্পত্য মানেই টুইটম্বুর রসগোল্লা নয়। কখনো কখনো একলা জীবন সম্মানের এবং ব্যক্তিত্বের। একলা চলতে সাহস লাগে, তেজ লাগে, দম লাগে।

শরতবাবুর মতো করেই বলি, “ টিকিয়া থাকাই চরম সার্থকতা নয়, অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছেতাই বলিতেছিলাম, দিবারাত্রি চোখে-চোখে, কোলে-কোলে রাখিলে এবং কৌশল করিলে আপনার সংসারখানা যে বেশটি থাকিবে, তাহাতে কোন সন্দেহ নাইকিন্তু একেবারে তেলাপোকাটির মতো বাঁচাইয়া রাখার চেয়ে এক-আধবার কোল হইতে নামাইয়া প্রবল জঙ্গলের মাঝখানে হস্তিশাবকের মতো দু-এক পা হাঁটিতে দিলেও প্রায়শ্চিত্ত করার মতো পাপ হয় না”  

ঘরে বাইরে নিরন্তর লড়াই করতে থাকা মানুষদের প্রতি আমার ভালোবাসা ও শুভকামনা।      

প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ  

 

শেয়ার করুন: