ছুটির বেলায় এত সাম্প্রদায়িকতা কেন?

শান্তা মারিয়া: বাংলাদেশে বছরে এগারো দিন সংবাদপত্র প্রকাশিত হয় না। বাংলাদেশের জাতীয় সংবাদপত্রে যারা চাকরি করেন তারা বছরে এই এগারো দিন ছুটি ভোগ করেন। এছাড়া ব্যক্তিগত ছুটি, ঐচ্ছিক ছুটি, অসুস্থতাজনিত ছুটি এবং মাতৃত্বকালীন ছুটি তো আছেই।  

এগারো দিনের ছুটির তালিকার দিকে একটু লক্ষ্য করা যাক।

Shanta 2
শান্তা মারিয়া

ঈদুল ফিতরে ৩ দিন, ঈদুল আজহায় ৩ দিন, ঈদে মিলাদুন্নবী ১ দিন, শবে বরাতে ১ দিন, আশুরা ১ দিন, পহেলা বৈশাখে ১ দিন ও মে দিবসে ১ দিন। ১১ দিন ছুটির মধ্যে ৯ দিন ধর্মীয় দিবসের কারণে। এই ৯ দিনই মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় দিবস।

হিন্দু সম্প্রদায়ের বড় উৎসব দুর্গা পূজা, কালী পূজা ও জন্মাষ্টমী, বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বড় উৎসব বুদ্ধ পূর্ণিমা, মাঘী পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের বড় উৎসব খ্রিস্টমাস, ইস্টার ইত্যাদিতে সংবাদপত্রের প্রকাশ বন্ধ থাকে না। ফলে ওইসব সম্প্রদায়ের যারা সংবাদপত্রে চাকরি করেন তারা এমনিতে ছুটি পান না, তবে চাইলে ছুটি নিতে পারেন।

সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ থাকা না থাকার বিষয়টি মূলত নির্ধারণ করে নওয়াব (নিউজপেপার’স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ)। পত্রিকা মালিকপক্ষ অবশ্য চাইবেই ছুটি কম দিতে। কারণ পত্রিকা বন্ধ থাকলে তাদের ক্ষতি। কিন্তু আর্থিক লাভ-লোকসানই তো সব নয়। ভাবমূর্তি বলেও তো একটা কথা আছে। শুধু মুসলিম সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উৎসবগুলোতে ছুটি দেওয়া হবে, আর অন্য সম্প্রদায়ের বেলায় একটি ছুটিও দেওয়া হবে না সেটা কি কোনো দিক থেকে শোভন? দুই ঈদ মিলিয়ে ছয়দিন ছুটি দেওয়া যায়, আর দুর্গা পূজা, বুদ্ধ পূর্ণিমা, খ্রিস্টমাসে একদিন করেও ছুটি দেওয়া যায় না। এটা কি বড় বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে যায় না?

এ বিষয়ে কিছু বলতে গেলেই যুক্তি দেওয়া হয় এদেশে সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলমান। ঠিক আছে সংখ্যাগুরুদের জন্য নয় দিন ছুটি দিতে তো কেউ মানা করছে না। সেইসঙ্গে সংখ্যালঘুদের জন্য না হয় একদিন করে মোট তিনদিন আরও বাড়ানো হলো। তিন সম্প্রদায়ের তিনটি প্রধান উৎসব দুর্গাপুজা, বুদ্ধ পূর্ণিমা ও খ্রিস্টমাস-এ তিনদিন ছুটি হলে পত্রিকা মালিকরা নিশ্চয়ই ফতুর হয়ে যাবেন না। ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। সে হিসেবে এই উৎসবের দিনগুলো তো হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকেরই। এই শারদীয়া দুর্গাপূজায় দেশের সর্বত্র উৎসবের আমেজ। কিন্তু সংবাদপত্রের কর্মীদের সেই উৎসবের দিনটিতেও অফিসে আসতে হয়।

এ বিষয়ে সরকার থেকেও চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কারণ পত্রিকাগুলোর এমন সাম্প্রদায়িক চেহারা কিন্তু সমাজ ও রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের একটা সাম্প্রদায়িক চেহারাই তুলে ধরে।

সাংবাদিকদের ইউনিয়ন দুই ভাগে বিভক্ত এবং দুর্বল। তবে যখন সবল ছিল, তখনও সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে কোনো দাবি তুলেছিলেন কিনা আমার জানা নেই। এখনও সাংবাদিকদের ইউনিয়ন থেকে এই দাবি জোরালোভাবে উপস্থিত হওয়া প্রয়োজন। ইউনিয়ন সদস্যদের মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মের অনেকেই আছেন। কিন্তু তারাও কেন এ বিষয়ে সোচ্চার হন না বুঝি না। আশাকরি সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে দাবি-দাওয়া উত্থাপন করবেন। এবং সেটা করবেন জরুরি ভিত্তিতে।

আমরা কথায় কথায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জন্য গর্ববোধ করি। কিন্তু সংবাদপত্রের ছুটির বেলায় এমন বৈষম্য কাঙ্খিত নয়, প্রার্থিতও নয়।

মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললেও ভিতরে ভিতরে, রগে রগে আমরা যে কত সাম্প্রদায়িক সেটা বড় বেশি স্পষ্ট হয়ে যায় এই ছুটির বিষয়টাতেই। আর সমাজের সবচেয়ে প্রগতিশীল অংশ বলে পরিচিত সংবাদপত্র জগতেই এমন সাম্প্রদায়িকতা যেন প্রদীপের নিচের কুৎসিত অন্ধকারকেই তুলে ধরে।

শেয়ার করুন: