আসুন, ভদ্রতা শিখি, সভ্য হই

নায়না শাহরীন চৌধুরী: ভদ্রতা-সভ্যতা খুব সাধারণ শব্দ। কিন্তু এই দুটো জিনিস সবাই আত্মস্থ করতে পারেন না। এই ভদ্রতা-সভ্যতা না থাকার কারণে অনেক বড় বড় ক্রাইম ঘটে পরবর্তীতে। মেয়েদের আমরা এই জিনিসটা খুব ভালোভাবে শিখিয়ে দেই। পরিবার শেখায়, সমাজ শেখায়। কিন্তু পুরুষ মানুষের ব্যাপারে আমরা অন্ধ।

naina
নায়না

জন্ম থেকেই যদি শুরু করি তাহলে দেখা যাবে, ঘরে-বাইরে যেসব শিশু আপনি দেখেন তাদের পরিচয় না জানলেও তারা যে অধিকাংশ ছেলে শিশু সে ব্যাপারে আপনার সন্দেহ থাকে না। তাদের বাবা-মা তাদের নগ্ন রাখতে মেয়ে শিশুদের থেকে বেশী স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। আমি অনেক দেখেছি, মায়েরা মেয়ে শিশুদের ক্ষেত্রে জননেন্দ্রিয় ঢাকাটা যত জরুরি মনে করে, ছেলে শিশুদের ছেলেত্ব প্রদর্শন যেন ততটাই গৌরবের।

এখন আসি বাঙালী পুরুষদের খুব কমন কিছু অসভ্য আচরণের লিস্ট নিয়ে:
১/ পথে ঘাটে তাদের পরিধেয় কাপড় অনাবৃত করে গা ও আপত্তিকর অংশ চুলকানো, হাত বোলানো, আন্ডারওয়্যার অ্যাডজাস্ট করা ২/ শব্দ করে কফ ফেলা, নাক ঝারা;
৩/ যেখানে-সেখানে জল বিয়োগের জন্য গোপনাঙ্গ বের করা;
৪/  মেয়েদের বুকের দিকে চেয়ে থাকা;
৫/  নিজের মাকে যতই শ্রদ্ধা করুক, গালিতে কারও মাকে অপবিত্র না করলে শান্তি পায় না।
মনে হয় পৃথিবীতে কেউ তাদের দেখে না। কেউ ইভটিজিং না করলেও আমি নিশ্চিত এরকম পুরুষের সাথে আপনারা অপরিচিত নন।

এরকম পুরুষ ছড়িয়ে আছে গলিতে গলিতে। আমরা চোখ বাঁচিয়ে চলি, যেভাবে ডাস্টবিনের পাশ কাটিয়ে হাঁটি সেভাবে। আচ্ছা, ভাবুন, কোন মধ্যবয়স্ক নারী, কামিজ উঠিয়ে পেট চুলকাচ্ছে আর শব্দ করে কফ ফেলছে। অথবা উপরের কোন একটা কাজ করছে। অর্থের মাপকাঠিতে তার অবস্থান যাই হোক না কেন, খুব কি দৃষ্টিনন্দন লাগছে? পাগল বা বদ কেউ মনে হচ্ছে, তাই না? তাহলে যে শিক্ষাটা ছোটবেলা থেকে গরীব, মধ্যবিত্ত  উচ্চবিত্ত পরিবার, সব শ্রেণীর মেয়েদের যেমন করেই হোক শেখানো হয়, সেটা ছেলেদেরকে শেখানো যায় না কেন?

ওহ হো! ওরা তো ছেলে! ওরা একটু এমনই…। ছেলেমাত্রই কি খারাপ?
আসল কথা হলো, ছোটবেলা থেকেই ওরা আমার-আপনার আচরণে বুঝে যায়, এ সমাজে ওরা ন্যাংটো থাকতে পারে, বোনটির পাতে পড়ুক বা না পড়ুক তার ভাতের প্লেটে মুরগির রান পড়ে, মেয়েদের চাপাস্বরে বাজে কথা বললে কেউ প্রতিবাদ করতে আসে না, রাস্তায়, বাসে এখানে-ওখানে হাত দেওয়া যায়, যেখানে-সেখানে মূত্র ত্যাগ করা যায়, বাড়িতে মা কাজ করতে দেয় না। কী সুখ!

আমি বলছি না আপনার ছেলেকে দিয়ে বাড়ির সব কাজ করান। বাঙালী মায়েরা সেটা কতোটুক পারবেন সে ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে। আপনার পারিবারিক অবস্থান যাই হোক না কেন, আপনার ছেলে সন্তানটিকে ভদ্রতা ও সভ্যতা অন্তত শেখান। অনেক পড়াশোনা জানা পুরুষও এই জিনিসটা শিখতে পারে না। এই শিক্ষাটা যদি গোড়াতেই মাথায় গেঁথে দেওয়া যায়, অন্তত আপনার সন্তান পরবর্তীতে অনেক অপরাধ থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখার শক্তি পেতে পারে।
ছেলেদের নিয়ে অনেক বললাম।

এবার কিছু সামাজিক অসভ্যতার কথা বলি, যেগুলো আমরা সহ্য করি প্রতিনিয়ত। এবং এসব অসভ্যতা ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে করে থাকেন।
১/ কোন দম্পতি এখনো সন্তান লাভ করেননি, তাকে বারবার এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা। এ ধরনের প্রশ্নগুলো আসে বয়স্ক নারীদের থেকে এবং কোন দম্পতি যদি সন্তান লাভের ব্যাপারে প্রাকৃতিকভাবে চেষ্টা করে থাকেন, সেটা জানতে চাওয়া , জ্ঞান ঝারা এবং সেটা জানানোর মধ্যে যে অপরিসীম অসভ্যতা লুকিয়ে থাকে সেটা আমরা হজম করে নেই।
২/ কোনো মেয়ের বিয়ে হয়নি, এবং কেন হচ্ছে না, সেটা জানার আগ্রহের মধ্যে একটা অযাচিত অসভ্যতা থাকে।
৩/ কোনো মেয়ে ডিভোর্সি, ঐ মেয়ে খারাপ বলেই এমন, এটা ভাবার মতো অসভ্য নিশ্চয়ই হতে চাইবেন না।
৪/ কোনো দম্পতি দ্বিতীয় সন্তান নেবেন কি নেবেন না অমন ব্যক্তিগত ব্যাপারে তৃতীয় কারো, তিনি যতই ঘনিষ্ঠ হোন না কেন, সেটার ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ কি অশালীন নয়?
৫/ আপনার বান্ধবী বা স্ত্রী খুব সিরিয়াস কথা বলছেন, তার মাঝখানে হঠাৎ বলে উঠলেন,”‘তোমার  ওড়না ঠিক কর বা ক্লিভেজ দেখা যাচ্ছে’”, এতে আপনার মানসিক গণ্ডি পরিষ্কারভাবে ফুটে ওঠে। উনি যা বলছেন তার থেকে উনার দেহ আপনার কাছে বেশী মনোযোগের বস্তু। আপনি কিরকম ভদ্রতার পরিচয় দিলেন?

অনেক কিছুই আছে, লিখতে গেলে উইমেন চ্যাপ্টারের সার্ভার হ্যাঙ করবে। সেটা চাচ্ছি না। তারচে’ বরং আসুন, আমরা ভদ্রতা শিখি। ব্যবহারের অ আ ক খ গুলো আবার ঝালাই করে দেখি আমরা ঠিক কটটুকু সভ্য।

আমরা কেউই পারফেক্ট নই। কিন্তু সেটা স্বীকার করার আর শেখার মানসিকতা কি আমাদের আছে? আর অন্যান্যদেরও বলছি, যারা এই ভদ্রতাটুকু শেখেননি , আমাদের সবার দায়িত্ব সেটা তাদের শেখানো। কারণ তারা তাদের সন্তানদের তাদের মতো করেই বড় করবেন আর আমরা সেরকম একটা প্রজন্ম টেনে বেড়াবো, তা ঠিক কাম্য হতে পারে না।

মুখ চেপে আবর্জনার গন্ধ এড়ানো গেলেও আবর্জনা এড়ানো যায় কি?

: লেখক, ও  সংগীত শিল্পী

শেয়ার করুন: