পুরুষতন্ত্রের পতাকাবাহী মেয়েরা, শোনো

নির্ঝর রুথ: পুরুষতন্ত্র মেয়েদের কখনো পুরুষের সমান যোগ্য বলে ভাবে না, যথাযোগ্য সম্মান করে না। উপরন্তু বেশিরভাগ মেয়ের মাথায়ই বপন করে দেয় পুরুষতান্ত্রিক ধারণা। ফলে মেয়েগুলোকে যখন বলা হয়, “বিয়ের পর তুমি লেখাপড়া করতে পারবে না, চাকরি চালাতে পারবে না, এক বছরের মধ্যে বাচ্চা নিতে হবে, প্রতিদিন দশ পদ রান্না করতে হবে”, তখন মেয়েরা মনের কষ্ট মনে চেপে রেখে অপরপক্ষের চাহিদাগুলো মেনে নেয়।

Fruits of Bandit Queens-Nazia Andaleeb Preemaনেয় কারণ অপরপক্ষ হলো তার জামাই তথা পুরুষের পক্ষ। ঐ পক্ষের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো সাহস আমাদের বাঙালি সমাজের বেশিরভাগ মেয়েপক্ষের বাবা-মায়েরই এখনো হয়নি। আর বাবা-মায়েরাও তাদের কন্যাকে তৈরি করেন এমন করে, যে কিনা এসব কথাকে ‘অন্যায় দাবী’ হিসেবেই ভাবতে শেখেনি। সে ছোটবেলা থেকে পুতুল দিয়ে খেলতে খেলতে এই-ই শিখেছে যে, একদিন তার একটা সংসার হবে, সেখানে রাজপুত্র হয়ে তার জামাই আসবে, রাজপুত্র তাকে ভালোবাসবে, এবং একদিন কোল জুড়ে আসবে ফুটফুটে শিশু। আহ্ কী সুখের সংসার! অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে বাস করিতে লাগিবে।

কিন্তু বাস্তবে কী দেখা যায়, সেটা আমার সবাই জানি। একদিন মেয়েটার একটা সংসার হয়, ভিলেন হিসেবে ছেলেপক্ষ আসে, সবাই মেয়েটাকে হেনস্তা করতে এক পায়ে খাড়া হয়, এবং বাচ্চা হওয়ার পর মেয়েটার জীবন হয়ে উঠে আরও দুর্বিষহ। হ্যাঁ জানি, সবার জীবনে এমনটা ঘটে না। প্রেমের বিয়ের কথা বাদ দিলে (কারণ সেখানে একটু হলেও দুই পক্ষের মধ্যে বোঝাপড়া থাকে) বাকি থাকে যে এরেঞ্জড ম্যারেজগুলো, সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যে এই কাহিনীগুলো ঘুরে-ফিরে দেখতে হয়, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ আছে?

আমার বেশ ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু পাক্কা দুই বছর পর আমার সাথে যোগাযোগ করেছে। মেয়েটা সুন্দরী ছিল, সাথে ভীষণ পর্দানশীনও। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সময়ই মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়া হয় মিডল ইস্টে চাকরিরত এক ছেলের সাথে। যদিও বন্ধু অনার্স শেষ করে বিয়ে করার পক্ষে ছিল, তবুও পুরান ঢাকার রক্ষণশীল এবং মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হওয়ায় নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নিজে নেবে – এমন পরিস্থিতি ওর ছিল না।

তবে আমাকে যেটা সবচেয়ে বেশি বিস্মিত করেছিলো সেটা হল, ওর বিয়ে হয়েছিলো টেলিফোন আর ভিডিও চ্যাটের মাধ্যমে! আমি এখনও ভাবতে পারি না, বিয়ের মতো এতো নাজুক আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এভাবে সম্পন্ন হতে পারে!

বিয়ের আগে ছেলে-মেয়ে কেউ কাউকে দেখেনি, শুধু কথা বলেছে। আমি ভাবি, কী পরিমাণ তাড়াহুড়ার মধ্যে থাকলে ছেলের দেশে আসা পর্যন্ত বাপ-মা অপেক্ষা করতে রাজী হয় না? কেন মেয়েকে নিজের বাসা থেকে তাড়ানোর জন্য এতো অধীরতা? কেন মেয়েকে বোঝা মনে করা? তবুও মেয়েটা নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখেছিলো, জামাইয়ের পরিবারের সাথে মিলেমিশে থাকতে চেয়েছিলো।

ফোনের মাধ্যমে বিয়ে হওয়ার কয়েক মাস পর ছেলে দেশে এলো। তার কয়েকমাস পর আমরা শুনলাম, বন্ধু প্রেগন্যান্ট। ছেলে বিদেশে ফেরত যাওয়ার পর থেকে শুরু হল ঝামেলা। ভেতরকার খবর এতকিছু জানি না, তবে শ্বশুরবাড়িতে যে আমার বন্ধু সুখে ছিল না, এটা প্রায়ই বলতো। ননদ, জা, শ্বশুর, শাশুড়ি কেউই তাকে মানসিক নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই দেয়নি। কারণ সে বিয়ের সময় তেমন কোনো জিনিসপত্র “উপহার স্বরূপ” নিয়ে আসেনি।

আমার বন্ধু শ্বশুরবাড়িতে টিকতে না পেরে নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছিলো। দোহাই দিয়েছিলো লেখাপড়ার। বলেছিলো, নিজের বাসা থেকে কলেজ কাছে হওয়ায় যাওয়া-আসার সুবিধা হবে। তাছাড়া এখানে থাকলে মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনাও করা যাবে। বলা বাহুল্য, জামাইয়ের পরিবার মনঃক্ষুণ্ণ হলেও বন্ধুর জিদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলো। আর সবচেয়ে বড় পরিতাপ হল, বন্ধুর জামাইও বন্ধুকে বুঝতে চাইতো না। সবসময় পরিবারের পক্ষ নিত। সে বিদেশে বসে কীভাবেই বা প্রকৃত পরিস্থিতি আঁচ করতে পারবে? তাই নিজের পরিবারের কথা বিশ্বাস করাকেই ধরে নিয়েছিলো সহজ সমাধান হিসেবে।

বিয়ের এক বছরের মধ্যেই ফুটফুটে একটা মেয়ের মা হয়ে গেলো আমার বন্ধু। আমি ভেবেছিলাম, সন্তান হওয়ার পর বুঝি ছেলের মন পরিবর্তিত হয়ে বৌয়ের দিকে আসবে! কিন্তু কীসের কী? পরের বছর ছেলে বিদেশ থেকে এলো “হেপাটাইটিস সি” ভাইরাস নিয়ে। ডাক্তার বলে দিলেন, আর কখনও বাচ্চা না নিতে। আমি কিছুতেই বুঝে পাই না, কীভাবে বাবা-মা পারেন সুন্দরী হওয়ার “দোষে” মেয়েকে এভাবে অনিশ্চিত আর অসুখী জীবনের দিকে ঠেলে দিতে। যে সমাজের ভয়ে বাপ-মা এই কাজ করেছিলেন, সে সমাজ কি মেয়ের দুঃখের সময় তার পাশে ছিল? অবশ্যই না।

পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানুষ বিয়ের আগে যেমন বলেছে, “এতো জোয়ান মেয়েকে এখনও বিয়ে দেন নাই?”, তারাই বিয়ের পর মেয়ের কষ্ট দেখে বলেছে, “মেয়েই খারাপ। মানিয়ে নিতে পারছে না শ্বশুরবাড়ির সাথে।” আর এই জঘণ্য সমাজের মনরক্ষা করে চলার জন্য বাবা-মায়ের চিন্তার শেষ নাই!

মাস্টার্স পর্যন্ত আসতে আসতে বন্ধুর বিবাহিত জীবন নরক হয়ে গেলো। ছেলে ‘বাবা’ হিসেবে কোনো দায়িত্ব পালন করে না, শ্বশুরবাড়ি “নাতনি” হওয়াতে খুশি নয়, ছেলে বৌকে টাকাপয়সা দেয় না, দেশে এলে নিজের বাড়িতে থাকে, বৌয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসে না। মোট কথা, দুই পরিবারের মধ্যে বেয়াই-বেয়াইন ধরনের কোনো সম্পর্কই নেই।

এই পরিস্থিতির মধ্যে বন্ধু মাস্টার্স পাশ করলো। আমাদের দুজনের পথ দুটি দিকে বেঁকে গেলো। আমি চাকরিতে ঢুকলাম, আর বন্ধু চাকরি খুঁজতে শুরু করলো। মাঝে-মধ্যে ফোনে যোগাযোগ হতো আর শুনতাম, “জামাই ফোন দেয় না বিদেশ থেকে। আমার মেয়ের ভরণপোষণ আমাকেই করতে হবে।”

এর কিছুদিন পর হঠাৎ করে বন্ধু একেবারে লাপাত্তা! ফোন করলে ফোন ধরে না, ফেসবুকে নক করলে মেসেজ “সিন” হয় না। আরও কিছুদিন পর থেকে ফোন নাম্বারটাই বন্ধ পেলাম। ওর বাসার কারও নাম্বার আমার কাছে ছিল না। তাই টানা দুই বছর মোটামুটি অন্ধকারেই ছিলাম ওর ব্যাপারে। কোথায় আছে, কী করছে, কিছুই জানি না।

হঠাৎ করে কিছুদিন আগে সে যোগাযোগ করলো ফেসবুকে। জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছিলো। বললো, ডিভোর্স নিয়ে বেশ ঝামেলায় ছিলো। টাকা-পয়সা, জমিজমা নিয়েও শ্বশুরবাড়ির সাথে ঝামেলা চলছিলো। ফলে সবার কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলো। ভালো একটা চাকরি পাচ্ছিলো না কোথাও… যাতে নিজের আর মেয়েটার জীবন নির্বিঘ্নে কাটাতে পারে। তবু মন্দের ভালো, বন্ধুর বাবা-মা এবং ভাইয়েরা তাকে ফেলে দেন নাই। ডিভোর্স নিতে সাহায্য করেছেন, এবং এখন বন্ধু আর তার সাত বছরের মেয়েকে তাদের সাথেই রেখেছেন। তবে এটাও মেয়েটা জানে, মা-বাবা তাকে আগের মতো আর স্বাভাবিকভাবে দেখেন না। শত হলেও যে মেয়েকে তারা বিদায় দিতে চেয়েছিলেন, সে ফিরে এসেছে ডিভোর্সি হয়ে, আরেকটা বাড়তি মুখ সাথে নিয়ে।

প্রচণ্ড হতাশ হয়ে আমার বন্ধু খালি কান্নাকাটি করতো। ভাবতো এই জীবনে তাকে দিয়ে আর কিছুই হবে না। কিন্তু নিজের জন্য না হলেও, মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তাকে আবার শক্ত হতে হয়েছে। আগে পুরান ঢাকায় থাকলেও, নতুনভাবে জীবন শুরু করার উদ্দেশ্যে পুরো পরিবার চলে এসেছে নতুন ঢাকায়। বন্ধুর কথা মতো, “আমার জীবনে ঘটা কোনো ঘটনাই যেন আমার মেয়ের জীবনে আঁচড় না ফেলে। ঐ পরিবেশে থাকলে মানুষের কথা শুনতে শুনতে আমার মেয়ের জীবনটা নষ্ট হয়ে যেতো। তাই ওকে নতুন পরিবেশে নিয়ে এলাম, যেখানে কেউ আমার ঘটনা জানে না।”

nirjhar-ruth
নির্ঝর রুথ

আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে বন্ধুর সংগ্রামের কথা শুনি। ভাবি, কী হলো মেয়েকে বিদেশে অবস্থানরত “যোগ্য” ছেলের সাথে বিয়ে দিয়ে? কী হলো পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজের মানুষের কথা বন্ধ করার জন্য মেয়েকে বিয়ে দিয়ে? সমাজ কটু কথা বলা ছাড়া আর কী করেছে মেয়েটার জন্য? যে ছেলে বৌ আর বাচ্চার প্রতি দায়িত্ব পালন করলো না, তাকে সমাজ দোষ দিলো না। কারণ সে ছেলে। তার কোনোই ঠেকা পড়েনি বন্ধুর সাথে মানিয়ে নিতে।

বন্ধুই অসভ্য, অশ্লীল চরিত্রের মেয়ে যে শ্বশুরবাড়ির আচরণ মুখ বুজে মেনে নেয়নি। মানিয়ে নেয়নি অপরপক্ষের কুরুচিপূর্ণ স্বভাবের সাথে। একটা মেয়ের এমনটা করা মানায়, বলুন? মেয়েরা চড় খাবে, রা কাড়বে না। চড় খেয়ে না কাঁদলেও সমস্যা। কেঁদে বুক ভাসিয়ে প্রমাণ করতে হবে, সে অথর্ব। জামাই ছাড়া তার গতি নেই। জামাই যেন দয়া করে তাকে ফেলে চলে না যায়। অথচ এই কদর্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজের জন্যই বাবা-মায়েরা এতোটা দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত! নিজেদের মানসম্মান বজায় রাখার জন্য তারা “ভদ্র বয়সে” মেয়ের বিয়ে দিতে চান। কিন্তু দিয়ে মেয়েটার জীবনটাই কি ছারখার করে দেন না?  

হ্যালো মেয়ে, তুমি সমস্ত অন্যায় মেনে নেবে, আর ভাববে পুরুষ একদিন তোমার দুঃখ বুঝে সেটা দূর করার জন্য বলবে, “থাক, তুমি লেখাপড়া কর, চাকরি চালিয়ে যাও, বাচ্চা তোমার সুবিধামত সময়ে নিও, রান্নায় আমিও তোমাকে সাহায্য করবো”? কান খুলে শুনে রাখো, এমনটা হবে না কোনোদিন। তুমি প্রতিবাদ না করে সব মেনে নেবে আর ভাববে পুরুষ তোমাকে দাবিয়ে রাখার সুযোগ নেবে না, তাই কি হয়? ‘শক্তের ভক্ত নরমের যম’ প্রবাদটা শোননি?

কী বোকা তুমি, মেয়ে! তুমি কি ভাবো, গৃহিণী হওয়াটা খুব সম্মানজনক? এটা ভেবে তোমার মনে সন্তুষ্টি আসে? তাহলে তুমি আসলেই বোকা। গৃহিণীর কাজটা কোনদিক দিয়ে মেয়েদের স্বনির্ভর করছে? কোনদিক দিয়ে তোমাকে বেতন দিচ্ছে? জামাইয়ের টাকা খরচ করছ, আর ভাবছ, “মেয়ে হয়েছি, বাচ্চা পালন করার জন্য ঘরে বসে থাকায় তো কোনো অসুবিধা দেখছি না!” তাই? তাহলে তুমি চাকরি করে তোমার জামাইকে ঘরে বসিয়ে রাখো না! দেখি, সে কেমন করে খুশি মনে বাচ্চা পালে? বাচ্চা তো তারও, নাকি? ছিঃ ছিঃ বলে জিভ কেটে ভাবছো নাকি, “এ আবার কেমন পুরুষ, যে বাসায় বসে বাচ্চা পালে? পৌরুষ থাকলে সে টাকা উপার্জন করে বৌ বাচ্চাকে খাওয়াবে।”

তাহলে কি বলতে চাও, “নারীত্ব” মানে বাচ্চার জন্ম দিয়ে ঘর সংসার সামলানো? তুমি কি বুঝতে পারছ, মেয়েদের ভিতরে এই যে বৈষম্যমূলক চিন্তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটাও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা? এ চিন্তা তোমাকে শিখাচ্ছে – পুরুষ বাইরে যাবে, টাকা আনবে, আর তুমি তার টাকায় চলে তার মনের মতো করে নিজেকে বদলে নিবে।

বিয়ের সময় একটা মেয়ে চাকরি করে কিনা, সেটাকে তার যোগ্যতা হিসেবে যাচাই করা হয় কয়টা ক্ষেত্রে? আচ্ছা, মেনে নিলাম গুটিকয় পরিবার এখন বিয়ের পাত্রী হিসেবে চাকুরীরত মেয়ে খোঁজে। কারণ আজকালকার যুগে অনার্স-মাস্টার্স অব্দি লেখাপড়া করা যেমন বিয়ের পাত্রীদের একটা বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে ধরা হয়, তেমনি মেয়ের চাকরি করাকেও আরেকটা বাড়তি যোগ্যতা হিসেবে ধরার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু বিয়ের পর কয়টা মেয়েকে চাকরি করতে দেওয়া হয়? সংসার সামলানোর যে চাপের কথা বলে মেয়েটাকে চাকরি ছাড়তে বলা হয়, সেই একই চাপের কথা বলে ছেলেটিকে কেন চাকরি ছাড়তে বলা হয় না? সংসার তো মেয়ের একার না। কিন্তু আমরা তো এমনভাবে কাউকে বলতে দেখি না যে, ছেলে সংসার সামলাক, মেয়ে চাকরি করুক! যে কেউ একজন সংসারে টাকা আনলেই তো হলো। কিন্তু না, জামাই ঘরে বসে বৌয়ের উপার্জন খাবে, এটা আমাদের সমাজে অত্যন্ত বেইজ্জতি কারবার। অথচ একটা মেয়ে বসে বসে জামাইয়ের কাছে হাত পাতছে “এটা কিনবো, সেটা লাগবে” বলে, তাতে মেয়ের বেইজ্জতি হচ্ছে না। বরং মেয়ে সবাইকে গর্ব করে বলছে, “আমার জামাই কত্ত ভালো! আমাকে এটা দিয়েছে, সেটা দিয়েছে।” কিন্তু তোমার জামাই কেন তোমার উপার্জন গ্রহণ করে খুশি মনে সবাইকে বলে বেড়ানোকে “বেইজ্জতি” ভাবছে, বল তো?

