ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী: সদাহাস্যময়ী, প্রাণচঞ্চল রুবানা জেরিন আহমেদ। “আহমেদ” নামটা বৈবাহিক সূত্রে যোগ হয়েছে। এতে রুবানার খুব একটা ইচ্ছে ছিলো না। কিন্তু রুবানার “উচ্চ শিক্ষিত” শ্বশুরালয়ে বিয়ের পর মেয়েদের নামের পাশে স্বামীর নাম না থাকাটাকে এক ধরনের ঔদ্ধত্য বলে ধরা হয়। তাই স্বেচ্ছায় না হলেও অন্যের ইচ্ছেকে সম্মান দেখাতেই রুবানা জেরিনের সাথে “আহমেদ” যুক্ত হয়েছে।
মাত্র একমাস হলো নামী একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে জীবনের প্রথম চাকরিতে যোগ দিয়েছে রুবানা। নতুন জায়গা, কাজের পরিবেশ সবই সে বেশ উপভোগ করতে শুরু করেছে। কিন্তু খুব কাছাকাছি সময়ের মধ্যে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি অধ্যায়ে পা রাখতে হয়েছে রুবানাকে।

এই শহর,পরিবার এবং কর্মক্ষেত্র সবই তার কাছে নতুন। তাই এখনো মানিয়ে চলতে হিমশিম খাচ্ছে।
মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা রুবানার। দীদা, মা-বাবা আর রুবানারা দুই বোন মিলে সাজানো সংসার। একই শহরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছে সে। ছোট বোন রুচিরা এখনো কলেজের চৌকাঠ পেরোয়নি। দুই বোনই দীদা অন্ত:প্রাণ। তাদের দীদা হাস্না বানু একজন বইপ্রেমী, উদারচিত্ত মানুষ। পুত্র,পুত্র-বধূ আর দুই নাতনিকে বটের ছায়া দিয়ে সস্নেহে আগলে রেখেছেন। তাঁর উৎসাহ আর সহযোগিতাতেই রুবানার মা সুরাইয়া পারভিন স্কুলে পড়ানোর কাজটা নির্বিঘ্নে করতে পেরেছেন।
পুরনো দিনের মানুষ হলেও হাস্না বানু পুরনো ধ্যান-ধারণা নিয়ে বসে থাকেননি। বাড়িতেই কোণার ঘরটা পরিষ্কার করে নিজের সংগ্রহে থাকা বইগুলো সাজিয়ে ছোট্ট পাঠাগার তৈরি করেছিলেন। এখনো পাড়ার ছেলেমেয়েরা তার পাঠাগারে বই পড়তে আসে। সোনালি ফ্রেমের চশমা পরা মহীয়সী হাস্না বানু পরমযত্নে বইগুলোকে ঝেড়ে-মুছে রাখেন। তাঁর কাছ থেকেই রুবানার বই এবং পত্রপত্রিকা পড়ার নেশা শুরু।
দীদার সাথে তার মহা বন্ধুত্ব। ছোট্টবেলা থেকে জীবনের সব কথা সে দীদার সাথে অকপটে শেয়ার করেছে। বই, সিনেমা, রাজনীতি, চলমান বিশ্ব, ক্যারিয়ার কোনো আলাপই বাদ যায়নি। এমনকী সাইকেল চালানোর সময় কোন ছেলে রোজ তাকিয়ে থাকতো, কীভাবে সে রুবানাকে দিতে গিয়ে রুচিরাকে প্রেমপত্র দিয়ে বসলো – এসব অর্থহীন কত কিছু নিয়েই তারা গল্পে মেতে উঠতো।
ইচ্ছে ছিলো লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকতেই বাবার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ের কথা ওঠে। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হাসিবের পরিবারের সবাই উচ্চশিক্ষিত। ঢাকাতে স্থায়ী নিবাস। দীদা জানতেন, তার নাতনির মনের খবর। তাই শর্ত জুড়ে দেন, বিয়ের পর মেয়ে চাকরি করবে, তাতে কোনো বাধা দেয়া চলবে না। হাসিবের মা সুলতানা আহমেদ ঢাকার একটি নামী কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করে বছরখানেক হলো অবসর নিয়েছেন। হাসিবের দুই বোনও চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত। তাই রুবানা বাইরে কাজ করবে, এতে অসুবিধে হবার কথা না। বেশ ভালোভাবেই রুবানা আর হাসিবের বিয়েটা হয়ে যায়।
এই প্রথম পরিবার ছেড়ে এতো দূরে আসা। দীদা আর রুচিরাকে ছাড়া ঘুমানো। মায়ের হাতের রান্না ছাড়া খাওয়া, বাবা অফিস থেকে ফিরলে দৌড়ে কাছে যেতে না পারা। ফুলগাছে পানি দেয়া, পাশের বাড়ির কাকীর হাতের ডালের বড়ি আর নারকেল নাড়ু; বিকেল হলে ছন্দাদের বাড়ির ছাদে আড্ডা- বেসনে ভাজা কুমড়ো ফুলের বড়া, এমনকী রুবানাকে দেখলেই লেজ নাড়তে থাকা পাড়ার ভুলু কুকুরটার জন্যও গলার কাছে কান্না দলা পাকাতে থাকে।
একটি মেয়ের বেড়ে ওঠার সাথে কত মায়া, কত স্মৃতি! এতোসব বন্ধন ছেড়ে কীভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, নতুন এক পরিবারে, অন্যের সংসারে রাতারাতি আপন হয়ে ওঠা সম্ভব? তবু তো রুবানার মতো এই সমাজের কোটি কোটি মেয়ের এ অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় প্রতিনিয়ত। আর এভাবে উত্তীর্ণ হতে গিয়ে অনেকগুলো প্রচলিত শব্দ মেয়েদের জীবনের সাথে জুড়ে যায়- দায়িত্ব,কর্তব্য, সমঝোতা, সহনশীলতা, ত্যাগ, ধৈর্যধারণ – সর্বোপরি মানিয়ে চলা, মেনে নেওয়াটাই সংসার জীবনের সাফল্যের মূলকথা হয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি হাসিবদেরকে আলাদা করে তেমন কিছুই করতে হয় না, ভাবতে হয় না রুবানাদের জীবন আনন্দময়, নির্ভার করে তোলার জন্য।
মিষ্টি স্বভাবের মেয়ে রুবানা ভেতরে ভেতরে ডানা ঝাপ্টালেও হাসিবের পরিবারে মানিয়ে চলার পরীক্ষাতে বেশ ভালোভাবেই উতরে যায়।
ইতিমধ্যে হাসিব আর সে মালয়েশিয়াতে মধুচন্দ্রিমা পর্বও সেরে এসেছে।
ফিরে এসেই চাকরিতে ইন্টারভিউর জন্য ডাক পায় রুবানা। হাসিবকে সে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলো, নিজের যোগ্যতাতেই চাকরিটা পেতে চায়, তা পাবার ক্ষেত্রে কোনোরকম হস্তক্ষেপ যেন না করা হয়।
আত্মবিশ্বাসী রুবানা তার নিজের যোগ্যতা দিয়েই বেসরকারি এই প্রতিষ্ঠানে কাস্টমার কেয়ারের চাকরিটা পেয়ে যায়।
এতোদিন সব ঠিকঠাকই চলছিলো। কিন্তু চাকরিতে জয়েন করার পরপরই রুবানার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কিছু পরিবর্তন খেয়াল করে। শ্বশুর -শাশুড়ি, স্বামী, ননদ সবাই যেন তার বাইরে কাজের ব্যাপারে একটু বেশিই খোঁজখবর রাখা শুরু করে। দুই ননদের একজন একটি এয়ারলাইন্সের কেবিন ক্রু। অন্যজন একটা বহুজাতিক সংস্থার মানবসম্পদ বিভাগে কর্মরত। তারা রুবানার সাথে ভালো ব্যবহার করে ঠিকই, কিন্তু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়ায় না। তাদের পোশাক-আশাকের ব্যাপারে কোনো বিধিনিষেধ বা বাড়িতে ফেরার জন্য নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়ার কোনো প্রশ্ন না থাকলেও রুবানা কী পরে যাচ্ছে, অন্তত ফুলস্লিভ কামিজ যেন পরে, ওড়না যেন সাইডে না পরে, বিকেল পাঁচটার পরে যেন অফিসে না থাকে, এই ধরনের অদ্ভুত অলিখিত নিয়ম-কানুন শুরু হতে থাকে।
“অফিসে যাও বলে কেউ যেন বলতে না পারে সংসারে তোমার মন নেই। বরং অফিস কর বলেই তোমাকে সংসারের প্রতি আরো মনোযোগী হতে হবে। আর হ্যাঁ, বেতনের টাকা শুধু জামা কিনে আর রেস্টুরেন্টে খেয়ে উড়িও না। তাছাড়া আমার জানা মতে, তোমাদের বাড়ির অবস্থাও এতো খারাপ না যে তোমার থেকে টাকা নিতে হবে। আমার ছেলে কিন্তু তোমাকে চাকরি করার অনুমতি দিয়েছে, এটা কখনো ভুলো না,এমন কিছু করবে না যাতে ওর মনে হয় তুমি টাকা রোজগার কর বলে গরম দেখাচ্ছো। আর তোমাকে আরেকটা কথা বলে রাখি, তোমার বয়স অল্প, একটুতেই বাইরের মানুষের সাথে হেসে গলে পড়ার দরকার নেই, এতে মানুষ তোমাকেই মন্দ ভাববে। আমাকে দেখো, চাকরির জন্য কোনোদিন আমার স্বামী -সন্তানের কোনো অসুবিধে হতে দিইনি।”
রুবানার শাশুড়ি রীতিমতো নিয়ম করে এহেন আপত্তিকর সব ভাষায় রুবানার ক্লাশ নিতে শুরু করলেন চাকরি বিষয়ে। বাড়িতে দুই-দুইজন সাপোর্ট স্টাফ থাকা সত্বেও রুবানাকে সকালের নাশতা তদারকি করতে হয়। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে সবার জন্য চা-কফি, বিকেলের স্ন্যাক্স তৈরি করতে হয়। রাতেও বাড়ির বউয়ের হাতের স্পেশাল কোনো ডিশ না থাকলে কারো যেন ডিনারটা পরিপূর্ণ মনে হয় না। সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে দাওয়াত আর অতিথি আপ্যায়নে নাভিশ্বাস উঠে যায় রুবানার। ভালো রান্না করে অনেক প্রশংসাবাণীও শোনে। সবাই বেশি প্রশংসা করলে তাও যেন শাশুড়ির মন মতো হয় না।
সেদিন টেবিলে রাতের খাবার গুছিয়ে টিভিতে একটা লাইভ গানের অনুষ্ঠান দেখতে বসেছিলো রুবানা। কিছুক্ষণ পরেই কড়া গলায় শাশুড়ি বলে ওঠেন, “তোমার বাবা খেতে বসেছেন, পাশে না দাঁড়িয়ে তুমি টিভি দেখে হাসাহাসি করছো! সত্যি, আমাদের সময় এসব কল্পনাই করতে পারতাম না।” সবার উপরেই স্বীয় কর্তৃত্ব বজায় রাখতে বদ্ধ পরিকর সুলতানা আহমেদ। তাঁর দাপটে হাসিবের সাথেও এখন পর্যন্ত বোঝাপড়াটা সেভাবে গড়ে উঠতে পারেনি।
হাসিবকে কেমন যেন দূরের মানুষ বলে মনে হয় রুবানার। অফিস থেকে ফেরার পথে কখনো বা হাসিব হঠাৎ তার জন্য বিশেষ উপহার নিয়ে ফেরে, রাতে ঘুমোতে যাবার আগে একান্তে সেইসব উপহার দেয়। কোনোদিন ফরাসি সুগন্ধি, দামী পেন্ডেন্ট, কোনোদিন আবার আবেদনময়ী রাতের পোশাক। এসবে সাজিয়ে রুবানার শরীর নিয়ে মেতে উঠতে সে যতোটা স্বচ্ছন্দ, রুবানার হৃদয়ের কথা জানতে ততোটা আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। তাই “হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল” রুবানার প্রাণের মানুষ হয়ে উঠতে পারেনা সে। আধুনিক ও শিক্ষিত হিসেবে হাসিব ও তার পরিবারের কাছ থেকে রুবানা আর তার বাড়ির মানুষদের যে প্রত্যাশা ছিলো তা ক্রমেই ফিকে হতে শুরু করেছে।
অফিসে সিনিয়র ম্যানেজার শারমিন আপা প্রচণ্ড কড়া, মুখে কিছু আটকায় না। সহকর্মীদের সবার মধ্যে রুবানা বয়সে ছোট এবং নতুন। এই পরিবেশেও নিজেকে প্রমাণ করার জন্য রুবানার কিছু সময় দরকার, চর্চা দরকার। কাজের ক্ষেত্রে অন্যরা তাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করছে। কিন্তু প্রতিদিন অফিস ছুটির আগে এক ধরনের আতংকে ভুগতে থাকে রুবানা।
কেননা, পাঁচটা বাজলেই তাকে নিতে বাসা থেকে গাড়ি পাঠানো হয়। গাড়িতে কখনোই ড্রাইভার একা থাকে না। বাসা থেকে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ যে যেদিন ফ্রি থাকে, কেউ না কেউ আসবেই। রুবানা ভেবে পায় না, যে পরিবারে এতোজন মানুষ কর্মজীবী তারাই কিনা বাড়ির বউয়ের কাজের ব্যাপারে এমন অবিবেচক আচরণ করে! সবদিনই যে কাজ ঘড়ির কাঁটা মেনে পাঁচটায় শেষ হয় না, এটা না বোঝার তো কিছু নেই! এই নিয়ে কয়েকদিন শারমীন আপার তির্যক প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়েছে রুবানাকে। খুবই বিব্রতকর পরিস্থিতি।
এই শহর, পরিবার, কাজের জায়গা কোনোকিছুই রুবানার আপন মনে হয় না। মাঝেমধ্যে সে ওয়াশরুমে জোরে শাওয়ার ছেড়ে
চিৎকার করে কাঁদে। গভীর রাতে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে লাল-নীল-হলুদ-বেগুনি নিয়ন আলোর খেলায় অচেনা শহরটার দিকে চেয়ে থাকে। মন চলে যায় চেনা সবুজ প্রান্তরে, মফস্বল শহরে তাদের ছোট্ট একতলা “পাখির নীড়ে”। দীদার লাইব্রেরি, পুরনো দিনের গান শোনা, বাবার “মামণি” ডাক, মায়ের আঁচলের ঘ্রাণ, ছোটবোনের সাথে খুনসুটি – এসব কিছুর জন্য বক্ষ জুড়ে তৃষ্ণা রুবানার।
খুব ভোরে ঘুম ভেঙে রুবানা চুপচাপ বসে আছে। এতো ভোরে মেসেজ রিংটোনে অবাক হয় সে।
“জানি তুমি ঘুমোওনি ঠিকমতো। আমার চেয়ে ভালো তোমাকে আর কে জানবে, বলো? জীবনে হেরে যাবার শিক্ষা তোমাকে আমরা দিইনি। ঘুরে দাঁড়ানোর নামই জীবন। তাই যা কিছুই হোক, হারতে নয়, বরং তুমি নিজের মতো করে জীবনকে জয় করতে শিখবে – খুঁজে নেবে তোমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে- আমাদের বিশ্বাস। আজকের চমৎকার সকালে তোমার জন্য স্নেহাশিস। দীদা।”
আজকের দিনে রুবানার সত্যিকার নতুন পথচলা শুরু হলো।