তামান্না ইসলাম: কয়েকদিন আগেই উইমেন চ্যাপ্টারে লিখেছিলাম ‘লাথি না খাওয়া পর্যন্ত পড়ে থাকবে কেন মেয়ে তুমি? ‘ এই লেখার তথ্য নির্ভর প্রমাণ পেলাম ‘প্রথম আলোতে’ প্রকাশিত এক সাম্প্রতিক সার্ভেতে। বিবিএসএর এক জরিপের ফলাফলে দেখা গেছে, বাংলাদেশের বিবাহিত নারীদের মধ্যে ৮০% ভাগ নির্যাতনের শিকার, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই স্বামী দ্বারা।
খবরটি দেখে প্রথম যে প্রশ্নটি আমার মাথায় এসেছে সেটা হলো, জরিপটি কী গ্রামে করা হয়েছে, নাকি শহরে? শিক্ষিত মেয়েদের মাঝে, নাকি অল্প শিক্ষিত, অশিক্ষিত মেয়েদের মাঝে? পুরোটা পড়ে যা বুঝলাম, গ্রামের মেয়েরা তুলনামূলক ভাবে বেশী নির্যাতিত (৭৪% এর উপরে), শহরে যেটা ৫৪% এর মতো। এমনটাই তো হওয়ার কথা। আমি হলপ করে বলতে পারি, ওই ৭৪% মেয়েও নির্যাতন বলতে বোঝায়, স্বামী ভাত দেয় না, বা বেধড়ক মারে, বড়জোর বাপের বাড়ি যেতে দেয় না। জীবনের কাছে এতোটুকুই তাদের চাহিদা। কাজের বিনিময়ে খাদ্য আর বিবাহিত খেতাবে ভূষিত হওয়ার যে আজীবন চুক্তি তারা মনে মনে ‘কবুল’ করে এসেছে, ওইটুকুই তাদের স্বপ্ন। দু’একটা চড়-থাপ্পড় তো কোনো ব্যাপারই না।
গ্রামের এই মেয়েগুলোর চিন্তা-ভাবনা যদি আরেকটু শিক্ষার আলো পেতো তাহলে নির্যাতিতের হার আরও বাড়তো, কারণ তারা তাহলে বুঝতে পারতো, শুধু গায়ে হাত তোলাই নির্যাতন নয়।
প্রশ্ন হলো, এই নির্যাতিতারা কি করছে নিজেদেরকে রক্ষা করতে? এই ৮০% ভাগ নারীর মধ্যে মাত্র ১% আইনের সাহায্য নেয়, ২৯% ভাগ কাছের পরিবারকে জানায়। তার মানে ৫০% নারী নির্যাতনকে জীবনের অংশ বা নিয়তি মেনে নিয়ে অথবা ভয়ে মুখই খুলছে না। নীরবে এই নির্যাতন সহ্য করে যাচ্ছে।
যে ২৯% সাহস করে বা সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে যেয়ে মুখ খুলছে, তার মধ্যে ২৮% এর পাশেই কেউ এসে দাঁড়াচ্ছে না। শুধু তাই নয়, তাদেরকে সাপোর্ট না করে বরং জোর করে বা উল্টো-পাল্টা বুঝিয়ে তাদের মুখ আবার বন্ধ করে দিচ্ছে, ঠেলে দিচ্ছে সেই একই ভয়াবহ জীবনে।
নির্যাতিতদের একটা বড় অংশ (৪৫%) বলেছে, তারা শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়, এমনকি অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায়ও। অনেকক্ষেত্রেই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তাদেরকে চিকিৎসা পর্যন্ত নিতে হয়েছে।
আমি নিজে দেখেছি আমাদের বাসার এক গৃহকর্মীকে, যার প্রাক্তন স্বামী তার আঙ্গুল ভেঙ্গে দিয়েছে, কানের একটা অংশ ছিঁড়ে ফেলেছে। নির্যাতিতাদের আরেকটি বড় অংশ প্রায় ৪০% বলেছে তারা অর্থনৈতিকভাবে নির্যাতিত। তবে সবচেয়ে যেটা মূল নির্যাতন, সেটার কারণ হিসাবে দেখা গেছে, নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ, প্রায় ৭০% ভাগ নারীই এর শিকার। আমি বলবো, এটা একটা শুভ লক্ষণ, যে অন্তত আমাদের দেশের মেয়েরা এটা বুঝতে পারছে যে নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণটা বিবাহিত জীবনে একটা নির্যাতন। তবে সংখ্যাটা বেশ আশঙ্কাজনক। এটা যে নির্যাতন, শুধু এটা বুঝে বসে থাকলে তো আর হবে না। এর কারণ খুঁজে বের করতে হবে এবং কীভাবে এটা প্রতিহত করা যায় সেটাও ভাবতে হবে।
এই নিয়ন্ত্রণ পুরুষরা পায় কোথা থেকে? কেবল কী বাঙ্গালি পুরুষরাই এই আচরণ করে? না, কেবল বাঙ্গালি পুরুষরাই স্ত্রীকে নিয়ন্ত্রণ করে না। আসলে এমনকি শুধু পুরুষরাও নিয়ন্ত্রণ করতে পারতো না। অর্থনৈতিক ক্ষমতা যার হাতে সেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে যদি চায় এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাবানরা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। আজ যদি অর্থনৈতিক ক্ষমতা থাকতো পৃথিবীর সব মেয়েদের হাতে, সেই সাথে বাহুবল, কে জানে হয়তো মেয়েরাও নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতো।
তাই বাহুবল না হোক, মেয়েদের অন্তত মনোবল বাড়াতে হবে আর সবচেয়ে জরুরি অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা অর্জন।
কিছুদিন আগেই আমার এক আমেরিকান দম্পতির সাথে পরিচয় হয়েছে। স্বামী, স্ত্রী আর দুই বাচ্চা। বাবা, মা দুজনেই চাকরি করতো। প্রথম সন্তানের জন্মের পর মা চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। এখন বাবা একাই চাকরি করে সংসার চালায়। আমেরিকান পরিবারগুলোকে সবসময় খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয় না। এই পরিবারটিকে দেখেছি।
না, ভদ্রলোক তার বউকে পেটায় না। কিন্তু তারপরেও কোথায় যেন একটা তাচ্ছিল্য আছে। বাচ্চা দুটোর সমস্ত দেখাশোনা মহিলা একা করে। ঘরের সব কাজ তো বটেই। তারপরেও সন্তানরা তাকে প্রাপ্য সম্মান করে না, তারা কিছুটা ক্ষুব্ধ। কারণ “মা তো বাবার ঘাড়ে বসে বসে খাচ্ছে, সংসারের বোঝা।” একজন শিক্ষিত, শারীরিক, মানসিকভাবে সক্ষম নারীর এতোটুকু আত্মসম্মান বোধ থাকা উচিত যে আমি কারো বোঝা হবো না।
ছেলেমেয়েরা কিন্তু এই ধারণটা পায় তাদের বাবার কাছ থেকেই। যদি তার স্বামী এবং পরিবার তার সংসারের কাজটাকে ছোট করে না দেখতো, এবং যথাযথ সম্মান দিত, তাহলে ব্যাপারটা হতো আদর্শ সংসার। কিন্তু আদর্শ বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। ব্যাঙ্কে মাস শেষে যার নামে টাকা আসে, সেই ক্ষমতাবান, পরিবারের মাথা। সে আমেরিকানই হোক, আর ব্রিটিশই হোক।
আমেরিকান এই দম্পতির জীবন মিলে যায় আমাদের অসংখ্য বাঙ্গালি পরিবারের সাথে। অল্প শিক্ষিত, উচ্চ শিক্কিত কোন ব্যপার না। বিয়ের পরে সংসারের দায়িত্ব অটোমেটিক চলে আসে মেয়েদের ঘাড়ে। সেই দায়িত্ব সামলাতে গিয়ে মেয়েটি যদি বাইরে উপার্জন করতে না পারে, তাহলেই সে হয়ে যায় ‘সংসারের বোঝা, বসে খাওয়া মানুষ।’
সংসারের কাজের জন্য, রান্না করা, ঘর পরিষ্কার করা, বাচ্চাদের দেখাশোনা করা, পড়ালেখা করানো, স্কুলে আনা-নেওয়া করা, এগুলোর জন্য কোনো মা কিন্তু কোনো বেতন পান না। কোনো দেশেই পান না। কিন্তু অর্থ উপার্জনের চেয়ে এই কাজগুলো কোন অংশে কম কঠিন নয়, শারীরিকভাবেও নয়, মানসিকভাবেও নয়। কিন্তু এসবের কোনো স্বীকৃতি নেই।
বলছি না যে কোনো পরিবারেই নেই। হয়তো আছে কিছু কিছু পরিবারে, কিন্তু অর্থ উপার্জনের ধারে কাছেও তার সম্মান বা স্বীকৃতি না। আসলে অগণিত শিক্ষিত ছেলেরাও কাজ শেষে বাড়ি ফিরে বউর কাছে সেবা আশা করে, কারণ তাদের ধারণা বউ তো সারাদিন ঘরেই ছিল, কোনো কাজ করে নাই। আমি বুয়েটের মতো জায়গা থেকে পাশ করা মেয়েকেও ঘরে বসে সংসার করতে দেখেছি স্বামীর কাছে উপার্জনের কারণে মাথা হেঁট করে।
কিন্তু কেন এই মাথা হেঁট করা? সংসার তো কোন যুদ্ধ ক্ষেত্র না যে একজনকে হারতে হবে, আরেকজনকে জিততে হবে। একজন আরেকজনকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে কেন? বিয়ের পরে একজন শিক্ষিত মেয়ে আর ছেলে এই বোঝাপড়ায় আসতে পারে না কেন যে সংসারের সব দায়িত্ব দুজনের।
মেয়েদের এ ব্যাপারে গলায় জোর বাড়াতে হবে অনেক বেশি। এই অধিকারটা আদায় করা সহজ কাজ না জানি, কিন্তু আদায় করা সম্ভব বলে আমি বিশ্বাস করি। নিজ সংসারে এই অধিকার প্রতিষ্ঠা না করতে পারলে সারাজীবন স্বামীর হাতের খেলনা হয়েই থাকতে হবে। শিক্ষিত মেয়েরা এ ব্যাপারে সিরিয়াস হলে, অর্থনৈতিক মুক্তি সম্ভব, নিয়ন্ত্রণ ব্যাপারটাও সাথে সাথে কমে যেতে বাধ্য।
কিন্তু তার পরেও কথা থেকে যায়। শিক্ষিত মেয়ে। শুধু পুঁথিগত শিক্ষা না। সার্টিফিকেট দরকার আছে অবশ্যই, সেই সাথে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনও দরকার আছে। এ কারণেই গ্রামাঞ্চলে নির্যাতনের হার শহর থেকে ২০% বেশী। শিক্ষার অভাব এবং যথার্থ শিক্ষার অভাব। শিক্ষার কোন বিকল্প নাই।
মেয়েরা, প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হও, যে শিক্ষা তোমাকে আত্মবিশ্বাস দেবে, মনোবল বাড়াবে, আত্মসম্মান বোধ বাড়াবে, রুটি-রুজির হাতিয়ার দেবে আর সেই সাথে তোমার নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাবে নিজের হাতে। জেনে রেখো, তুমি কারো হাতের খেলনা নও।