এছাড়া মেয়ে চাকরি করলে স্বাধীনচেতা হয়ে যাবে, রাতে বাড়ি ফিরলে বুঝা যাবে বাইরের মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে এসেছে – এসব চিন্তা তো আছেই! অথচ ছেলেটি চাকরি করে রাতে বাড়ি ফিরলে “খুব খেটে এসেছে”। সে চাকরি করে স্বাধীনচেতা হলে সেটাই স্বাভাবিক। কেন এমন পার্থক্য, ভেবে দেখেছো মেয়ে? নাকি এত ভাবাভাবিকে “ধুর! এতদিন ধরে সমাজে যা চলে এসেছে, সেটা কি আর ভালো না হলে চলে এসেছে?” ভেবে উড়িয়ে দিয়েছ? তাহলে জেনে রাখো, তোমার চিন্তাধারা ফ্যালাসিতে আক্রান্ত। সমাজ সবসময় সব লিঙ্গের মানুষের ভালোর জন্য সবকিছু চালু করেনি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ মেয়েদেরকে পায়ের তলে রাখতে অনেক ঐতিহ্য চালু করেছে। এবং তোমার মতো পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা সম্পন্ন মেয়েরা এসব ঐতিহ্যকে দীর্ঘস্থায়ী করে যাচ্ছে। তোমাদের কারণেই মুক্তমনা মেয়েদের শুনতে হচ্ছে “উচ্ছন্নে যাওয়া”, “বখে যাওয়া” উপমাগুলো। অথচ তোমারও অবস্থান সমাজে পুরুষের মতো একই রকম হওয়ার কথা।

একটা ছেলে চাকরি না করলে তার বিয়ে করাই মূলত অসম্ভব হয়ে পড়ে (প্রেমের বিয়ে ছাড়া)! কারণ মানুষ তখন ভাবে, মেয়েটাকে সে খাওয়াবে কীভাবে? কেন, মেয়েটা চাকরি করে ছেলেটাকে খাওয়াতে পারে না? একজন চাকরিজীবী মেয়ে তো এভাবেও চিন্তা করতে পারে যে, সে একটা বেকার ছেলেকে বিয়ে করবে। ছেলে চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত তাকে সাপোর্ট দিয়ে যাবে। কিংবা থাকুকই না ছেলেটা সারাজীবন হাউজ হাজব্যান্ড হয়ে, সমস্যা কী? কিন্তু না, মেয়েরা এভাবে ভাবতে শিখেনি এখনো। বেকার ছেলে বিয়ে করা বড়ই আত্মগ্লানির বিষয়। সে জায়গায় হাউজ হাজব্যান্ড? হাসালাম বোধহয়! অথচ তুমি যে মেয়ে বেকার অবস্থায়ই একটা ছেলেকে মালা পরাচ্ছ, সেটায় তোমার আত্মগ্লানি হয় না? কেন হয় না? কারণ তোমার মাথায় এভাবেই চিন্তা সেট করে দেওয়া হয়েছে। “ছেলে” আর “মেয়ে” কী করবে, সেগুলোর মধ্যে এভাবেই বৈষম্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

বৌ-বাচ্চাকে ভরণপোষণের দায়িত্ব কেন শুধু জামাই-ই নেবে? তুমি এভাবে ভাবো কেন, মেয়ে? গৃহিণী হয়ে বসে থাকতে তোমার অস্বস্তি হয় না, অথচ তুমি পারবে “হাউজ হাজব্যান্ড” হিসেবে যে ছেলেটা জীবন কাটাতে চায়, তাকে বিয়ে করতে তোমার অস্বস্তি হয়। তাকে বিয়ে করার ব্যাপারে তোমার আত্মসম্মানে লাগে, আর নিজে গৃহিণী হয়ে বসে থাকতে লাগে না। কেন? তুমি কি বুঝতে পারছ, তোমার চিন্তাভাবনাগুলোকে ওয়াশ করা হয়েছে? একই “গৃহিণী” পদ, অথচ নিজের বেলায় তুমি এই পদে আসীন হওয়াকে মেনে নিতে পারছ, জামাইয়ের বেলায় নয়। কেন? নিজেকে জিজ্ঞেস করে দেখো একবার। তোমার মনে কি এই প্রশ্ন আসে না যে, সমাজ কেন তোমাকে এভাবে ভাবতে শিখিয়েছে?

আরেকটা অভিজ্ঞতা শেয়ার করি। মিডিয়াতে সাদিয়া জাহান প্রভার প্রত্যাবর্তনকে প্রশংসা করে আমি একটা ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিলাম। কিন্তু বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, কিছু মেয়ে সেখানে ঘৃণা ভরে মন্তব্য করেছে। ছেলেরা তো প্রভাকে নিয়ে খারাপ কথা বলছেই, মেয়েরাও যোগ দিয়েছে সেখানে। অথচ রাজীবের চরিত্রের দিকে আঙুল উঠছে না কারো। সবাই বলছে, “রাজীব ভিডিও করতে চাইতেই পারে। কিন্তু প্রভা খারাপ মেয়ে না হলে সেটা করতে দেবে কেন?”

বাহ! প্রভা খারাপ মেয়ে বলে ভিডিও করতে দিয়েছে, আর রাজীব ভালো ছেলে বলে ভিডিওটা ফাঁস করে জনগণের উপকার করেছে। নাকি? বিচারবুদ্ধির বাহার দেখি বসে বসে।

ঠিক একই কাহিনি দেখলাম আট মিনিটের ভিডিওতে। ভিডিও করলো প্রেমিক-প্রেমিকা দুজনে মিলে, আর ফাঁস করে দিলো ছেলেটা। দুটি ক্ষেত্রে ছেলেরাই অবিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছে। তারপরও সমাজের চোখে “খারাপ” গালি শুনতে হচ্ছে মেয়েদেরই। ছেলে দুটোর অসততা, অবিশ্বস্ততা, বিশ্বাসঘাতকতা – কিছুই যেন এক শ্রেণির অমানুষ পাত্তা দিতে চাইছে না। ভয়ংকর ব্যাপার হল, এই শ্রেণিতে পুরুষতন্ত্রের পতাকাবাহী মেয়েরাও আছে। কোথায় এমন দুঃসময়ে ঐ মেয়েগুলো ভিকটিম মেয়েটির পাশে দাঁড়াবে, তা না। উল্টো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে “ভালো” সাজার জন্য তারাও মেয়েটিকে “খারাপ” বলে গালি দিচ্ছে।

ছেলে-মেয়ে দুজনের মন্তব্যেই দেখেছিলাম, “মরে না কেন এই মেয়ে?” কিন্তু কেউ বলেনি, “মরে না কেন এই ছেলে?” ভিকটিম মেয়েটি খুন হয়ে গেলে, বা আত্মহত্যা করলে সমাজের মনে হয় যে, সমাজ কলুষমুক্ত হল। আর ধর্ষক, বা যৌন নির্যাতনকারী বেঁচে থাকলে সেটা খুবই স্বাভাবিক, কারণ সে একটা পুরুষ। তাই না?

প্লিজ, একটু মাথা খেলাও পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা বহনকারী মেয়েরা। তোমরা নিজ জাতিকে সম্মান দিতে পারো না, আবার অন্যদের কাছ থেকে সম্মান আশা করো। ব্যাপারটা এভাবে কাজ করে না। আগে নিজেকে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা থেকে মুক্ত করো, নিজেকে সম্মান করতে শেখো। এরপর মানুষের কাছ থেকে সেটা আদায় করে নাও।

শেয়ার করুন: