পুরুষকে আলোর পথে আনার প্রকল্প

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা: অনেক চ্যালেঞ্জ ও বাধা-বিপত্তিকে অতিক্রম করে বাংলাদেশের নারীদের আত্মবিশ্বাস ও অগ্রগতির ধারা দৃশ্যমান। এ ধরনের কথা বেশি শুনতে পাই সুশীল ও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিসরে। যারা সমাজ নিয়ে ভাবে, সাহিত্য-সংস্কৃতির চর্চা করে, পত্রিকা পড়ে, টেলিভিশন টকশোতে কথা বলে তাদের অনেক আলোচনার বিষয়ের মাঝে নারী অধিকারও একটি বিষয়।

নারী অধিকার নিয়ে এই যে সচেতনতা তাতে নারীর প্রতি সহিংসতা কতটা কমেছে তা বোঝা কঠিন। আমাদের সমাজচিন্তায় লিঙ্গ বিভেদের বিষয়টি যে আলোচিত হয়, তার নানা দিক আছে। বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি, প্রকাশনা, সেমিনার, গবেষণা চলছে। সিনেমা, নাটক, গান তথা সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নারী অধিকারের বিষয়টি উঠে আসছে অনেকদিন ধরে।

reza-bhai-2রাজনীতিবিদরা বলে, প্রশাসনিক কর্তারাও বলে। ধর্মীয় পরিসরেও বিষয়টির ব্যাপক উপস্থিতি। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের প্রভাব কোন কিছুই কমাতে পারছে না। বরং তার একটা হিংস্র প্রদর্শন দেখে চলেছে সমাজ। তাহলে ভাবনার বিষয় হলো, কোথাও কি কোন ভুল আছে? সেই ভুল কোথায়, তারও একটি গবেষণা হতে পারে।

আগের চেয়ে অনেক বেশি নারী এবং অনেক বেশি পুরুষও আন্দোলনে শরিক হচ্ছেন, নারী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা শহর ও গ্রামে ছুটাছুটি করছেন, নির্যাতিতার পাশে দাঁড়াচ্ছেন। আগের চেয়ে মামলার হার বেড়েছে, নির্যাতক পুরুষকে কাঠগড়ায় যেতে হচ্ছে। নারী আধিকার চর্চা, নারীকে নিয়ে সমাজচিন্তার গুরুত্ব বাড়ছে।

কিন্তু কার কাছে বাড়ছে এই গুরুত্ব? এই চর্চা কি আদৌ পুরুষের চিন্তায় কোন ছাপ ফেলতে পারছে? বিষয়টা কি শুধুই লেখালেখি, সেমিনার, ফেসবুকে, অনলাইনে সক্রিয়তার মাঝে থেকে যাচ্ছে, নাকি কিছু ইতিবাচক কাজও হচ্ছে? অনেক প্রশ্ন, উত্তর কোথায়?   

শিক্ষিত, সজ্জন মানুষ আমাকে প্রশ্ন করে, “আপনার স্ত্রী চাকুরী করেন? কেন? অসুবিধা হয় না? সংসার চলে কি করে”? আমার একটিই কন্যা সন্তান, একথা জানার পর খুব আধুনিক পুরুষও, এমনি দু’একজন নারীও প্রশ্ন করেন, ছেলে সন্তান নেয়ার চেষ্টা করেননি?   

একজন আমার বন্ধু তালিকায় আছেন, লেখাপড়া করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিদেশি ডিগ্রীও আছে তার। সম্প্রতি সেই মানুষের এক ফেসবুক স্ট্যাটাস দেখে উপরের প্রশ্নগুলো মাথায় এলো। তিনি নারী পোশাক নিয়ে লিখেছেন, মেয়েরা চাকুরীতে আসায় নাকি পুরুষরা বেকার থাকছে, একজন পুরুষের আয়ে নাকি সংসার চলে, আর নারীরা নাকি শুধু নিজের জন্য খরচ করে।

একথাও লিখেছেন যে, নারীবাদী হয় সেইসব মেয়ে, যারা সংসারে অসুখী। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম কত লাইক, কত সমর্থন।

শিক্ষিত পুরুষের এমন ধারণা এবং দ্বিধাহীনভাবে তা প্রকাশ করা, আবার তাকে সমর্থন করা চিন্তা করতে শেখায়। আমাদের শহুরে, মধ্যবিত্ত, উচ্চশিক্ষিত সমাজেই যদি এ অবস্থা হয়, তাহলে প্রান্তিক পর্যায়ে কি পরিস্থিতি বিরাজমান?

নারী অধিকার চর্চা বা নারীবাদ যদি একট প্রকল্প হিসেবে ভাবি তাহলে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া জটিল এবং দীর্ঘ। পুরুষ এখনো মানুষ হয়নি, এখনো সে নিতান্ত পুরুষই থেকে গেলো বলে তাকে সরিয়ে রাখাটাও আবার একপেশে লিঙ্গ ভাবনা। সরলীকরণের পথে চললে প্রকল্পকে নিয়ে এগিয়ে যাওয়াটা কঠিন। পুরুষতন্ত্র নারী-পুরুষের বিভাজন তৈরি করেছে।

নারীবাদও কি তাই করবে? উত্তর অবশ্যই না। পুরুষ করেছে, তাই সেই কাজ আমিও করবো গোছের ধারণা সহজ সমীকরণ। প্রকল্পে পুরুষকে নেয়াই যাবে না, কারণ পুরুষের শুধু আছে লোলুপ দৃষ্টি, ধর্ষকের মন, ভোগের চাহিদা, এমন ভাবনা নিয়ে এগোলে সেই বিভাজনকেই এগিয়ে নেয়া হয়। নারী অধিকারের বিষয়টা নিয়ে নতুন করে চিন্তা করার সময় এখন।

নারী বদলে যাচ্ছে, বদলে যাওয়ার লড়াইয়ে আছে। কিন্তু পুরুষ একই জায়গায় রয়ে যাচ্ছে। তাইতো সরকারি জরিপেই জানা যায় নিজ গৃহে ৮০ ভাগ নারী নির্যাতিতা। লড়াইয়ের ময়দানে চোখ রাঙানো, শায়েস্তা করা, বা শাস্তি দেয়া সবই সম্ভব। কিন্তু পুরুষকে আলোর পথে আনার কাজটি কে করবে? বা কবে করা হবে? অন্ধকার থেকে আলোর পথে পুরুষকে আনার একটা প্রকল্প দরকার।  

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, সংবাদ কর্মী  

 

শেয়ার করুন: