আলফা আরজু: দীঘল কালো জলের শ্যামা পুকুর- রবি নিয়োগী (কমরেড) দাদুর বাড়ি-লক্ষ্মীদি (মায়ের বন্ধু ও বাবার বন্ধু-পত্নী মাসী বা কাকী ডাকার কথা, কিন্তু আমাদের সবার কাছে দিদি), বড় ও ছোট (প্রয়াত) জেঠী, বাবুয়া দা, জবা-বুড়ি (প্রয়াত)-চিনু-মিনু দি-বড়বৌদি- সঞ্চয় (সঞ্চয় অধিদফতরের কর্মকর্তা) কাকু-কাকী, শিল্পী, সুজিতা, অজিতা, শিবানী।
কারোর কারোর সাথে একই ক্লাসে পড়া ও বাকিরা দাড়িয়াবান্ধা-গোল্লাছুট-বউচি-সাতচারা-কানামাছি খেলার সাথী। চলন্তিকা যুব সংঘ। মঞ্চ নাটক। খেলার ম্যাচ। বাৎসরিক পিকনিক -গজনী পাহাড় বা টাঙ্গাইলের মধুপুর।

এইসব মানুষ আর প্রেক্ষাপট আমার শৈশবের সাথে এমন করে মিশে আছে – পৃথিবীর যেকোনো প্রান্ত থেকে ওদের অনুভব করা যায়। কনকনে শীতের সকালে বাজি লেগে দীর্ঘ শ্যামা পুকুরের এপার-ওপার চিল-সাঁতার অথবা ডুব।
ওইটা “নাগ বাড়ি”, ঐটা “লক্ষ্মীর বাড়ি”, “রবি নিয়োগী বাড়ি” “কামাক্ষ্যা বাড়ি”, “সাঁইদানির বাড়ি”, হিরো কাকুর বাড়ি (এই বাড়ির একটা নেতিবাচক পরিচয় আছে- দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে হিরো কাকু, বাবলু কাকুরা বীর মুক্তিযোদ্ধা, কিন্তু উনাদের বোন জোৎস্না, অপর নাম ‘নুরুন্নাহার’ ফুফুর বিয়ে হয়েছিল জামাতের নেতা কামারুজ্জামানের সাথে)।
শেরপুর জেলার নাগপাড়া-গৃদানারায়ণপুর-রাজবল্লভপুরের গল্প। “নাগ বাড়ি” আমাদের আড্ডাখানা। চাঁদা তুলে VCR এ সিনেমা, টিভিতে ধারাবাহিক নাটক- সব কিছুই ওই বাড়িকেন্দ্রিক। বিকালে খেলার পর ঠিক সন্ধ্যার আগে শ্যামাপুকুরে হাত-মুখ ধুয়ে সবাই চিরুনি নিয়ে বৌ’দির কাছে। নাগবাড়ির প্রবেশপথের সুন্দর সিঁড়িতে অথবা শ্যামা ঘাটে বসে চুল বেণী।
ওই বাড়িতে যখন জবাদি’র অথবা বাবুয়া দা’র বিয়ে হলো – আমাদের কাজের শেষ নাই। সারাদিন-রাত আমরা ওই বাড়ির মানুষ। খাওয়া-দাওয়া সব। পূজা- আমরা সবার আগে। আবার আমাদের বাড়িতে সকাল-বিকাল জেঠিরা-দিদিরা আসে- চা-মুড়ি খাই, গল্প করেন। কারোর ধর্ম নিয়ে উত্তেজনা মনে পড়ে না। আম্মার কত ঘোর বিপদে উনারা সবাই পাশে। আবার বৌদি বা দিদিদের কারোর বাচ্চা হবে – কাকী (আম্মা) পাশে থাকেন। রাত ১ টা নাই, তিনটা নাই – আম্মা অস্থির হয়ে দৌড়ান।
কোনোদিন আমাদের একা মনে হয় নাই। আমাদের যখন বাড়ির কাজ চলে- সকাল বিকাল তহুর কাকু (শেরপুর সরকারি মহিলা কলেজের প্রাক্তন প্রিন্সিপাল) আসেন – খোঁজ খবর নেন। ইট-বালু-সিমেন্ট কিনতে হবে – তহুর কাকু, রাজ্-মিস্ত্রি ঠিক মতো কাজ করছে না – কাকু। আব্বা টাকা দিয়ে যায় কাকুর হাতে – কী বিশ্বাস আর সম্মানের সম্পর্ক।
কাকডাকা ভোর কিংবা আমাদের ডাকে কাকের ভোর – বড় জেঠির পূজার ফুলের গাছে হামলা, বরই গাছে বা আম গাছের নিচে- অবস্থান। স্কুলে ফলাফল খারাপ – নিজের মায়ের বকার আগে- জেঠি কিংবা দিদিরা ধরতো “এই এতো খারাপ করলি বাবা-মা খুব কষ্ট পাবে”। বিপদ-আপদে আম্মা আত্মীয়-স্বজনের কথা না ভেবে আগে লক্ষীদি অথবা জেঠিদের কাছে যান – পরামর্শের জন্য। উনারাও তাই করেন।
এইতো সেদিন ছোটবোন আরিফা ইন্দোনেশিয়া যাচ্ছে অফিসের ট্রেনিং এ। আম্মা ঢাকা এসেছেন ওর বাচ্চার কাছে থাকতে। ফোনে আম্মারে বললাম – কী অবস্থা আম্মা? আম্মা একটু কি বিষন্ন ছিলেন- জানি না। কিন্তু বললেন – তাড়াতাড়ি শেরপুর ফেরা উচিত -তোর ছোট জেঠি মারা গেছেন-শ্রাদ্ধ-অনেক লোকজন আসবে। বড়বৌ সারাদিন আন্না (আমার ভাবী) কে বলছে – কাকিরে তাড়াতাড়ি আসতে বল। দেখি “আরিফা আসলেই চলে যাবো”। আমার কেমন যেন অস্থির লাগলো- কী সম্পর্ক? কী দারুণ সম্পর্ক?
আমি আর কথা বাড়ালাম না। শেরপুরে ফোন দিলাম। এইবার দেশে গিয়ে – জেঠিকে দেখে এসেছি – বিছানায়- আপুকে ধরে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। আমি আবার কান্না সহ্য করতে পারি না। তাই বের হয়ে বড় জেঠির কাছে গেলাম। বৌদি বরইয়ের আচার দিলো- খেলাম। আমার মনে হয় ছোট জেঠি- উপরে যেয়ে আব্বার সাথে দেখা করে বলবেন – “মাস্টার ভাই- চিন্তা কইরেন না,মাহবুব-আলেয়া-আরজু-আরিফারা সবাই ভালো আছে। নেন, চা খান।”
আম্মা ও লক্ষীদি প্রায় বিকেলে রবি দাদুর বাসায় যেতেন – গল্প করতে। সাথে আমি দেড় ব্যাটারি অথবা আরিফা। আমার আকর্ষণ – দাদুর বাড়ির গোপন দরজা (যুদ্ধের সময় শত্রুরা আক্রমণ করলে দাদু বাড়ির সবাইকে নিয়ে ওই দরজা দিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতেন), পুকুর ঘাট, করমচা অথবা বরই গাছ, চা-বিস্কুট (ওই সময়- কেউ চা খাইতে দিতো না- বেড়াতে গেলে তো আর কিছু বলা যায় না!)। আর আরিফা দাদুর নাতনি পাতা’র সাথে খেলতো।
আম্মা দাদুর কাছে নিয়ে বলতেন – যা দাদুর কাছ থেকে কোন বই পড়বি জেনে নে। লক্ষীদি বলতো – দাদুর কাছে গল্প শুনে যা। দাদু-ঠাম্মার গল্প। রাজনীতির গল্প। দাদুকে আন্দামানে নির্বাসন দেয়া হলো সেই গল্প। তেমন কিছুই বুঝতাম না। কিন্তু দাদুর বাড়িটা আমার কাছে সবসময় রহস্য ও বিস্ময়। এই বাড়িতে একসময় কত বড় বড় রাজনীতিবিদরা আসতেন। দাদুর কী বৈচিত্রময় রাজনৈতিক জীবন! ঠাম্মা’র ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে যুদ্ধ। কত কিছু!
এখন শ্যামাপুকুর-কামাখ্যা বাড়ি নাই- ওখানে ৮/১০ টা বহুতল ভবন। কিন্তু সেই সম্পর্ক এখনো জীবন্ত।
দিল্লিতে আমরা যখন IIMC (Indian Institute of Mass Communication, New Delhi ২০০৫) তে পড়তে গেলাম – লক্ষ্মীদি ওর বোনের মেয়ে (দিল্লীতে থাকেন) কে বলে দিলেন – আমাদের দেখতে যেতে। সেই খবর পেয়ে- উনি চলে আসলেন- IIMC এর হোস্টেল এ। দিদি ও জামাইবাবু আমাদের (নাজনীন, রোজিনা, মন্টি)-কে দিল্লী হাটে ঘুরতে নিয়ে গেলেন – খাওয়ালেন। কী আন্তরিকতা!
আমার ছোটবোন কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল এ প্রথম চাকরি কিশোরগঞ্জে। কোথায় থাকবে? – জবাদি’র বাসায়। কোনো জড়তা নেই।
বিভিন্ন সময় পত্রিকায় পড়ি মুসলমানরা হিন্দুদের পুড়িয়ে দিচ্ছে-মেরে ফেলছে- নানা অনাচার। আমার অবাক লাগে- কীভাবে ওরা এইসব করছে? মনটা খারাপ হয়ে যায়। লজ্জা-ঘৃণা-ভয় হয়।
মনে মনে প্রার্থনা করি – আমাদের আব্বাস হুজুর যেন এমন না করেন। আব্বাস হুজুর যেন কাউকে ধর্মের কথা বলে উস্কিয়ে না দেন। ছোটবেলায় দেখা আব্বাস হুজুর যেন বদলে না যান। উনি কত অমায়িকভাবে জেঠিদের সালাম দিতেন, ঘন্টার পর ঘন্টা আমাদের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আম্মা-জেঠিরা-তহুর কাকু-আব্বাস হুজুর-লক্ষীদি গল্প করেছেন। দেশের রাজনীতি থেকে শুরু করে- পাড়ার কে কেমন আছেন সব।
আজানের সময় আব্বাস হুজুর মসজিদে চলে যেতেন। লক্ষীদি ও জেঠিরা সন্ধ্যাবাতি ও পূজা দিতে বাড়ি।