আমার মায়ের গোলাপী মশারি

মনিজা রহমান, নিউইয়র্ক থেকে: আমার মায়ের দক্ষিণমুখী ঘরে ঢাউস আকারের খাট। হলরুমের মতো ঘরটিতে দুটো সিলিং ফ্যান। খাটের পাশে স্ট্যান্ডওয়ালা ন্যাশনাল ফ্যানের বাতাস যেমন, শব্দও প্রচণ্ড। বিছানায় গোলাপী মশারী টাঙ্গানো। সেই রাতে গোলাপী মশারির নিচে ঘুমে নিহত হলাম আমি। মনে হলো বহুদিন যেন আমি ঘুমাই না। মনে হলো পৃথিবীর পথে পথে, বন্দরে-বন্দরে ঘুরে, ক্লান্ত, বিষাদময়তায় ন্যুব্জ, জীবনযুদ্ধে বিধ্বস্ত এক মানুষ নিশ্চিন্তে ঘুমায় অবশেষে।

আমার মায়ের চিকন সোনালী চুড়ি পরা একটি হাত সারারাত পড়ে থাকে গায়ের ওপর। জীবনভর অমানুষিক পরিশ্রমে শক্ত হয়ে যাওয়া একটি হাত। টাঙ্গানো মশারি বহুদিনের অনভ্যস্ত চোখে বিরক্তি জন্মালেও আমি কিছু বলি না। কারণ আমি শপথ নিয়েছি আমার মায়ের স্নেহের অত্যাচারে কোনো বিরক্তি জানাবো না। জীবনের চড়াই-উতরাই পেরিয়ে, বহু ঠেকে একটা সত্যই শিখেছি- এই পৃথিবীতে মায়ের মতো অপেক্ষা করে কেউ নেই, কোনদিন ছিলও না কেউ আমার জন্য।

ma-monijaমাত্র একটি দিনের আয়ু নিয়ে এসেছিলাম আমার প্রিয় শহরে। আগের দিন অনেক রাতে যখন বিমানবন্দর থেকে বাসায় যাচ্ছিলাম, ঘোর লাগা তন্ময়ে নির্বাক হয়ে ছিলাম পুরোটা সময়। স্বপ্নযাত্রার অনুভূতি হচ্ছিল মনের গহীনে। এর আগেও বহুবার বিদেশে গিয়েছি। আবার ফিরেছি নিজ আলয়ে। কিন্তু এবার অনিশ্চিতের যাত্রা ছিল। জানতাম না, কবে-কখন ফিরবো! কিংবা আদৌ ফিরতে পারবো কিনা! তাইতো এ ফেরা স্বপ্নঘোরের অধিক কিছু।

আমার বোনের মৃদু ধাক্কায় সকাল দশটায় ঘুম ভাঙ্গে আমার। ‘এতো বেলা পর্যন্ত যদি ঘুমাবে, তবে ঘুরবে কখন?’ ধড়মড় করে উঠে পড়ি আমি। একটানা ঘুমিয়ে কবে সকাল দশটায় উঠেছি, আজ আর মনেই পড়ে না। জীবনের টু-ডু ডিউটি মাথার মধ্যে টিকটিক করতে থাকে ঘড়ির কাঁটার মতো। এ্যালার্ম না বাজলেও ছয়টায় উঠে পড়ি আপনা আপনি।

মাত্র একদিনের আয়ু নিয়ে এসেছি প্রিয় এই শহরে!  আমাকে কি ঘুমালে চলে! আমি বেরিয়ে পড়ি। বেরিয়ে পড়ি আমি। গলি মোড় থেকে রিক্সা নেই।

আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে
আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ঘাসে ঘাসে

বাসার সামনে ধুপখোলা মাঠ। ঘাসহীন, পত্রপুষ্পবিহীন। সেখানে বিরাট গরু-ছাগলের হাটের ব্যানার বাতাসে দোলে। আর কদিন পরেই কোরবানী ঈদ। গরুর হাট দেখলে আব্বার কথা মনে পড়ে। কেমন তীর্থের কাকের মতো আব্বা আর ইস্ট ক্লাবের অন্য সবাই অপেক্ষা করে থাকতো গরুর হাটের জন্য। হাটের ইজারা থেকে পাওয়া টাকা থেকে ফুটবলারদের পেমেন্ট দেয়া হতো, সেই টাকায় সারা বছর ক্লাবের হাড়ি চড়তো। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত আমার আব্বার ধ্যানজ্ঞান সবকিছু ছিল এই ইস্টএ্যান্ড ক্লাব। জানি না ক্লাবটার এখন কী দশা!

কবি শামসুর রাহমানের স্মৃতির শহরে, চলে আমার রিক্সা হাওয়ার বেগে উইড়া উইড়া….। অনেকদিন পরে ঢাকার শহর দেখবো আমি। আরব্য রজনীর একদিনের বাদশা আবু হুসেনের মতো আমি আজ একদিনের রানী। ঘুরবো, ফিরবো, কিনবো দু হাত ভরে। একটু পরপর স্বামী ফোন করে জিজ্ঞাসা করবে না, ‘কোথায় তুমি?’ ছেলেরা বলবে না, ‘আম্মু, কখন বাসায় আসবে?’

জীবন আমাকে ছিটকে অনেক দূরে ফেলে দিলেও মস্তিস্কের কোষে কোষে জমে থাকা ভালোবাসাগুলি রয়ে গেছে আগের মতো। হুডখোলা রিক্সার চলন্তগতিতে শিহরিত হই। জমে থাকা রাস্তার পানি ছিটকে চলে যাওয়া রঙচটা বাসগুলি, তাতে ঝুলন্ত হেলপার, খানাখন্দ-গর্ত, চালতা-তেঁতুলের চাটনির প্যাকেট, কুলফি বিক্রেতা, শুকনো বরইয়ের ভ্যান- সব আমার চোখে ধরা দেয় বিশাল মুগ্ধতার ক্যানভাস হয়ে।

আমি ছুটে চলি ওয়ারী, মতিঝিল, গুলিস্তান হয়ে আরো অনেক দূর। হাইকোর্ট ভবন পার হয়ে দোয়েল চত্বরের মোড় ঘুরে টিএসসি। যাই শাহবাগের মোড়ে। রিক্সাওয়ালা ভাইকে পথের ধারে লেবুর শরবত খেতে অনুরোধ করি। সে শরবত খায়। আমি ছবি তুলি। ছবি তুলি পথের মোড়ে মোড়ে। দুই হাত ভরে কেনাকাটা করি।

এক সময় আমার মায়ের বাড়িতে ফিরি। আমার বোনের ছেলে মাসনুন ‘আপা’ বলে চিৎকার করে ছুটে আসে।  জন্মের পরে মা আর খালাদের কাছে শুধু ‘আপা’ ডাকই শুনেছে, ও তাই আমাকেও ‘আপা’ ডাকে।

সারাদিন ধরে আমার মা সপ্তব্যঞ্জন প্রস্তুত করে রেখেছে আমার জন্য। আমি আসার খবর পেয়ে আমার থেকে ১৪ বছরের ছোট ভাইটি বাজার ঘুরে ঘুরে মাছ কিনেছে। আমি একবেলায় তিনবেলার খাবার খাই। খেতে খেতে ভাইবোনেরা গল্প করি। সেই আগের মতো। মনে হয় না মাঝখানে কেটে গেছে এতোটা সময়। যেন গতকালও ইস্কাটনে আমার নিজের বাসা থেকে এসেছিলাম মায়ের এখানে।

খাবার পরে আবার ড্রইংরুমে আড্ডা জমে। আমার মা এবার তালের পিঠা, কতকাল আগের শবেবরাতে বানানো হালুয়ার প্লেট নিয়ে এসে দাঁড়ান। আমার দুই বোন তানিয়া-মারুফা হাসতে হাসতে বলে, ‘আম্মা তুমি তো আপাকে খাওয়াতে খাওয়াতে মেরে ফেলবে।’ আমি আগে হলে আম্মার সঙ্গে রাগ করতাম। এবার কিছু বলি না। বহুপথ হেঁটে এসেছি বলে জানি, নেউ কেউ নেই, কেউ নেই এভাবে আকুল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার। এই পৃথিবীতে আমার মা ছাড়া কেউ এভাবে খাবারের প্লেট হাতে অপেক্ষা করে না। কোনদিন করবেও না। কেউ এমন উপচে পড়া স্নেহকণ্ঠে আমায় বলবে না, ‘তুই আবার কবে আসবি, আব্বা?’

monija-2আমার মায়ের দক্ষিণমুখী ঘরে, ঢাউস বিছানায় গিয়ে বসি। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে আমার মা দিবানিদ্রা যায়। আমি তাকিয়ে দেখি তাকে। বহুমুত্র, উচ্চচাপ, নানামুখী রোগ যেন তাঁর বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে আরো বিশ বছর। মাথার সিথিঁ আগের চেয়ে অনেক চওড়া। কেমন কুচকে গেছে গায়ের চামড়া।

আমার মায়ের কুচকানো হাতের চামড়ার দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটা সমতল বক্ষদেশের ছবি ভেসে ওঠে মনে। নিউইয়র্ক থেকে কুয়ালালামপুরে গেছি আমরা প্রথমে। সেখানে মা-বাবার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে আমার স্বামী। সবাইকে বেড়ানোর কথা বললেও, অসুস্থ বাবা-মায়ের সেবাযত্ন আর তাদের জন্য হাসপাতালে ছোটাছুটিতে কেটেছে কুয়ালালামপুরের দিনগুলি। এমনি একদিন শাশুড়িকে গোসল করাতে গিয়ে দেখি কর্কটে আক্রান্ত তার সমতল বক্ষদেশ। আমাকে দেখিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন। জীবনে প্রথমবারের মতো শাশুড়ির জন্য আমার গাল বেয়ে পানি নামে।

আমার মায়ের গোলাপী মশারির নিচে সেই রাতেও ঘুমাই আমি। গায়ে দেই হাতে বোনা নকশী কাঁথা। স্ট্যান্ডফ্যানে ঝোড়ো বাতাস বয়। আগের রাতের মতো ঘুমটা গভীর হয় না। কারণ কয়েক ঘন্টা পরে আমাকে চলে যেতে হবে। চলে যেতে হবে মাকে ছেড়ে, প্রিয় শহর ছেড়ে।

স্নেহকাতর আমার মামা ছুটে আসেন একদিনের জন্য বাংলাদেশে আসা ভাগ্নীকে দেখার জন্য। প্রথমবার নিউইয়র্কে আসার সময় সিদ্দিকা কবিরের রেসিপি বইটা দিয়েছিল যে বন্ধু, সেই রুমা আসে এবার কয়েক শিশি আচার নিয়ে। বিমানবন্দরে যাবার পথে আমার দেবর খোকন, জা ফাল্গুনীর বাসায় যাই। আসলে ওটা আমার নিজেরই বাসা!

বিয়ের পরে ১২ বছর ধরে, সারা পৃথিবী ঘুরে, কত শত জিনিস দিয়ে যে সংসার সাজিয়েছিলাম, সেই সাজানো সংসার দেখে বুকের মধ্যে গভীর শূন্যতাবোধ হয়। জানালায় নীলপর্দা। দেয়ালে আমাদের যুগল ছবি। শোকেজে আমার কেনা শোপিস। নীলক্ষেত-বাংলাবাজার ঘুরে ঘুরে কেনা বইগুলি ঠিক তেমনি আছে বুক সেলফে।

গোছানোর কথা ছিল এমনই সময়
সব অগোছাল করে
জমা নীরবতায়
জানি হঠাৎ ফেরারী কোন স্মৃতি কাঁদাবে
……..
যত দূরে দূরে দূরে যাবে বন্ধু

আমি ঢাকা ছেড়ে কুয়ালালামপুরে চলে আসি। এবার আর সেখানে ঢোকার ভিসা নেই। ট্রানজিট ভিসা নেই। দুইদিন পরে আবার ইস্তাম্বুল হয়ে নিউইয়র্কের উদ্দেশ্যে যাত্রা করি। সঙ্গে নিয়ে আসি আমার বাংলাদেশকে। সঙ্গীত পরিষদে যাই, সাহিত্য একাডেমিতে যাই। বক্সে করে নিয়ে যাই আমার মায়ের পাঠানো খাবার…সবাইকে ডেকে ডেকে দেই।

ক্ষণে ক্ষণে চোখে ভাসে খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষের অবয়ব। আমার মা। পৃথিবীর সমস্ত মমতা যার চোখেমুখে। চোখে ভাসে আমার মায়ের ঘর। রাতে ঘুমানোর জন্য গোলাপী মশারি। আমার সারাজীবনের একমাত্র গন্তব্য যেখানে।

শেয়ার করুন: