আলফা আরজু: আমাদের দেশের বেসরকারি টেলিভশন চ্যানেলগুলোর শোভাযাত্রার শুরুর দিকের কথা। সচিবালয়ে যারা রিপোর্টিং করতেন তাদের কাছে একজন জনপ্ৰিয় বড় ভাই ছিলেন। তার একটা ছদ্মনাম দেই। নামটা ধরুন – ম ভাই। যেকোনো মন্ত্রণালয়ের প্রোগ্রামে উনাকে দেখা যেত টেলিভশন চ্যানেলগুলোতে। সেইজন্য – ওই সময় যারা সচিবালয়ে কাজ করতেন – ওই ভাইকে নিয়ে মজা করে বলতেন – ক্যামেরা যেখানে, “ম ভাই” সেখানে।
কেউ কেউ বিরক্তও হতেন। কিন্তু ওই ম-ভাই থাকতেন।
এর দুই রকম মানে হতে পারে- এক, ম-ভাই যে পত্রিকায় কাজ করতেন- ওই পত্রিকার উনিই সব মন্ত্রণালয়ের খবর কভার করতেন। অন্য মানেটা একটু হাস্যকর – সেটা হলো, উনি নিজেকে টিভি চ্যানেলে দেখানোর জন্য সময়মতো ক্যামেরার সামনে এসে দাঁড়াতেন। এইসব নিয়ে ঐসময় সবাই হাসাহাসি ও বিরক্তি প্রকাশ করতো।
ফেসবুকে সবার সেলফি প্রেম দেখে আমার খালি সেই ম-ভাই এর কথা মনে হয়। কেমন করে যেন আমরা সবাই ম-ভাই হয়ে যাচ্ছি। স্মার্ট ফোন অথবা ক্যামেরা আমাদেরকে বড্ডবেশি স্বার্থপর করে তুলছে। সবাই নিজেকে কোথায় যেন দেখতে চাই – কত লাইক পড়লো, কত সুন্দর সুন্দর কমেন্ট, এইসব আর কি ! নিজেকে আমরা যেভাবে দেখতে চাই – “সেইটার পোট্রেটই হলো আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গুলোর প্রোফাইল অথবা কার্যক্রম।” যে যেখানেই থাকি, সেলফি তোলা চাই।
বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের ওয়ানডে অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে (৫ অক্টোবর) এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন – “হৃদ্যতার চেয়ে শত্রুতা বাড়ছে দ্রুত। হানাহানি বাড়ছে। মানুষগুলো কেমন বদলে যাচ্ছে। সিম্পল একটা কথা বলি। এখন লোকে রাস্তাঘাটে দেখা হলেই শুধু সেলফি তুলতে চায়। তুলেই চম্পট, কথাবার্তা নেই। আগে এমনও হয়েছে, রাস্তাঘাট আমি অনেকের সঙ্গে ৫ মিনিট, ১০ মিনিট, ১৫ মিনিট কথা বলেছি দাঁড়িয়ে। আমি কখনোই বিরক্ত হতাম না। এখন ৫ সেকেন্ডে সেলফি তুলে হাওয়া। আমার খুশি হওয়ার কথা, সময় বেঁচে যাচ্ছে। কিন্তু আমার খারাপ লাগে। কারণ আন্তরিকতাটা নাই। আমি তো কথা বলতেই চাই! কুশলাদি জিজ্ঞেস করা, হাসিমুখে কিছু বলা, বুকে জড়িয়ে ধরা, এসব ভালো লাগে।”
এই সেলফি এখন এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে – মুমূর্ষু খাদিজাকে ICU তে দেখতে যেয়েও সেলফি তুলেছেন – বিবেকবান মানুষেরা !
দৈনিক প্রথম আলোর এই খবরের মাধ্যমেই জানতে পারি যে ওই নেত্রীর একজন বন্ধু (ফেসবুকের ফ্রেইন্ড লিস্টেড সবাই বন্ধু- সেই অর্থে এক বন্ধু !) বলেছেন, নেত্রী চাইলে, উনি ICT আইনে মামলা করে দিতে পারেন প্রথম আলোর বিরুদ্ধে – সেলফির এই খবর ছাপানোর জন্য। এইটা যে একটা দারুণ একটা কাজ করছেন নেত্রী – সেটা সাংবাদিকরা না বুঝলেও – ওই নেত্রীর বন্ধু ঠিক ধরেছেন। “খাদিজাকে ICU তে দেখতে যেয়ে সেলফি তুলে উনি যে জাতির জন্য কত বড় কাজ করেছেন।”
এইটা কি বাড়াবাড়ি? না, একদম না। কারণ উনাদের এই সেলফি দেখে হয়তো বড় নেতারা আরো বড় কোনো পোস্ট দিয়ে দিবেন পরের নির্বাচনে – কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বও পেয়ে যেতে পারেন। মানে মন্ত্রী ! আর কী চাই ! বাংলাদেশের মন্ত্রী মানেই শুনেছি পরকালে বেহেস্তের জীবনের আলামত দুনিয়া থেকেই দেখে যাওয়া।
কেউ কেউ আছেন যারা এমনিতেই মজা করে সেলফি তুলেন, তাতে নিশ্চয় কোনো সমস্যা নেই। তাদের মজার উদ্দেশ্যটা যেমন বোঝা যায়, তেমনি যারা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে সেলফি তুলেন, সেগুলোও বুঝতে বাকি থাকে না। খাদিজা’র শয্যাপাশে যারা সেলফি তুলেছেন – তাদের হেতু বোঝার ক্ষমতা আমার নেই। কিন্তু এটা সত্য “এমন অমানুষও হয় মানুষ!” (ফেইসবুক স্ট্যাটাস, জাহিদ নেওয়াজ খান, ৫ অক্টোবর, ২০১৬)।

আমাদের বিবেকও এখন সেলফি-প্রেমিক। একজন জীবনমৃত্যুর সাথে লড়ছেন, তার পাশে দাঁড়িয়ে সেলফি তুলতে পারাটা যে কত বড় মনের পরিচয়, তা করার জন্য যে কত বড় মাপের মানুষ হতে হয়- তা ওই সেলফিপ্রেমিক নেত্রী’মাত্রই জানেন।
সেলফি আমাদের এতোটাই মাতিয়েছে যে – আমরা এখন নিজের প্রচার-প্রচারণায় এটার সঠিক ব্যবহার করে চলেছি। রোগী দেখা হউক, অথবা কোনো দুর্ঘটনা। কোথাও কিছু দান করতে গেলে আগে একটা সেলফি তুলি। পরে জিনিস দান করি, বা না করি- সেলফিটা আগে ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রামে পোস্ট করে দিয়ে নিজের যা ফায়দা, সেটা আদায় করে নেই। জয় হউক সেলফির!
যাক এই লেখাটা শেষ করি ফেইসবুকে ফিরোজ আলম ভাই এর একটা স্ট্যাটাস (২৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৬) দিয়ে –
“আজরাইল (আ:) মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে হাজির হলো এক সুন্দরী মেয়ের কাছে ৷ মেয়েটির অনিন্দ্য সুন্দর চেহারা দেখে,আজরাইল (আ:) এর বেশ মায়া হলো ! মেয়েটিকে বললো, আমি তোমার মৃত্যু পরোয়ানা নিয়ে এসেছি,তোমার জান কবজ করার আগে তোমাকে একটা সুযোগ দিতে চাই! বলো তোমার শেষ ইচ্ছা কী, আমি তোমার আশা পূরণ করবো ৷ মৃত্যু পরোয়ানা শুনে সে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলোনা! আজরাইল (আ:) এর খুব কাছে ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফোন বের করে বললো, “মৃত্যুর আগে হাসিমুখে তোমার সাথে একটা সেলফি তুলতে চাই, তবে একটু আফসোস থেকেই যাবে দেখতে পারবো না কতজন লাইক দিল😪” ক্লিক ক্লিক ক্লিক🙋🙋🙋”
টেলিভশন চ্যানেলগুলোর শোভাযাত্রার পরও সাধারন সাংসদ বা নেত্রীরাতো টিভি ক্যামেরা পান না, তাদের কি আত্মপ্রচারের ইচ্ছে নেই? বিশেষত যখন নেত্রী স্বয়ং খাদিজার খোজ রাখছেন…