সাদিয়া নাসরিন: হ্যাঁ, তোমাকেই বলছি। যে তুমি আমার পিতা, স্বামী, প্রেমিক, সন্তান, বন্ধু, সহকর্মি, সহপাঠী। কিন্তু সমস্ত পরিচয় ছাপিয়ে উঠে তোমার লৈঙ্গিক পরিচয়। আমি যতোই তোমাকে মানুষ ভাবতে চাই, তুমি ততোই একটি লিঙ্গের ভেতর আটকে থাকো। আমি যতোই তোমাকে মুক্ত করতে চাই, চেতনে-অবচেতনে তুমি তত বেশী করে জড়িয়ে যাও পুরুষতন্ত্রের চিকন জালে। লিঙ্গ রাজনীতির ফাঁদ থেকে বের হয়ে আমি যতোই তোমাকে সমতার রাজনীতির কথা বলি, ততোই তোমার পুরুষতান্ত্রিক প্রতিক্রিয়া আমাকে বিপন্ন করে।
নারীর প্রতি বঞ্চনা, বৈষম্য, নিপীড়ন আর নির্যাতনের প্রতিবাদে কথা বললে তুমি প্রতিক্রিয়াশীল আচরণ করো। তুমি খুব বিরক্ত হও যখন আমি পুরুষতন্ত্রের কাছে মাথা নত না করে, সহানুভূতি না চেয়ে নিজের অধিকার নিজেই দাবি করি। আমাকে তুমি নারীবাদী বলো। তুমি প্রচার করতে থাকো নারীবাদী মাত্রই পুরুষকে আক্রমণ করে। তুমি পৌরুষিক আক্রমণে তেড়ে আসতে আসতে বলো, নারীবাদী মানে ভুঁইফোড় চরিত্রহীন ঘর ভাঙ্গানি নারীর দল। তুমি বোকার মতো প্রশ্ন তুলো, “নারীবাদীরা কেন পুরুষের সাথে বাস করে পুরুষের সাথে কোন্দল করে?” ন্যাকামি করে তুমি এই প্রশ্নও করতে থাকো, “নারীবাদীরা পুরুষ নির্যাতন নিয়ে কথা বলে না কেন?”
আমার নারীবাদ কেন তোমার শান্তি নষ্ট করে তার কারণ আমি জানি। নারীবাদ তোমার সহানুভুতি চায় না। ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে তোমার কাছে অধিকার ভিক্ষা করে না। তুমি মহান পুরুষ দেখতে চাও, আমি নাকিকান্না কেঁদে পুরুষতন্ত্রের বিধাতার কাছে বঞ্চনার প্রতিকার চাইবো। তুমি মহানুভব আমার জন্য ছিঁটেফোটা সুযোগ (??) দিয়ে উদার বাদশা হবে।
তুমি ভাবতে চাও, তুমি আমার জন্য সম্মান আর অধিকার এনে দেবে ওই ধর্মগ্রন্থের পাতা থেকে, আর আমি তোমার মালা জপে সে অধিকার ভোগ করবো। কিন্তু তোমার সে ইচ্ছেয় গুড়েবালি দিয়ে আমার লড়াই যখন আমি নিজে করি, তুমি ক্ষুদ্ধ হও, রাগ করো। তুমি চিৎকার করে বলতে থাক, আমি কেন তোমাকে প্রতিপক্ষ ভাবি? তুমি তো সাম্যবাদী (?) পুরুষ, তবে আমি কেন তোমার দিকে আঙ্গুল তুলি? আমি কেন তোমাকে অবিশ্বাস করি?
একটু থামো, উত্তর পাবে। পরবর্তি প্রতিক্রিয়ার আগে তুমি একবার আয়নার সামনে দাঁড়াও। নিজেকে দেখো। বদরুলকে দেখতে পাও নিজের ভেতর? সিমি, পূর্ণিমা, তনু, মহিমা, শাজনীন, ইয়াসমিন, সীমা…এবং প্রতিদিন ধর্ষিত হওয়া ওই নারীদের ধর্ষণ করে কারা? আট মিনিটের ভিডিও ছড়িয়ে পাশবিক উল্লাস যারা করেছে, যারা দেখেছে, এবং যারা ভিক্টিমকে ব্লেইম করেছে, তাদের ভেতর তুমি কি আছো? পরিমল কি তুমি নও? পহেলা বৈশাখে মেয়েদের বিবস্ত্র করোনি কি তুমিও? স্কুল কলেজের সামনে শিস্ বাজানো, টিজ করা ওই বখাটের দলে ছিলে না তুমি? দিনের পর দিন শরীরে-মনে যুদ্ধ করতে করতে হেরে গিয়ে নিজেকে হত্যা করে আকতার জাহানরা কার জন্য?
যৌনপল্লিতে প্রতিরাতে কার হাত বদল হয় নারী? রাতের আঁধারে ফেলে আসা কার পৌরুষে ডাস্টবিনে কেঁদে উঠে নবজাতক? ভালোবাসার কথা বলে, কাজের কথা বলে নারী পাচার করে কারা? প্রেমিকার মুখে এসিড ছুঁড়ে মারা ওই প্রেমিক পুরুষ কি তুমি নও? চিনতে পারো রুমানা মঞ্জুরকে চিরতরে অন্ধ করে দেওয়া সাঈদকে? তোমার বাসার কাজের মেয়েটি কার বিকৃত যৌনতার শিকার হয়? শিশুদের যৌন নিপীড়ন করে কারা? নারীর পোশাক দেখে কামোত্তেজনা জাগে যে পুরুষের, সে কি তুমি নও? রাত-বিরাতে ইনবক্সে মেয়েদের উত্যক্ত করে কারা ওরা? আবার নির্যাতিত হওয়া নারীকেই দোষারোপ করে বেড়ায় কারা?

না না, তুমি তো এতো খারাপ না। তুমি ‘ওদের’ মতো নও। তুমি ধর্ষক নও, তুমি হত্যাকারি নও, তুমি নিপীড়কও নও। তবু আর একটু ভাবো। আরো একটু গভীরে। বোনের সম্পত্তি দিতে না চাওয়া ওই ভাইটি কি তুমি নও? অথবা, ব্ল্যাকমেইলিং করে বাসর ঘরেই দেনমোহর মাফ করিয়ে নেয়া সেই পুরুষ? আলাদা হয়ে যাওয়ার পর সন্তানের কাস্টডি মামলা চালিয়ে ‘মা’কে জীর্ণ-দীন করে দেওয়া সেই পুরুষ তো তুমিই! তোমার পাশের ডেস্কে কাজ করে তোমাকে টপকিয়ে যাওয়া নারী সহকর্মিটি কার নিপীড়নের শিকার হয়? তোমার যে মেয়ে বন্ধু নিজেকে বাঁধেনি কোন পুরুষের টাই এর নটে, তাকে নিয়ে আড়ালে অশ্লীল আপত্তিকর মন্তব্য কে করে? একলা নারীমাত্রই ‘গণিমতের মাল’ তুমিও কি ভাবোনা?
আমি জানি, তুমি অনেক সচেতন। নারীকে সম্মান করো তুমি। কিন্তু তুমিও কি নিজেকে নারীর রক্ষক, বাহক ভাবো না? “বাজার দরের খোরপোষ” এর আধিপত্য আর সংসারে শান্তি(??) বজায় রাখার জন্য তোমার স্ত্রী’র চাকরি বা ব্যবসাটা ছেড়ে দিতে হয়নি? স্ত্রীকে শস্যক্ষেত্র মনে করে যখন খুশি চাষ করতে যাও না তুমি? স্ত্রী পেশাগত জীবনে উন্নতি করছে, অথচ তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করোনি? রোজ ভোরে উঠে এবং অফিস থেকে ফিরে যখন স্ত্রী নামক প্রজাতিটি চুলা-বাচ্চা-স্বামী সামলাতে গিয়ে চোখে সর্ষে ফুল দেখে তখন সে সর্ষের তেলে মুড়ি খেতে চাওয়া প্রাণীটি কি তুমি নও?
হয়েছে, অনেক ভেবেছো। এবার নিজেকে যাচাই করো। নিজের নিক্তি পাল্লায় মাপো নিজের অবস্থান। তুমি নিজেই বুঝে নাও, তুমি লিঙ্গ রাজনীতির তলায় পড়ে থাকা “পুরুষ”, নাকি পুরুষতন্ত্রকে জয় করা ‘মানুষ’।
যদি তুমি নিজেকে খুঁজে পাও, একজন ‘মানুষ’ হিসেবে, তবে তোমাকে অভিবাদন বন্ধু! আমি জানি, নারী–পুরুষের বিভেদ ঘুচানোর এই লড়াইয়ে তুমিও আমার সহযোদ্ধা। যদি তুমি মানুষের অধিকারে বিশ্বাস করো, তবে তোমাকে আমি নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার একজন সৈনিক হিসেবেই জানি। যদি তুমি নারী নিপীড়নকারী না হও, তবে বিশ্বের যেকোনো প্রান্তে যেকোনো নারী নিপীড়নের প্রতিবাদ তোমার বিবমিষার কারণ হবে না।
যদি তুমি হও, কেবলই পুরুষতন্ত্রের শিকার ‘পুরুষ’, তবে তোমার জন্য আমার দুই মিনিট নীরবতা আর সমবেদনা। আর যদি তুমি হও পুরুষতন্ত্রের প্রমোটর, তবে তুমি আমার প্রতিপক্ষ তো বটেই। তোমার সাথে লড়াই আমার লিঙ্গের নয়, যোগ্যতার। জন্মসূত্রে পাওয়া এক লিঙ্গের জোরে তুমি যতদিন নিজেকে প্রথম আর আমাকে দ্বিতীয় লিঙ্গ ভাবতে থাকবে, ততদিন ওই লিঙ্গ বিভেদকে চ্যালেঞ্জ করে তোমাকে মানুষ বানানোর লড়াই করে যাবো।
এবার চলো মুখোমুখি দাঁড়াই। তুমি যতদিন পুরুষ হয়ে নারীকে শোষণ করবে,আমি মানুষ হয়েই তোমাকে মোকাবেলা করবো। তুমি যত নিয়ন্ত্রণ করবে আমাকে, তোমাকে তত বেশী করে স্বাধীনতা শেখাবো আমি। তুমি যতদিন নারীকে দমন করবে, ততদিন আমি তোমাকে মানুষের শক্তি দেখাবো। যতোবার তুমি নারীর বঞ্চনাকে উপহাস করবে, ততোবার আমি মানুষ হয়ে শাবল চালাবো পুরুষতন্ত্রের বুকে।
ঘর ভাঙবে? ভাঙ্গুক। ঘর ভেঙ্গে পুরুষ বের হয়ে মানুষ এসে ঢুকুক। ভেঙ্গে চুরে ধংসাবশেষ থেকে গড়ে উঠুক নতুন সভ্যতা। যেখানে তুমি লিঙ্গ রাজনীতির চোরাগলি চিনতে পারবে, মানুষের সভ্যতা গড়তে শিখবে। তোমার আমার সমতার পথ হবে সেদিন। একদিন সেইদিন আসবে। যেদিন লিঙ্গ তোমাকে নিয়ন্ত্রণ করবে না, তুমি লিঙ্গকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
সেদিন দেখা হবে বন্ধু!
লেখক: প্রধান নির্বাহী, সংযোগ বাংলাদেশ