‘ফেসবুক কোনো ব্রোথেল না, মাইন্ড ইট’

প্রীতি ওয়ারেছা: কয়েকদিন আগে এক বন্ধুকে মজা করে বললাম, জানিস কী হয়েছে, মজা পাবি শুনলে। সরকারি চাকুরে এক ডেপুটি সেক্রেটারি ভদ্রলোক আমাকে ফেসবুক থেকে ব্লক করে দিয়েছে। ভাব এবার আমি কত্ত খারাপ মানুষ! আমার সেই বন্ধুটি ঘটনার কোনো কারণ জানতে না চেয়ে শুধু হাসলো।

বললো, তাহলে একটা গল্প বলি শোন।

priti-waresa
প্রীতি ওয়ারেছা

ইউনিভার্সিটিতে আমার ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র এক আপার নাম কাকলী। গল্পটি কাকলী আপার কাছ থেকেই শোনা। বাহ্যিক সৌন্দর্য্য মানুষকে মুগ্ধ করে এটাতো সত্যি যদিও সৌন্দর্য্যের কোন নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। একজন যেটাকে সুন্দর বলে উচ্ছাস প্রকাশ করছে, আরেকজনের কাছে নাও লাগতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে এমন হয় যেখানে আপামর জনতা একসঙ্গে রায় দেয় যে, নাহ ঐ জিনিসটি আসলেই সুন্দর না।

আর ঠিক সেই জায়গায় বাহ্যিক সৌন্দর্য্যরে বিচারে কাকলী আপা ছিলেন আপামর জনতার রায়ে গড়া তেমন একজন মানুষ। অসম্ভব বন্ধুবৎসল মানুষ। সবাইকে তুই সম্মোধনে ডাকতেন। কারো চোখে কখনো-সখনোও সুন্দরী লাগার ব্যাপারটি কাকলী আপার ক্ষেত্রে ঘটেনি। তার পোশাক-পরিচ্ছদও ছিল তুমুল আলুথালু! কাকলী আপা নিজেও তার চেহারা নিয়ে আমাদের সঙ্গে মজা করতেন।

আমাদের সেই কাকলী আপা তার নিজের প্লট কিংবা ফ্ল্যাটের রেজিস্ট্রেশনের ব্যাপারে কথা বলতে একদিন রাজউকে গেলেন। ডেপুটি সেক্রেটারি র‌্যাংকের এক ভদ্রলোক কাকলী আপাকে বললেন, আপনার জন্য কাজটি কত সহজে করে দিলাম, একবার কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করলেন না। কাকলী আপা ধন্যবাদ জানিয়ে ভদ্রলোককে অত্যন্ত বিনয় সহকারে বললেন- কখনো আপনার কোন উপকারে আসতে পারলে সত্যিই খুব খুশি হবো।

ডেপুটি সেক্রেটারি র‌্যাংকধারী ভদ্রলোক তখন কাকলী আপাকে জানালেন জীবনে কমতো আর উপার্জন করেননি, তার আসলে টাকা পয়সাজনিত স্বাচ্ছন্দের কোন কমতি নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। ইনিয়ে-বিনিয়ে একথা-সেকথার পর ভদ্রলোক শেষ পর্যন্ত যা বললেন- আমার এক বন্ধুর রিসোর্ট আছে গাজীপুরে, দুইদিনের জন্য চলেন ঘুরে আসি। আচমকা বাক্যটা মাথার ওপর দিয়ে গেলেও কাকলী আপা উচ্চারণ করতে পেরেছিলেন- আপনি শিওর যে বিষয়টা আপনি আমাকেই বলছেন!

ইউনিভার্সিটিতে থাকতে কাকলী আপা ছাত্র রাজনীতি করতেন। তুখোড় নেতা ছিলেন। গাজীপুর রিসোর্টে ঘুরতে যাওয়ার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে কাকলী আপা যা ঘটিয়েছিলেন সেই গল্প আমাদের সবাইকে শোনাতেন আর হাসতে হাসতে আমাদের পেটে খিল লেগে যেত।

তিনি বলতেন, তোদের এই কাকলী আপার দিকে সারাজীবনে কেউ একটি বারের জন্যে চোখ তুলে তাকালো না, আর সেই আমাকে বুড়িকালে গাজীপুর রিসোর্টে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় কিনা ডেপুটি সেক্রেটারি!

বন্ধুর মুখে এই গল্পটি শুনে আমি সেদিন খুব হেসেছিলাম।

মজা করে বলেছিলাম- উনি একজন বিশিষ্ট ডেপুটি সেক্রেটারি। একইরকম বিশিষ্ট একজন ডেপুটি সেক্রেটারি ভদ্দরলোককে কয়েকদিন আগে প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে এবং অবশ্যই কঠিন ভাষায় আমি একটি মেসেজ পাঠিয়েছিলাম। ঠিক ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে তিনি আমাকে ব্লক করেছেন। আমার দারুণ লেগেছে। এরা আসলে সব কীটপতঙ্গ। এদের মানসম্মান হারানোর ভয় থাকে না, থাকে না চাকরি হারানোর ভয়। যে কারণে গল্পটি বলা- মানুষ কী অবলীলায় নিজের কুৎসিত রুপটি আরেকজনের কাছে প্রকাশ করে ফেলে। যত উঁচুতেই উঠুন না কেন ভেতরের কদর্য রুপ লুকিয়ে রাখা কঠিন। সেই কুৎসিতদর্শন মনের অধিকারীরা লুটোপুটি খেতে থাকে নারীর পায়ে পায়ে, পৃথিবীর প্রতিটা নারীই এরকম কত কুৎসিত গল্পের যে সাক্ষী!

প্রযুক্তির যুগে এদের পোয়াবারো অবস্থা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে নামে-বেনামে তাদের আছে অসংখ্য ফেস। একেকজনের জন্য সীমা নির্ধারণ করা আছে পাঁচ হাজার, ফলোয়ার অসীম। ইচ্ছে করলে বন্ধু বানানো যায়, অনিচ্ছায় ব্লক, ইচ্ছে করলে ঝুলিয়ে রাখা যায়, অনিচ্ছায় বাতিল। মাধ্যমটি যেমন সামাজিক, তেমনি একাধারে অসামাজিক। ফেসবুক নিজে সারা পৃথিবীকে বাঁধতে চেয়েছে বন্ধুত্বের বন্ধনে, কিন্তু বন্ধুত্ব ছাপিয়ে নারী-পুরুষ সম্পর্ক আর বিভিন্ন পেশাজীবীর ভেতরকার ইর্ষা-দ্বেষ সবকিছুর কুৎসিততম প্রকাশ মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

নারী হওয়ার সুবাদে নিজের তালিকায় থাকা প্রচুর পুরুষের বাড়তি প্রত্যাশার জায়গায় প্রতিটা নারী নিজেকে টের পান হরহামেশা। আসলে নির্লজ্জভাবে টের পাইয়ে দেয়া হয়। আর নারী যদি কোনো পুরুষকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে তো হয়েই গেল! পুরুষটি ভেবেই নিলেন, তিনি হচ্ছেন গিয়ে রসগোল্লা। তার পেছনে পিঁপড়া লেগেছে। সুতরাং তিনি রসগোল্লার সিরার সদ্ব্যবহার করা শুরু করতেই পারেন!

এসব পুরুষের কাছে ফেসবুক হচ্ছে খুব উত্তম টোপ। তাদের বলতে চাই- আপনার দরকার ব্রোথেলহোম। আপনার জন্য অপেক্ষা করছে খালা-নানীসহ অনেক দালাল। ফেসবুককে ব্রোথেলহোম ভাবার কোন কারণ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো নারী আপনাকে নিজের তালিকায় রেখেছে ব’লেই ভাববেন না তিনি আপনাকে প্রলুব্ধ করতে চেষ্টারত, কিংবা আপনি চাইলেই যখন তখন বন্ধুত্বের আবদারে কোন নারীর ব্যক্তিগত তথ্য জানার ক্ষমতা রাখেন, কিংবা তাকে কফিশপে কফি খেতে কিংবা রিসোর্টে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব করতে পারেন! প্রযুক্তির যুগে দুর্লভ কিংবা আকাঙ্খিত যেকোনো কারো কাছে পৌঁছানোটা এখন এতোটা সহজ হয়ে গেছে যে, রথি-মহারথি থেকে শুরু করে কীট-কীটানুরাও সুযোগ নিতে চায়- দেখি একবার টোকা দিয়ে, কাজ হলে হতেও পারে!

বিষয়টা আসলেই এরকম সেটা নারীমাত্রেই জানে। নারী মাত্রেই জানে তাদের ইনবক্স নর্দমার কাদায় ভর্তি, এসব কখনো দেখতে নেই, কখনো না।

আমি কিছু পুরুষকে ইঙ্গিত করেছি মাত্র, অবশ্যই সবাইকে নয়। আমার অনেক ভালো বন্ধু আছে যাদের সঙ্গে আমার ঝগড়াঝাটির সর্ম্পক, যাদের সঙ্গে আমার তথ্য বিনিময়ের সম্পর্ক। আমার কাছে বন্ধুত্ব কোন সুযোগ নয়, এটা অমূল্য অর্জন। যোগ্যতা থাকলে কারো বন্ধুত্ব আপনি অর্জন করে নিন। সেটা খুব সহজেই সম্ভব, আবার পাহাড়সম কঠিনও। আপনার সত্যিটা হলো, ব্রোথেলহোমে দাঁড়িয়ে কারো বন্ধুত্ব অর্জন সম্ভব না।

শেয়ার করুন: