শারমিন জান্নাত ভুট্টো: খাদিজার ভাগ্য আফসানা, রিশা, তনু কিংবা মিতুর মতো হলে আমরা কি খুব অবাক হবো? অবশ্যই না। আর এর কারণ হচ্ছে, প্রতিদিন যে অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে তা দেখার মধ্য দিয়ে আমরা বড় হচ্ছি। আফসোস এবং দু:খজনক হলেও সত্যি যে, অপরাধ আর বিচ্যুতিগুলো ঘটছে দিনের পর দিন। আমাদের আশেপাশে তার একটির বিচার কিংবা দৃষ্টানতমূলক শাস্তি হয়েছে এমনটা কি আমরা বলতে পারি?
সরকার যদি অপরাধ দমনের জন্য বিভিন্ন আইনের বিধান করে থাকে তবে এটাও বলতে পারি অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি না দিয়ে অন্যদের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে যাবার উস্কানীও কিন্তু তারাই দিচ্ছে।
২০১২ সালে সাগর-রুনী হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যে ৪৮ ঘন্টার সময় নিয়েছিলেন অপরাধীদের খুঁজে বের করার, তা হয়তো আর কোনদিনই আসবে না। সরকারের এমন আচরণে সাধারণ জনগণ অবাক হচ্ছে প্রতিনিয়ত আর সেই সাথে সুযোগ পাচ্ছে তারা, যারা আইনকে হাতে তুলে নেয়ার স্পর্ধা ও অপপ্রয়োগ করার সাহস পাচ্ছে।
ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে নারী নির্যাতনের ঘটনা বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। ব্র্যাক তাদের কর্মীদের মাধ্যমে ৫৫টি জেলায় তথ্য সংগ্রহ করে এ প্রতিবেদন তৈরি করে যেখানে আরো বলা হয়, নারীর প্রতি যে সহিংস ঘটনাগুলো ঘটে তার ৬৮ শতাংশই নথিভুক্ত হয় না। আর তা যদি নথিভুক্ত হতো তাহলে বুঝতেই পারছেন সংখ্যাটা কতোটা বাড়তো।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের এক হিসেব মতে, ২০১৫ সালে ১,০৯২ জন নারী ও শিশু ধর্ষণের শিকার হয়, যা আগের বছরের চেয়ে বেশী। ২০১৪ সালে এর সংখ্যা ছিলো ৬৬৬ জন। অর্থাৎ মাত্র ৩৬৫ দিনের ব্যবধানে এ ধরনের অপরাধের প্রবণতা বেড়েছে প্রায় ৩৫ শতাংশ। অপরাধ করে অপরাধীরা পার পেয়ে যাচ্ছে অনায়াসেই। সম্পত্তির প্রতিপত্তি, সরকার-দলের অংশ কিংবা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গাফলতি নয়তো সময় ক্ষেপনের কারণে।
আমরা কোনো সমাজে আর কোন যুগে বাস করি যেখানে প্রতিনিয়ত নারী ও শিশুরা নানা ধরনের বর্বরতার শিকার হয়। শিশুদের পায়ুপথে বায়ু ঢুকিয়ে হত্যা করা হয়, কেউ প্রেমের প্রস্তাবে রাজী না হওয়ায় দিনে-দুপুরে ছুরি নয়তো, চাপাতির আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয় সবার সামনে, আর অন্যরা চেয়ে চেয়ে তা দেখে আর ভিডিও করে। আসলেই অদ্ভুত আমাদের এ সমাজ।
দিন সত্যি পাল্টেছে, আর এর কারণ হচ্ছে আগে হত্যাকাণ্ড এবং অপরাধগুলো হতো গোপনে আর চুপিসারে। আর এখন তা ঘটছে প্রকাশ্যে আর বর্বরতার মধ্য দিয়ে।
ধর্ষণের ঘটনা বহু আগে থেকেই এ বাংলায় হয়ে আসছে, তবে এখন শুধু ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণই হচ্ছে না সেই সাথে করা হচ্ছে হত্যা। কিছু কিছু জঘন্য অপরাধ আছে, যার দায় শুধু সংশ্লিষ্ট অপরাধীর। তবে কিছু অপরাধের দায় শুধু অপরাধীর নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রেরও বটে। যেমন ‘ক্রসফায়ারের দায়িত্ব পুরোটাই নিতে হবে রাষ্ট্রের। সেই সাথে গণপিটুনির দায়দায়িত্ব সমাজ কিংবা রাষ্ট্র কেউই এড়াতে পারবে না। তেমনি অপরাধী ধরা না পড়া কিংবা উপযুক্ত শাস্তি না দেয়া এগুলোও কিন্তু রাষ্ট্রের ব্যর্থতা হিসেবে পরিগণিত হবে।
রুনী, তনু কিংবা মিতু হত্যাকাণ্ড হওয়ার পর দেখা যায়, অপরাধীকে ধরার প্রবণতা কিংবা উপযুক্ত শাস্তি দেয়ার চেয়ে বরঞ্চ তাদের চরিত্রহননে আর চুলচেরা বিশ্লেষণে লেগে পড়েছে পুরো সমাজ ও রাষ্ট্র। তখন আমার মতো সাধারণ মানুষের এ ধারণা হওয়া অযৌক্তিক নয় যে রাষ্ট্র, সরকার কিংবা সমাজ শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছে, আর এভাবেই অপরাধীরা ধীরে ধীরে আড়াল হয়ে যাচ্ছে সবার সামনে থেকে।
এখন পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের উপযুক্ত শাস্তি না হওয়াতে, মানুষরুপী পশুরা ছোবল মেরে যাচ্ছে একের পর এক। অপরাধী কোন ধর্ম, বর্ণ, গোত্র, শ্রেণী কিংবা কোন রাজনৈতিক দলের তা মুখ্য না হয়ে বরং অপরাধীর অপরাধের ভিত্তিতে তার উপযুক্ত শাস্তি হওয়া উচিত, যাতে একই ধরনের অপরাধ কিংবা কোন ধরনের অপরাধ করতে কেউ সাহস না পায় পরবর্তীতে।
তবে আমাদের দেশে এখন যাদের বেশী প্রতিপত্তি কিংবা রাজনৈতিক পরিচয়/লিংক রয়েছে তারা সহজেই অপরাধ করে তার শাস্তি ভোগ করার আগেই গোপনে কেটে পড়ছেন। হয়তো তার বদলে তাদের খরচ করতে হয় মোটা অংকের টাকা, নয়তো কোনো প্রভাবশালীর একটি ফোনকল।
রুনী, তনু, মিতু, আফসানা কিংবা খাদিজা; একটি ঘটনারও সুষ্ঠু বিচার ও অপরাধীর শাস্তি কি আমরা দেখতে পারবো না? বিপর্যস্ত পরিবারগুলোকে কি একটু সান্ত্বনা দিতে পারবো না? দেখতে কি পারি না একটু আশার আলো? ভরসা রাখতে কি পারবো না আইনব্যবস্থার ওপর? নাকি আমাদের গোল্ডফিশ মেমোরি আস্তে আস্তে ভুলে যাবে সব ঘটনা একটার পর একটা।