ধর্মের রকমফেরে বিচলিত নই আমি

আনন্দ কুটুম: কোনো না কোনোভাবে দুর্গা আমার অতীব প্রিয় একটি কনসেপ্ট। পূজো ঘনিয়ে আসছে। কলকাতা এখন উৎসবের শহর। পৃথিবীর সব থেকে বড় দুর্গা (৮২ ফিট) তৈরি হয়েছিল গত বছর। খুব কম মানুষেরই সেটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। সরকারি অনুমতি-টনুমতির কীসব অজুহাতে সেটা দ্বিতীয় দিন বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমি দেখেছিলাম নির্মাণের সময়ই। ঠিক যেন ইয়া বড় একটি নারীশ্বর তার খড়গ উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শহরের মাঝখানে। এবার সেই একই বেদীর উপর তৈরি হচ্ছে হাজার হাতবিশিষ্ট বা সহস্রভুজা দুর্গা। মানে দশ হাতের জায়গায় যার হাত থাকবে ১০০০টি।

durgaঅন্য একটি মণ্ডপে তৈরি হচ্ছে কমন জেন্ডার দুর্গা। যার অর্ধেক নারী, অর্ধেক পুরুষ। গতকাল সকালেই সংবাদটা পেয়েছি। খুব মজাও পেয়েছি। দীর্ঘদিন যাবত সভ্য সমাজে নিগৃহীত হিজড়ারা এবার নিজেরাই মণ্ডপ বসিয়েছে। যিনি এই দুর্গা গড়েছেন তিনিও একজন নারী মৃৎশিল্পী। বলা হচ্ছে, ইতিহাসের প্রথম নারী শিল্পী যিনি দুর্গা গড়েছেন। এর আগে দুর্গা গড়ার এই সম্মানিত কাজটা পুরুষের হাতেই বন্দী ছিল। নারী যদি মানুষ জন্ম দিতে পারে, তবে নিশ্চয়ই দেব-দেবীও জন্ম দিতে পারবে।

অনেকে দুর্গার সাথে নারীকে তুলনা করে মহিমান্বিত করে। কিন্তু আমার ঠিক মনে হয়, দুর্গাই হলো নারীর কিয়দংশের প্রতিচ্ছবি। নারীর যে ক্ষমতা তার খুব কমই আমরা দুর্গার রূপে দেখতে পাই।

আমি আগেও বলেছি, ঈশ্বরের নিজের বলে কিছুই নেই। যা আছে সবই মানুষের দান। ১৮ শতকের দুর্গা, ১৫ শতকের দুর্গা, ১৯ শতকের দুর্গা আর আজকের দুর্গা এক নয়। আজকের দুর্গা আরো অনেক বেশি আকর্ষণীয়। দুর্গার গায়ের রঙ এখন আর হলুদ বা গোলাপী না। অনেক বেশি রিয়েলিস্টিক। হাত-পায়ের শেপগুলো নিখুঁত। গহনার ডিজাইনগুলো আধুনিক। সময় যতো গিয়েছে দুর্গা ততোই সাধারণের কাতারে নেমে এসেছে, সাধারণের মতোই সুন্দরী হয়েছে। মানুষ তার মনন আর শিল্প ঠেলে তাকে আরো সুন্দর করে তুলেছে। বাস্তবে নারী যতোটা সুন্দর হয়েছে, দুর্গাও তার অনুরূপ হওয়ার চেষ্টা করেছে মাত্র।

কিন্তু আমার কাছে সব থেকে আকর্ষণীয় বিষয় হলো দুর্গা নিয়ে যে এই এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে সেটা। কোথাও দুর্গা হয় সিস্টার নিবেদিতার রুপে, কোথাও মাদার তেরেসার রূপে, কোথাও রানী ভিক্টোরিয়ার আদলে। এসব কিছু পেছনে ফেলে দুর্গা আজ সহস্রভুজা দেবী। সব চেয়ে দারুণ কনসেপ্ট হলো, হিজড়া দুর্গা। দুবছর আগেই কলকাতার নামকরা যৌনপল্লী সোনাগাছীতেও দুর্গা পূজা শুরু করেছেন যৌনকর্মীরা। এটাও ছিল একধরনের সংস্কার ভাঙারই পদক্ষেপ। দেবদেবীর দায় সবার প্রতি। তাদের আলাদা লিঙ্গ না থাকাই ভালো।

anando-kutumসেদিন পড়লাম, কোন দেশ নাকি সমকামিদের মসজিদে নামাজের অনুমতি দিয়েছে। আবার আমেরিকার কোন মসজিদে নাকি নারী ইমাম পুরুষদের নামাজে ইমামতি করেন। শুনে খুব তৃপ্ত হয়েছি। আল্লাহর ঘরের প্রতি হক সবারই থাকা উচিৎ।

ধর্ম খুব পার্সোনাল বিষয়। ঈশ্বর বিশ্বাসও ব্যক্তিগত। আমার ঈশ্বর, আপনার ঈশ্বর এক রকম নাও হতে পারে। আমার ধর্ম, আপনার ধর্ম একই রকম গঠনের নাও হতে পারে। তাই কেউ যদি বলে, আমি দিনে ১০ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, তাতে আমি খুব একটা বিচলিত হই না। কেউ যদি বলে, রোজ রাতে আমার পাশের বিছানায় ঈশ্বর এসে ঘুমায়, তাতেও আমি বিচলিত হই না। কাল যদি কোন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ কৃষ্ণবর্ণের দুর্গা প্রতিমা গড়েন, তাতেও তো বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। বিশ্বাসেই তো মিলায় ঈশ্বর, তর্কে বহুদূর।

 

শেয়ার করুন: