ফারহানা আনন্দময়ী: তখন আমার নিতান্তই বালিকা বয়স। বাড়িতে ভিসিআর আসেনি, রঙিন টিভিও নয়। বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে ‘গান্ধী’ ছবিটা দেখার আয়োজন করা হয়েছে। কয়েক পরিবার এবং আমরাও দেখছি। মাঝপথে বাবা উঠে গেলেন, কেউ একজন এসেছে কোনো খবর নিয়ে, এসে বললেন, আমাদেরকেও এখন ফিরে যেতে হবে।
বাড়িতে পৌঁছে দেখি সকলের মুখ থমথমে। আমার সেজো ফুপু, বেনাপোলে যার সংসার, তিনি মারা গেছেন। শোকের ভেতরেও কেমন এক ফিসফিসানি, লুকোচুরি। বড় কাজিনদের কাছ থেকে জানলাম, উনি আত্মহত্যা করেছেন। বাবা-মা, চাচা-চাচীরা চলে গেলেন। বাড়িতে আমরা ছোটরা রয়ে গেলাম।

শুধু শুনলাম, ওষুধ খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। ফুপুর প্রাপ্তবয়স্ক তিনজন সন্তান আছে, স্বামীও ছিলেন। সেই বয়সে জানিনি, স্খলন কাকে বলে। আরও অনেক পরে এসে জেনেছি, স্বামীর স্খলনকে, দাম্পত্যের প্রতারণাকে তিনি নিজের গ্লানি হিসেবে গণনা করেছিলেন, সেই গ্লানির ভাগ মা-বাবা-ভাই-বোন-সন্তানকে দিতে চাননি। তাই নিজেকেই শেষ করে দিয়েছিলেন। সাধারণ গৃহবধু ছিলেন।
প্রতিবাদ, লড়াই, বেঁচে ওঠা… কোনোটাই করার মতো হয়তো মনের জোর খুঁজে পাননি তখন।
এই ঘটনার কয়েক বছর পরে আরেক ফুপুর ঘটনা, আমার ন’ফুপু। এক শহরেই বাস আমাদের। ফুপুর হাতের নাস্তা আমার খুব পছন্দের ছিল, মায়ের সঙ্গে প্রায়ই বেড়াতে যেতাম। এক কন্যা, স্বামী, শ্বাশুড়ি নিয়ে সংসার তার। একটা সময় গিয়ে শুনলাম, ফুপুর নাকি সংসারের কোনো কাজে মন নেই আজকাল, সারাক্ষণ মন খারাপ করে বসে থাকেন একা একা। আমরা যখনই যাই, উনার শ্বাশুড়ি, স্বামীর একগাদা অভিযোগ, ফুপুর নামে।
এরকম কয় মাস চলার পরে ফুপুকে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। চিকিৎসা চলছে, তাকে বোঝানো চলছে… কোনো পরিবর্তন নেই। হঠাৎ একদিন মাঝরাতে ছাদ থেকে লাফ দিলেন। আমার তখন এসএসসি’র টেস্ট পরীক্ষা চলছে, জেগেই ছিলাম। টয়লেট থেকে বারান্দা দিয়ে ফিরতে চোখে পড়লো ছাদের দরজা খোলা। সবাইকে ডাকাডাকির পর জেগে উঠলো পুরো বাড়ি… ফুপু সফল হননি সেই চেষ্টায়। পঙ্গু হয়ে হাসপাতালে চলে গেলেন।
পঙ্গু হাসপাতালে থাকতে থাকতেই সাধারণ বিষণ্ণতা থেকে পুরোপুরি মানসিক রোগী হয়ে উঠলেন। এবারে উনাকে পাঠানো হলো মানসিক হাসপাতালে। তার স্বামীর পরিবারের কেউ খোঁজ নেয় না, কন্যাও নয়। যা করা হচ্ছে তার ভাই-বোনেরাই করছেন। একদিন মানসিক হাসপাতাল থেকে খবর এলো, তিনি আবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, ফিরিয়ে আনতে হলো তাকে বাড়িতে। ন’ফুপু তখন জীবন্ত কংকাল যেন।
এরপরে যতদিন বেঁচে ছিলেন, নীচতলার একটা ঘরে তাকে রাখা হতো, ওখান থেকেই সারাদিন চিৎকার, নিজের মত করে বেসুরো গান গাওয়া, কখনো কখনো ক’দিনের জন্যে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে থাকা। কখনো একদম উলঙ্গ হয়ে বসে থাকতেন। ঘরের সামনে দিয়ে যখনই যেতাম, আমাকে দেখলেই বলতেন, “তুই আমার ছন্দা না? আয় না, কাছে আয় না” (ফুপুর কন্যার কল্পিত নাম, আমার সমবয়সী)। আমি ভয়ে কাছে যেতাম না।
এভাবেই আমার এই ফুপুটাও মারা গেলেন কিছুদিন পরে। সেই প্রথম চোখের সামনে এমন কাছের কারো চলে যাওয়া। তিনিও তো আত্মহত্যাই করলেন, নাকি হত্যার শিকার হলেন! তার কষ্টটাও ছিল সাংসারিক। স্বামী-কন্যা গুরুত্ব দেয় না, শ্বাশুড়ি সংসারে নিজের আধিপত্য বজায় রাখতে সবসময় তাকে অবদমন করে রাখতো। উনিও রুখে দাঁড়াননি, স্বামীকে-কন্যাকে হয়তো খুব ভালবাসতেন। যতবার আমার বাবা-চাচারা নির্যাতনের মামলা করতে চেয়েছেন, ওই বিষণ্ণতার মধ্যেও তিনি তাদেরকেই বাঁচানোর চেষ্টা করে গেছেন। দুইবার আত্মহত্যার চেষ্টা করে শেষে জীবন থেকে চলেই গেলেন।
এই দুই ফুপুর বিষয়ে আমাদের পরিবারে এখন আলাপ হয়ই-না বললে চলে। মানে মৃত্যুর বিষয়টা, মৃত্যুর পথটা নিয়ে সকলেই নিশ্চুপ থাকে।
আমি এখন এসে বুঝতে পারি, ফুপুদের এই যে চুপ থাকা, সব সয়ে নেয়া, সমাজকে ভয় পাওয়া, অন্যকে ভাল রাখতে গিয়ে নিজে শেষ হয়ে যাওয়া… সে তো আজকের নয়। চলেই আসছে অনেক আগে থেকে। আগেরদিনে কম শোনা যেত এসব ঘটনা, আজকের দিনে নারীদের বেঁচে ওঠার তাগিদে আমরা একটু বেশি শুনতে পাই। নির্যাতন, অবদমন, প্রবঞ্চনা… মুখোশের আড়াল থেকে নারীরা টেনে বাইরে বের করার মতো সাহসী হয়ে উঠেছে।
এই ঘটনা দুটো আমাকে এক বিশাল শিক্ষা দিয়ে গেছে জীবনের। খুব সতর্ক থাকতে হয়… আমারই পরিবার, আমারই রক্ত, যদি আমাকেও টান মারে! বিষণ্ণ হওয়ার মতো অনেক ঘটনা ঘটে জীবনে। তবে বিষণ্ণতা শব্দটাকে আমি লাথি মারতে শিখেছি। আত্মহত্যা শব্দটাকে আমি তখন থেকেই আমার জীবনের অভিধান থেকে ঝামা দিয়ে ঘষে মুছে দিতে শিখেছি। আমার দুই ফুপুর আত্মহত্যা এবং বিষণ্ণতাজনিত মৃত্যু আমাকে জীবনকে ভালবাসতে শিখিয়ে দিয়ে গেছে, জানিয়ে দিয়ে গেছে নারীর স্বনির্ভরতার প্রয়োজনীয়তা। বিষণ্ণ হতে হতেও গা ঝাড়া দিয়ে উঠি। সবার সব লড়াই সরব নয়, সব লড়াই দৃশ্যমানও নয়। তবু ঘরে ঘরেই লড়াইটা আছে এবং লড়াইটা যার যার মতো করে চালিয়ে যেতে হয়।
আমি প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করবো, আমার ভাল-থাকাকে নিজের হাতের মুঠোয় রাখবো। তাতে আমাকে অবাধ্য বলো, আমাকে তোমাদের ভাষায় ‘খারাপ’ বলো… কিচ্ছু যায় আসে না আমার। আমি জীবনকে কিছুতেই হেরে যেতে দিতে রাজী নই, আমি জীবনকে যাপন করতে চাই, নিজের মতো ক’রে। কারণ, আমি দেখেছি… আমার দুই ফুপুর জীবনের এই স্বেচ্ছা বিসর্জনে অন্য কারো জীবনের কোথাও এতোটুকু থেমে থাকেনি।
সকালে খবরের কাগজে পড়লাম আজ ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস’। রিপোর্টটা পড়ে আমার কেন জানি মন খুলতে মন চাইলো, এতোগুলো বছর বন্ধ থাকা অন্ধকার কুঠুরির জানালাটা খুলে দিতে মন চাইলো।
বিষণ্ণতা মানসিক অসুস্থতার প্রথম ধাপ, ধীরে ধীরে তোমাকে পুরোপুরি গ্রাস করে নেবে। বেরিয়ে এসো নারী, মুখ খোলো, মন খোলো। বেঁচে ওঠো, মানুষ। কাটুক জীবন সরব আকাঙ্ক্ষায়।