লোকটি মানুষ নয়, প্রেমিক নয়, পশুও নয়!

জান্নাতুন নাঈম প্রীতি: মেয়েটাকে কোপানোর ভিডিওটা দেখার পর আমি আমার প্রাক্তন প্রেমিকদের প্রতি কৃতজ্ঞতা বোধ করতে শুরু করলাম। তারা আর যাই হোক, আমাকে কোপাতে আসেনি, ধর্ষণ করতে আসেনি, মেরে ফেলতেও আসেনি। আমি আরও কৃতজ্ঞতা বোধ করতে শুরু করলাম আমার প্রাক্তন প্রেমিকদের প্রতি। কারণ তারা কেউ সেই অর্থে আমাকে চূড়ান্ত অসম্মান করেনি।

eid-day
প্রীতি

প্রেমের প্রস্তাব ব্যাপারটা ঠিক আমার মাথায় ঢোকে না। বিয়ের প্রস্তাব, চাকরির প্রস্তাব, সমতা, শান্তির প্রস্তাব হতে পারে। কিন্তু প্রেম করতে প্রস্তাব দেওয়া লাগবে কেন? পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রস্তাব হতে পারে, কিন্তু যেখানে কোনো প্রকল্প নেই, নিছক ভালোবেসে যাওয়া ছাড়া অনুভব নেই সেখানে ‘প্রস্তাব’ শব্দটা অপ্রস্তাবিত একটি প্রশ্নের মতন প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে আমার কাছে বোধগম্য হয়।

প্রেমিক মানে আমার কাছে এক টুকরো স্বাধীনতা। যাকে বা যার প্রতি ভালোবাসা না থাকলেও তাঁর কিচ্ছু এসে যায়না, সে নিজের মতন করে আমাকে ভালোবাসতে জানে- সে হচ্ছে প্রেমিক। একজন প্রেমিক অর্থাৎ যে প্রেম দিতে জানে বা ভালবাসতে জানে সেইই প্রেমিক। সমতার শব্দভাণ্ডারে সে নারীও হতে পারে, সে পুরুষও হতে পারে।

প্রেমিকের প্রতি ভালোবাসা থাকলে ভালো, না থাকলেও খারাপ নয়। কারণ একটি মানুষ আমাকে ভালোবাসতেই পারে, আমারও তাকে ভালো লাগতেই পারে। তখন সেই বিশেষ মানুষটির সাথে বিশেষ ও অবিশেষ মিলিয়ে যে সংস্পর্শ, সেটিই প্রেম। কেউ ভালোবাসি বললেই আকাশ থেকে তাঁর প্রতি টুপ করে বৃষ্টির ফোঁটার মতন বুকের মধ্যে ভালোবাসা বর্ষিত হতে শুরু করবে এটা ভাবা নিতান্তই ছেলেমানুষী।

বদরুল নামের যে পিশাচটি মেয়েটিকে প্রেমের তথাকথিত ‘প্রস্তাব’টিতে রাজি না হওয়ায় কুপিয়েছে তা খুব অস্বাভাবিক- ব্যাপারটা তা নয়। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজ ব্যবস্থায় পুরুষের ভূমিকাটা একই সঙ্গে শাসক এবং শোষকের। নারী এখানে বিনিময়ের দ্রব্য ছাড়া কিছুই নয়। কারণ একটা নির্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত বাবার অধীন এবং এরপর স্বামীর অধীন- এইই হচ্ছে বাঙালি মেয়ের গন্তব্য। মৃত্যু ভিন্ন মানুষের যেমন গন্তব্য নাই তেমনই বাঙালি নারীর স্বামী ভিন্ন গন্তব্য নাই। স্বামীর ঘরই হচ্ছে গন্তব্য, কাজেই গন্তব্যের প্রতি সচেতন হওয়া যা অচেতন হওয়াও তাই। এটি বদরুল নামের লোকটির মাথায় খুব সুন্দর করে গাঁথা হয়ে আছে। কাজেই সে তার তথাকথিত প্রেমের কথিত প্রস্তাবটির অকাল মৃত্যু দেখে মেয়েটিকেই মেরেছে, কুপিয়েছে, প্রায় মৃত বানিয়েছে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজের কাছে এও এক কৃতিত্ব!

এখন কথা হচ্ছে, এতোবড় একটি অন্যায় চোখের সামনে ঘটতে দেখেও কেউ এগিয়ে আসেনি কেন? ভিডিও করেছে, ভিডিওটি যোগাযোগ মাধ্যমে পরিবেশিত করেছে, কিন্তু একজন আরেকজনকে হত্যা করছে দেখেও এগিয়ে আসেনি। কারণটা খুব পরিষ্কার। সেটা হচ্ছে- আমরা প্রতিবাদ করি যখন খুব অস্বাভাবিক কিছু ঘটতে দেখি তখন। মেয়েটিকে মারা বা কোপানো যাইই বলিনা কেন সেটি এই সমাজের কাছে খুব স্বাভাবিক। বাড়িতে যে শিশু দেখছে বাবার কাছে মা দুই চারটা চড়-থাপ্পড় খাচ্ছে সেটিই একসময় তার কাছে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। কারণ পুরুষেরা মারবে, নারীরা কাঁদবে, মরবে-এটিই অলিখিত পুরুষতন্ত্রের লিখিত বিধান। তার ওপর যুক্ত হয়েছে ক্ষমতার দম্ভ।

বদরুল বলে যে লোকটি মেয়েটিকে কোপাচ্ছে সে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ দলীয় নেতা এবং ক্যাডার। ক্যাডার মানে বিসিএস ক্যাডার নয়, একজন অনিয়ম, দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাওয়ার ক্ষমতাওয়ালা লোক। এই ক্ষমতাওয়ালা লোকটিকে যে ঠেকাতে যাবে, তার প্রতিও যদি লোকটির কোপানোর অস্ত্রটি নেমে আসে তখন সেটি ঠেকাবে কে? যখন আশেপাশের প্রত্যেকটি মানুষের মনে এই একই প্রশ্ন ওঠে তখন অনেকগুলি মানুষ আশেপাশে থাকাও যা, একা একটি মানুষ থাকাও তাই।

কারণ যেদেশে সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় খুন-ধর্ষণ হলে, পহেলা বৈশাখের আনন্দ উৎসবে লাঞ্ছিত হলে, ধর্ষণকারী, খুনি এবং লাঞ্ছনাকারী পার পেয়ে যায়। তাদের টিকিটির টিকটিক আওয়াজও পাওয়া যায় না সেদেশে অপরাধ ঠেকানোর ঠ্যাকা পড়ার লোকের অভাব হবে না তো কোন দেশে হবে?  

একইসঙ্গে পুরুষতান্ত্রিকতা আর নিরাপত্তাহীনতা যখন ডানে-বামে, সামনে ও পেছনে ঘুরপাক খায়, যেখানে অপরাধ করেও, হত্যা করেও, শিক্ষককে পর্যন্ত কানে ধরিয়েও শুধুমাত্র ক্ষমতাসীন দলের ক্ষমতার দম্ভ দেখিয়ে ‘যা ইচ্ছে তাই’ করা যায়, সেখানে বিচার, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা শব্দগুলি নিজেরাই শব্দ করে হাসে!

শেষ কথা হচ্ছে, বদরুল লোকটির প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল কথাটি খুবই হাস্যকর। কথাটি হওয়া উচিত- মৃত্যুর প্রস্তাব দিয়েছিল। কারণ মেয়েটি যদি রাজিও হতো, তবুও অন্য কারণে, অন্য প্রস্তাবে, অন্য বিরোধিতায় মেয়েটিকে মার খেতে হতো, কোপ খেতে হতো। তখন হয়তো মারবার উপায়টি ভিন্ন হতো, কিন্তু পরিণতি এক।

বদরুল নামের লোকটি পশুও নয়, কারণ ‘পশুদের মানবিকতা’ নিয়ে বহু গবেষণা সারা পৃথিবীতে হয়েছে। সেসবের প্রত্যেকটিতেই দেখা গেছে যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পশুরা মানুষের চেয়েও বেশি মানবিক। খুব প্রচলিত একটি প্রবচন আছে- কাক কখনো কাকের মাংস খায় না! কাজেই অন্যায়কে ‘পাশবিকতা’ বা ‘পশুর কাজ’ বলে দায় এড়ানোও কোনো কাজের কথা নয়। অন্যায়কারী কারো ভাই নয়, বোন নয়, পশু নয়, এবং অবশ্যই অবশ্যই প্রেমিক নয়!

তাই বলতেই হচ্ছে- পাপ যে, শয়তান যে, নর নহে, নারী নহে ক্লীব সে!  

শেয়ার করুন: