চলুন পাল্টাই, নইলে আত্মবিসর্জন দিন

সুমু হক: তনু, রিশা, খাদিজা এবং আরো হাজার হাজার নাম।  একেকটা ঘটনা ঘটে, আমরা সোচ্চার হই, ফেসবুক কী টক শোতে ঝড় তুলি এবং তারপর নতুন হুজুগ এলে আবার ভুলেও যাই।  যেদেশে সাধারণভাবেই যে কোন জীবনের কোন নিরাপত্তা নেই, সে দেশে আবার নারীর জীবনের মূল্য! আমরা ভুলে যাই, চাপাটি কি ছুরিটি যার হাতেই থাকুক না কেন, খুনের  দায় কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের! এই সমাজের, এই ঘুনে ধরা মানসিকতার এবং আমার এবং আপনার, যুগে যুগে আমরা যারা নারীকে ঘৃণার, লালসার, বড়জোর করুনার বস্তু হিসেবে দেখে এসেছি।

khadiza-2
খাদিজা নার্গিস

নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে ভিক্টিম ব্লেমিং কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।  সমস্ত পৃথিবী জুড়েই এর চল রয়েছে। বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানে মানুষের বেঁচে থাকার ন্যূনতম প্রয়োজনগুলো মেটে না, সুস্থ শারীরিক এবং মানসিক বিকাশের অবকাশ নেই বলে হয়তো এইরকম চরম আগ্রাসী মনোভাব আরো বেশি চোখে পড়ে।

জ্ঞান হওয়া অবধি শুনে আসছি, এই আমরা মেয়েরাই যত অনিষ্টের গোঁড়া। পৃথিবীর যাবতীয় পাপ, অপরাধ সবকিছুর জন্যে দায়ী আমাদের এই শরীর, তাই খোলা হাওয়ায় মুক্ত আনন্দে বাঁচবার কোন অধিকারই নেই আমাদের।

মনে পরে, আমার তখন বছর বারো বয়স হবে, কোন একটি পত্রিকার ধর্ষণের খবর পড়ে খানিকটা বুঝে এবং খানিকটা না বুঝে খুব কেঁদেছিলাম, বারবার প্রশ্ন করছিলাম, কেন এমন হ’লো!  আমার দাদি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “পুরুষ মানুষরে আল্লাহ যে কি অসহায় কইরা বানাইছে, তার তো আর কোন বাইর নাই।  বেচারারা হাজার চাইলেও নিজেগো সামলাইবার পারেনা। পুরুষের শরীর এমন জিনিস! এইজন্যই তোরে কই সাবধান হ! নিজেরে সামলাইয়া রাখ!”

জৈবিকতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পুরুষেরা যে  কত অসহায়, বাড়ির পুরুষদের বদৌলতে ততদিনে তার প্রাথমিক জ্ঞান হয়ে গেছে আমার। সুতরাং দাদির কথায় আমি ভাবলাম, হবেও বা! আমার বয়োঃসন্ধির কুন্ঠিত শরীর আরো কুন্ঠিত হলো, কুঁজো হয়ে হাঁটতে শিখেছিলাম আগেই, এবার মাথা প্রায় মাটিতে মিশে যাবার জোগাড়!

আমার দাদি স্বশিক্ষিত ছিলেন। বাড়িতে পড়ালেখার চল ছিলো। সাতকাহন থেকে নিয়ে প্রতিভা বসুর আত্মজীবনী গোগ্রাসে পড়তেন তিনি। এতোকিছুর পরও এই হলো আমাকে দেয়া তাঁর উত্তরাধিকার। শুনেছি, আমার জন্মের পর খুব অখুশি হয়েছিলেন তিনি, “মেয়ে হইলো!” সেই মেয়ে সংসারে তাঁর বড় পুত্র এবং পুত্রবধূর ঘাড়ে বোঝা হয়ে থাকবে ভেবে আতংকিত হয়ে থাকবেন হয়তো।

এতো গেলো আমার অভিজ্ঞতা। এ অভিজ্ঞতা নিছক এক মঙ্গলগ্রহবাসীর নয়! আমি জানি, বাংলাদেশের অনেক পড়ি এরই আজও এই মানসিকতা বহমান। কারোটা প্রকাশ্য কারোটা গোপনীয়।

আমার মা একসময় ঢাকা শহরের বুকেই অনাকাঙ্খিত, অসহায় নারী এবং  শিশুদের জন্যে একটা শেল্টার চালাতেন, তার দরকার ছুটে আসা মেয়েদের অভিজ্ঞতা যে কারোর রাতের ঘুম কেড়ে নেবার জন্যে যথেষ্ট ছিলো। এবং যারা এই শেল্টারে আশ্রয় নিতে আসতেন, তারা অনেকেই ছিলেন সামাজিক – অর্থনৈতিক বিচারে প্রিভিলেজড পরিবারে বেড়ে ওঠা মেয়ে। একবার শুনেছিলাম এক ভদ্রমহিলা তার ভাইয়ের ধর্ষণের শিকার কিশোরী সজ্ঞানসম্ভবা মেয়েকে এনে কেঁদে পড়েছিলেন এই বলে, যে এখন তিনি কি করবেন! হাজার হোক, ঘটনার নায়ক তাঁর ভাই তো বটে, সুতরাং এটা তার পরিবারের মানসম্মানের প্রশ্ন। তার কিশোরী মেয়ের যন্ত্রনা তাকে কতটা আলোড়িত করেছিল, জানা হয়ে ওঠেনি।

আজ সেই মেয়েটি কোথায় আছে জানা নেই , কিন্তু এই মেয়েটি কিংবা আমার মতো আরো অনেক মেয়ে হয়তো আজ পৃথিবীসুদ্ধ পুরুষের অসহায়ত্বের দায় হিজাব কিংবা পর্দার আড়ালে মুড়ে নিয়ে মাটিতে মিশে যেতে না পেরে, নেহাত বাধ্য হয়েই দিনগত পাপক্ষয় করে চলেছে।

14501843_10154562762793114_1438537625_n
সুমু হক

আমরা জন্ম নিয়ে শুনি মেয়ে হিসেবে আমরা বোঝামাত্র। শৈশবে কৈশোরে আমাদের শারীরিক সীমাবদ্ধতাগুলো পেরেক ঠুঁকে গুঁজে দেয়া হয় মাথার ভেতর। শেখানো হয়, নারী হিসেবে আমার আলাদা কোন স্বত্বা কি অস্তিত্ব থাকতে নেই। আমি জন্মেছি পিতার অভিভাবকত্বে, বড় হই পিতা কিংবা ভাইয়ের অধীনস্থ হয়ে, যাতে করে পিতৃকুলের সম্মান আমাদের শারীরিক সতীত্ব নামের এক অলৌকিক রাংতায় মুড়ে স্বামীর ঘরে গিয়ে শ্বশুরকুলের  মুখ উজ্বল করি।  এর বাইরে কোন চাওয়া, অন্য কোন সম্ভাবনার কথা ভাবতে নেই আমাদের। বিয়ে ছাড়া মেয়ে মানুষের আবার উদ্ধার হয় নাকি!

এতো গেলো এই সমাজে বেড়ে ওঠা মেয়েগুলোর কথা। এবার একবার ভাবুন তো, এই একই পরিবেশে বেড়ে ওঠা ছেলেরা কোন মূল্যবোধ নিয়ে বড় হচ্ছে! যে ছেলেটি আজীবন তার  মাকে হীনমন্যতায় ভুগতে দেখেছে, দেখেছে মাথা নিচু করে পরিবারের চাপিয়ে দেয়া সব অন্যায় মেনে নিতে, একবার ভাবুন, সে কি করে অন্য আরেকজন নারীকে সম্মান করতে শিখবে, মানুষ বলে ভাবতে শিখবে! মনুষ্যত্বের পাঠ থেকে বঞ্চিত এই অসহায় প্রাণীগুলো দিনশেষে কেবল পুরুষ হতেই শেখে, মানুষ নয়।

তারপর যখন তারা জৈবিকতার মুখোমুখি হয়, একেবারে যেন খেই হারিয়ে ফেলে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ পুরুষের যৌনতার প্রথম পাঠ ঘটে হয় পর্ন দেখে, আর নয়তো পতিতালয় থেকে। সুতরাং নিজের জীবনসঙ্গিনীটির থেকেও ঠিক তাই প্রত্যাশা করে তারা। আর সুস্হ যৌনশিক্ষার ব্যবস্থা যেখানে ছেলেদেরই নেই, মেয়েদের তো আরো শোচনীয় দশা।  তারা কেবল জানে শরীরের সবরকম চাহিদাই পাপ, শুধুমাত্র লাইসেন্সধারী স্বামীটির চাহিদা মেটানো ছাড়া। আর যদিওবা ধীরে ধীরে কোন মেয়ে সাহস করে নিজের ইচ্ছে কিংবা আকাঙ্খা প্রকাশ করেও বসে, ছেলেটি আতংকিত হয়ে পরে, মেয়েটা এত্ত বেশি জানে কি করে? নিশ্চয়ই অনেকের সাথে শুয়েছে সে!

বিছানায় যতই অভিজ্ঞ সঙ্গীর আকাঙ্খা থাকুক, দিনশেষে বেশিরভাগ বাঙালি পুরুষ সেই ট্রাডিশনাল সতী সাবিত্রী রূপটাই আকাঙ্খা করে।  আর তাছাড়া ধর্ম এবং আইন তো শিখিয়েইছে, “তোমার নারী তোমার সম্পত্তিমাত্র, এর বেশি কিছু নয়।” তাই কোন নারীকে চাহিবামাত্র পাইবোনা, এটা আবার হয় নাকি!  প্রেম নিবেদন করে প্রত্যাখ্যাত হলে মেয়েটিকে একটা শিক্ষা দেয়াটা তাই সে কর্তব্য বলে মনে করে।  এতকাল ছিলো মেয়েটিকে দুশ্চরিত্র বলে গুজব ছড়ানো, এসিডে মুখ ঝলসে দেয়া,এখন শুরু হয়েছে নতুন ফ্যাশন ট্রেন্ড, চাপাতি দিয়ে কোপানো। বেশ একটা কেউকেটা ভাব আসে তাতে, আর রাজনৈতিক কোন দলের প্রশ্রয় থাকলে তো কথাই নেই!

ছবি থেকে যতটুকু জেনেছি, তনু এবং খাদিজা দুজনেই হিজাব পরতো, এদের ক্ষেত্রে চরিত্রে কালি ছেটাতে হয়তো খানিকটা বেগ পেতে হতো, কিন্তু তবুও কি কেউ এখনই বলছেন, যে নিশ্চয়ই ওদের কোন দোষ ছিল! ছেলেমানুষ, নাহয় একটু দুষ্টুমি (যতদূর মনে পড়ছে এই ধরণের আরেকটি ঘটনায় ঠিক এই শব্দটাই উচ্চারণ করেছিলেন একজন জনপ্রিয় “প্রগতিশীল” লেখক) করেই ফেলেছে, তাই বলে ওদের এতবড় শাস্তি দিতে হয়! সুতরাং মাটিতে মিশে যাক তনু আর খাদিজার দেহ, ওদের অস্তিত্ব, ওদের আত্মসম্মান। আমাদের তাতে কিইবা করার আছে!

আমাদের দেশের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় নেতারা ফতোয়া দিয়ে তেঁতুল জাতীয় নারীদেহ ঢেকে রাখবার সৎ পরামর্শ দেবেন, প্রতিবেশী ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক নেতারা দাবি করবেন, ধর্ষিতা মেয়েটি কেন ধর্ষকটিকে ভাই ডেকে বসেনি, তাহলেই তো হতো (যেন এখন থেকে মেয়েরা ব্যাগে কয়েক ডজন রাখি নিয়ে ঘুরলেই সব বিপদ থেকে মুক্ত থাকতে পারবে) , এমনকি এই আমার শহর টরোন্টোর মতো জায়গাতেও খোদ পুলিশের প্রতিনিধি “ধর্ষণের জন্যে বেশ্যাদের মত কাপড় পড়া মেয়েরাই দায়ী” এমন বক্তব্যের সাহস রাখেন। পার্থক্য একটাই, এখানে তার প্রতিবাদ হয়, অনেক ঝক্কি এবং অবমাননার পরও একজন ধর্ষিতা নারী বিচার প্রত্যাশা করতে পারে, বাংলাদেশে সে স্বপ্ন এখনও অলীক বৈকি!

আমি তাই আর এখন খুব বড় কোন বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিনা। এমনকি অনেক তথাকথিত প্রগতিশীলদের আচরণও আজকাল খুব হতাশ করে।  যুগে যুগে এই সমাজই আমাদেরকে কখনো অগ্নিপরীক্ষা দিতে বাধ্য করেছে, তো কখনো ডাইনি অপবাদ দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। প্রেমের প্রস্তাবে রাজি না হলেই অত্যাচার, এমনকি অনলাইনেও যার হাত থেকে রেহাই নেই আমাদের। শুরু হয়ে যাবে সাইবার বুলিইং। তার চেয়ে বরং চোখ বুজে থাকি আর ভাবতে থাকি কি করে অসহায় পুরুষদের প্রবৃত্তি উসকে দেয়া এই শরীরটাকে জব্দ করা যায়।  ভালো কথা, ইজিপ্টের পার্লামেন্টে একটা নতুন আইন উত্থাপিত হয়েছে শুনেছেন তো? কুমারিত্বের পরীক্ষায় পাশ না করলে সেখানে নাকি এখন থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারবে না মেয়েরা। অন্তত  চেষ্টার ত্রুটি নেই কোন।

আপনি পাশ্চাত্যের কোন দেশে থাকেন? তাতেও সমস্যা নেই, বাড়ির মেয়েটির উপর যথেচ্ছা অত্যাচার করে তাকে বেশ একটা ট্রেডিশন বলে চালিয়ে দিলেই হ’লো।  অবশ্য এতে অপরাধীর পার পেয়ে যাবার পুরো নিশ্চয়তা না থাকলেও বহুসংস্কৃতি ও ব্যক্তিস্বাধীনতার পূজারী অনেক দেশেই সমাজকল্যাণ সংস্থাগুলো এ ধরণের ক্ষেত্রে কোন পদক্ষেপ নেবার আগে অন্তত দশবার ভাবে যে এতে করে কারো ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাঘাত ঘটলো কিনা। কালচারাল সেন্সিটিভিটির কথা ভেবে সমাজকর্মীরা সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করায় এই ক্যানাডাতেও অনার কিলিং এর মতো ঘটনা ঘটেছে বহুবার।

তাই বলছিলাম, বিচার চেয়ে কোন লাভ নেই, রাজনীতি কিংবা আইন কোনোটাই খুব সহজে পাল্টাবার নয়। পাল্টাবে না সমাজও, যদিনা আমরা আমাদের পচে যাওয়া ভাবনাগুলোকে পাল্টাই।  চলুন পাল্টাই। সময় কিন্তু আমাদের ক্ষমা করবে না।  

 

শেয়ার করুন: