হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকার সময় নেই আর

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী: আমি কি কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছি? বুঝতে পারি না। লিখতে গেলে হাত সরে না, বারবার পিছিয়ে যাই। কেন? তনু, মিতু,আফসানা, রিশার পর খাদিজা –  নৃশংসতার বিচারে একটার চেয়ে একটা ঘটনা এগিয়ে। কিন্তু আমার সমস্যা কী? প্রতিটি মানুষ যখন এই বর্বরতার বিরুদ্ধে সোচ্চার, সেখানে আমিই কেবল একটি শব্দও লিখতে পারি না। ব্যক্ত করতে পারি না আমার প্রতিক্রিয়া, আমার ঘৃণা , আমার ধিক্কার।

priyo-ranjini
ছবিটি রাজেশ্বরী প্রিয়রঞ্জিনীর আঁকা

তনু হত্যার খবরটা দেখার এবং জানার পর আমি আর আমি থাকলাম না। কেন জানি না, মনে মনে আমি তনুর মায়ের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালাম – ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে মেয়ের বাড়ি ফিরতে রাত হচ্ছে বলে ক্রমেই অধীর হয়ে উঠেছিলো মায়ের মন। তনুর বাবা হয়ে আমিও পাগলের মতো হাতড়ে হাতড়ে একে একে উদ্ধার করতে থাকি তনুর একপাটি ছেঁড়া জুতো, চুল.. এরপর কতগুলো অমানুষের ফেলে যাওয়া ছিন্নভিন্ন নিথর তনু। সর্বোচ্চ নিরাপত্তাবেষ্টিত এলাকায় থাকতো তনুরা। শোনা যায় রক্ষকই ভক্ষক হয়েছিলো। তনুকে ধর্ষণ এবং খুন করে বাড়ির খুব কাছেই ফেলে রেখে গিয়েছিলো ঘাতকেরা। এখনও তনুর কাজল দেয়া চোখ পথে-ঘাটে সারাক্ষণ আমাকে তাড়া করে ফেরে।

খুব ভোরে ছোট্ট বাচ্চাটিকে স্কুলে নিয়ে যাবার জন্য মিতু বের হয়েছিল। বাচ্চাটির চোখের সামনেই নিমেষে নিভিয়ে দেয়া হয় তার মিষ্টি হাসির মায়াবতী মায়ের জীবন-প্রদীপ। শুনেছি অবুঝ শিশুটি ঘাতকদের পা জড়িয়ে ধরে মায়ের প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলো। তবুও এতোটুকু ভ্রুক্ষেপ না করে খুনিরা এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সদর্পে স্থানত্যাগ করে।

এবার আমি মিতুর নাবালক সন্তান হয়ে যাই। নিজের সবটুকু শক্তি আর সামর্থ্য দিয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরি পৃথিবীর নিকৃষ্টতম এক খুনির দুই পা। তবুও বিন্দুমাত্র মায়া কিংবা করুণা জন্মেনি ওদের মধ্যে। জন্মাবে কী করে? ওদের জন্ম কী কোনো মানুষের জন্ম? হতেই পারে না। মিতুর স্নিগ্ধ হাসিমাখা মুখের ছবি আমার মনের চারটে দেয়ালে ফ্রেমবন্দী হয়ে যায় চিরদিনের জন্য। বেশ বুঝতে পারি এই হাসি আমাকে ছেড়ে সহজে যাবে না, প্রায়শই বিবেকের দরজায় কড়া নেড়ে যাবে – যতদিন বাঁচি।

মৃত আফসানাকে হাসপাতালে ফেলে পালিয়ে যায় তার প্রেমিকরূপী এক পিশাচ। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক গুটিকয়েক প্রতিবেশী বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিলেও প্রভাবশালী অপরাধী নাগালের বাইরে। আফসানার গলার গভীর দাগটা আমার মনে চিরস্থায়ী হয়ে গেঁথে যায়।

pic-1কিছুদিন পার না হতেই আরো এক জোড়া উজ্জ্বল চাহনি, দীপ্তিময় হাসি আবারো আমার সমস্ত ভাবনাকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে। সবে অষ্টম শ্রেণিতে পড়তো রিশা, চোখের সামনে বিশাল পৃথিবী। বহুদূর পথ পাড়ি দেবার কথা ছিলো তার। স্কুল থেকে ফেরার পথে এক ঘৃণ্য বেজন্মার হাতে ছুরিকাহত হয় সে। বাঁচার জন্য ওই অবস্থাতেই সে কোনোরকমে স্কুলের গেট পর্যন্ত পৌঁছুতে পেরেছিল। অথচ সে জানতো না সেখানেও কী নির্মমতা অপেক্ষা করছিল তার জন্যে!

স্কুল কর্তৃপক্ষ তাকে একটি গাড়ি দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা পর্যন্ত করেনি! খুব ইচ্ছে করে সেই দায়িত্বরত শিক্ষককে গিয়ে জিজ্ঞেস করি, তার কী নিজের কোনো সন্তান আছে? এমন অমানবিক একজন ব্যক্তি কীভাবে স্বনামধন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল থাকতে পারে?

কন্যাসম রিশার হাসপাতালের বেডে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ার কথা জেনে স্থির থাকতে পারিনি। রিশার মা হয়ে আমি তার জন্য প্রার্থনা করতে থাকি, মেয়েটি বেঁচে ফিরে আসুক মায়ের বুকে। শেষমেশ রিশা হেরে যায় মৃত্যুর কাছে। অতোটুকুন শরীরে এই মরণ আঘাত কীভাবে সয়? হয়তো বা সে এই পচে যাওয়া নপুংসক সমাজে আর ফিরে আসতেই চায়নি।

সত্যিই কী রিশা হেরে যায়, নাকি আমরা হেরে যাই রিশার মতো সন্তানদের হেসেখেলে বেড়ে উঠবার জন্য একটি বাসযোগ্য, নিরাপদ পৃথিবী তৈরি করতে না পেরে? রিশা তার মায়ের বুক খালি করে চিরতরে বিদায় নেয়। আর জন্ম-জন্মান্তরের জন্য রিশার মা হয়ে রয়ে যাই আমি।

বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। আবারো সেই প্রকাশ্য দিবালোকে নজিরবিহীন এক বীভৎসতা দেখলো মানুষ। সামাজিক মাধ্যমগুলোতে সেই বীভৎসতার ভিডিও ছড়িয়ে পড়লো। এবারের ঘটনায় আরেক বেজন্মা চাপাতি দিয়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে জখম শুধু করেনি, মাথায়, হাতে এলোপাথাড়ি কোপের শিকার কলেজছাত্রী খাদিজা এখন জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে।

লাইফ সাপোর্ট থেকে কি ফিরে আসতে পারবে সে? মৃত্যুর সাথে প্রাণপণ এ লড়াইয়ে ক্ষত-বিক্ষত খাদিজা জিততে পারবে কীনা আমি জানি না। আমি এখন নিজের সারা মাথায় খাদিজার মাথার অসংখ্য আঘাতগুলো বহন করে চলেছি। সে আঘাত এতোটাই গুরুতর যে আমি চব্বিশ ঘণ্টায় চব্বিশটা সেকেণ্ডও দুই চোখের পাতা এক করতে পারি না। যদিওবা কখনো ঘুমিয়ে পড়ি, খাদিজাকে জখম করার ভয়াবহ দৃশ্য দুঃস্বপ্ন হয়ে দেখা দেয়।

14383447_1052664924786897_876001213_n
ফুলেশ্বরী প্রিয়রঞ্জিনী

ঘুমের মধ্যে অবচেতনে আমি শিউরে উঠি, একটাই প্রশ্ন করি, “খাদিজা কি এখনো বেঁচে আছে?”….যত কাজেই ব্যস্ত হই, ঘুরেফিরে একই প্রশ্নের প্রতিধ্বনি শুনি – “খাদিজা বেঁচে আছে তো!”

মিতুর খুনিরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। গতকালই দেখলাম, পাঁচ লক্ষ টাকা  ঘোষণা করা হয়েছে মুসা নামক এক খুনিকে ধরিয়ে দেবার জন্য। কোন এক খবরে পড়েছিলাম, মিতুকে নাকি পরকীয়ার কারণে প্রাণ দিতে হয়েছে!

তনু নাকি নাটক – থিয়েটার করে বেড়াতো? স্বভাব -চরিত্রও নাকি ভালো ছিল না?

শুনেছি তনুকে কেউ হত্যা করেনি।

“নো কমেন্ট!!!

আফসানার কথা কেউ আর তেমন বলে না।

আরো শুনলাম, আফসানা নাকি ওই ছেলের সাথে লিভ টুগেদার করতো। ছিঃ! ছিঃ!  কী দরকার এসব খারাপ মেয়ের মৃত্যুরহস্য জানার?

রিশার হত্যাকারী ওবায়দুল ধরা পড়েছে। ওবায়দুল দর্জির দোকানে কাজ করতো। শিক্ষা-দীক্ষা নেই। মামা-কাকার জোর নেই।

সবাই আশা করছে বিচার হবে।

খাদিজাকে কুপিয়ে জখম করা বদরুল শিক্ষিত! সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। দলীয় পরিচয় আছে।

তাকে পুলিশে সোপর্দ করেছে ঘটনাস্থল সিলেট এম. সি. কলেজের অন্য ছাত্ররা। তার আগে যারা মোবাইলে ভিডিও ধারণ করছিলো সেই ভয়ংকরতম দৃশ্য, তারা যদি একজন এই কাজ করে বাকি জনেরা ঝাঁপিয়ে পড়তো বদরুলকে নিবৃত্ত করতে, তাহলে হয়তো বা খাদিজার জখমের মাত্রাটা কিছু কম হতো!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং কথা দিয়েছেন, বিচার হবে। আমরা আশাবাদী। কিন্তু “খাদিজা কী বেঁচে আছে?”…

দলীয় পরিচয়, শিক্ষা- অশিক্ষা সব তুচ্ছ এই সব নৃশংস, ঘৃণ্যতম অপরাধীদের “খুনি” পরিচয়ের কাছে। তবুও এদের জন্মদাতা বাবা- মাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। জানতে ইচ্ছে করে তাদের “অনুভূতি কী?” কী শিক্ষায়, কোন আদর্শে এদের বেড়ে ওঠা? কেমন মায়ের জন্ম এরা? কীভাবে জন্মাচ্ছে ওবায়দুল, বদরুলরা?

এই ভয়ংকর ঘটনাগুলো বারবার আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে, কে তনু,কে মিতু, কে রিশা আর কেই বা খাদিজা – বেজন্মাগুলোর তাতে কিছুই এসে যায় না।

কার কী পোশাক তাতেও না। ওরা শুধু জানে বিকৃত উল্লাসে রক্তের হোলি খেলতে। বারবার প্রমাণ করে যাচ্ছে, ওরা কোনো মানুষ তো নয়ই, এমনকি পুরুষ কিংবা জানোয়ারও নয় – ওরা এক বিকারগ্রস্ত নপুংসকের দল। নারীরা ওদের কাছে নিছক “মেয়ে মানুষ”।

আমাদের চারপাশে মানুষরূপী এই খুনিরা জাল পেতে আছে। এরাই পথেঘাটে ইভ টিজিং করে, এরাই ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের গায়ে স্পর্শ করে বিকৃত সুখ পায়, এরাই সাইবার ক্রাইম করে। এরাই মেয়েদের ছবি, ভিডিও নিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে, এরাই এসিড ছোঁড়ে, এরাই ধর্ষণ করে। এরাই প্রেমিক বা স্বামী সেজে প্রেমিকা বা স্ত্রীকে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। এরাই প্রেমের “প্রস্তাবে” প্রত্যাখ্যাত হলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে শান্তি পায়। এরাই চাহিদামতো যৌতুক না পেলে পিটিয়ে বা শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। এদের জন্যই ডাস্টবিন থেকে জীবিত নবজাতক  উদ্ধার হয়।

ঘরে-বাইরে, শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে, যত্রতত্র এই নরপিশাচদের আখড়া। এরা ঘাপটি মেরে আছে নতুন কোনো মিতু, তনু, রিশা বা খাদিজার প্রাণনাশের “টার্গেটে”। একের পর এক সহিংসতা, দুষ্কর্ম ঘটিয়েও এদের হিংস্র কর্মকাণ্ড কিন্তু থেমে নেই।

তাহলে আমরা কোন দৈব পরিবর্তনের আশায় হাত-পা গুটিয়ে বসে আছি? এই জঘন্য অপরাধীদের রুখে দিতে জরুরিভাবে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

মানববন্ধনের চেয়ে বেশি কার্যকর কোনো পদক্ষেপ। দেয়ালে পিঠ সেতো বহু আগেই ঠেকে গেছে। যেমন কুকুর তেমন মুগুরের ব্যবস্থা করা ছাড়া পথ দেখি না।

খাদিজার জন্য অনন্ত প্রার্থনা। খাদিজা বেঁচে উঠুক। অন্ততপক্ষে একজন খাদিজা তার জীবদ্দশায় ন্যায়বিচার পেয়ে যাক।

 

শেয়ার করুন: