মীর সুরমা: নিকোলার সাথে আমার দেখা হয় ২০১৫ এর শেষের দিকে। আমরা উপরের তলায় আর ও নিচ তলায় থাকতো একই বিল্ডিং এ। তাকে যখন প্রথম দেখি, অনেক ভয় পেয়েছিলাম। কারণ সে প্রচণ্ড রকমের মদ্যপI আর প্রতিদিন এতো বেশি মদ পান করে যে, প্রায়ই দেখি ওর বন্ধুরা ওকে বাসায় নিয়ে আসতো।
ওকে দেখে প্রায়ই ভাবতাম এটাই কি ওর জীবন! প্রায় সময়ই ওর সাথে কথা বলতে চাইতাম, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই মাতাল থাকতো, তাই সেটা আর হয়ে ওঠেনি।
যাই হোক, ও একদিন আমার কাছে খাবার চাইতে আসছে, যদিও ইউকে সরকার এসমস্ত homeless দের থাকা-খাওয়ার পয়সা দেয়। ওই পয়সা যাদের বাজে অভ্যাস ওরা দুই দিনেই শেষ করে ফেলে। ফলে আগামী সপ্তাহের পয়সা আসার আগ পর্যন্ত ওরা ফকির। তবে ওরা আসলে প্রকৃত গরীব না। যাই হোক আমি তাকে খাবার দিলাম, যদিও আমার বর ওদের একদমই সইতে পারে না এবং বারংবার নিষেধ করে ওদের বাসায় অনুমতি না দিতে।
আইনজীবী মানুষ তো! সব কিছুতেই যেন খালি ভেজালের গন্ধ খুঁজে। কিন্তু সেদিন মেয়েটিকে সত্যি খুব অসহায় লাগছিল। শীতে থর থর করে কাঁপছিল। শরীরে তেমন কোন কাপড় ছিল না। হোক সে মদারু, মানুষ তো! তাই মন চাইলো নিজেরই কিছু পুরান কাপড় দেই, এবং দিলামও। এছাড়াও আরও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস দিলাম। এখন সে রীতিমত প্রায় ই খাবার নিতে আসে, আমি ও মন ওজার করে দেই এই তৃপ্তি নিয়ে যে অন্তত একজনের ক্ষুধা তো নিবারণ করতে পারছি। এরপর থেকে সে আমাকে ‘মাম’ বলে ডাকে এবং প্রতিটি জিনিস পাওয়ার পর ডুকরে কাঁদতো, কারণ ওদের কোনো পরিবার নেই, কোথায় বাপ-মা সেটাও বলতে পারে নাI
কয়েকদিন পর সে আমাদের বিল্ডিং থেকে অন্য কোথাও চলে গেছে, কোথায় গেছে জানি না। ওকে নিয়ে মাথাব্যথাও নেই। মাথাব্যথা হয় ওই সমস্ত স্টুপিড বাপ- মাদের জন্য, যারা বাচ্চাদের উপযুক্ত যত্ন না নিয়ে রাস্তায় ফেলে চলে যায়। আমি অভিশাপ দেই ওইসব বাপ-মা’কে যারা একটা নিষ্পাপ বাচ্চাকে পৃথিবীর আলোতে এনে ঘোর অন্ধকার রাস্তার দিকে ঠেলে দেয়। যার ফলে সমাজে হাজারো নিকোলার সৃষ্টি হয়।
ছোটবেলায় লোকমুখে শুনতাম ইউরোপ, আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সন্তানের বয়স ১৮ বছর হলেই বাবা-মা বাচ্চার সাথে আর যোগাযোগ রাখে না। আলাদা হয়ে যায় একে অপর থেকে। আমি এরসাথে একদম একমত না। কারণ বহু ইংরেজ পরিবার আছে যারা এখনো ছেলেমেয়ে, ওদের জামাই-বউ, নাতি-পুতি নিয়ে ওদের ছুটির দিনগুলো উপভোগ করে।
আর ছন্নছাড়া! সেটা তো কমলাপুর বস্তি থেকে শুরু করে লন্ডনের গৃহহীনদের জন্য বরাদ্দ ভবনগুলোতেও আছে। কিছুসংখ্যক সুবিধাভোগী স্বার্থপর বাপ-মা আছে যারা নিজের চাহিদা মেটাতে গিয়ে, নিজের সুখ হাসিল করতে গিয়ে আর একটা জীবনের কত বড় সর্বনাশ ডেকে আনছে সেদিকে খেয়াল নেই।
আসুন, আমরা আমাদের বাচ্চাদের অবহেলা নয়, ভালবাসা দেই। একটু সময় দেই। ওদের ভাবনার কদর করি। ওদেরকে মানুষ হিসাবে গড়ে তুলি। যেন নতুন কোনো নিকোলার আবির্ভাব আমাদের মাঝে না হয়। আর এই দায়িত্ব কারও একা নয়। এটা আপনার, অামার, আমাদের। নয়তো পস্তাতে হবে সেই আমাদেরই।
আমাদের দেশেও এমনটি দেখা যায় তবে ভিন্ন ভাবে। সন্তান জন্ম দিতে পারলেই বুঝি তাদের কাজ শেষ মনে করে। আমার ইঙ্গিত কোথা আশা করি সেটা বুঝতে পেরেছেন।