পুরুষেরা আসুন নারীবাদী হই

মাসুদুজ্জামান: নারীবাদ। কথাটা শুনলেই পুরুষেরা যেন কেমন করে ওঠেন। বুঝতে পারি, শব্দটা তাদের স্নায়ুকে তীক্ষ্ণ করে তুলছে। মস্তিষ্কের কোষগুলি নড়ে-চড়ে উঠছে। প্রথম প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, “ওহ্ নারীবাদ?” তারপর নীরবতা। তারপর মুখে এমন একটা অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলেন যার মর্মার্থ হলো, “ওহে, নারীবাদ নিয়ে কথা বলবেন না। নারীবাদের অর্থ কী, আমরা জানি!”

womenchapter
ড. মাসুদুজ্জামান

কী জানেন এই পুরুষেরা? আপনি যাকে কথাটি বলছেন, তিনি যদি আপনার একটু ঘনিষ্ঠ হন, যদি চেনা মানুষ হন, যদি বলে বসেন নারীবাদ ব্যাপারটা খুব জরুরি, তাহলেই সব গেল, আগুনে ঘি ঠেলে দিলেন। তেড়েফুড়ে তিনি আপনাকে বলতে থাকবেন, নারীবাদ মানে যেসব নারী পুরুষকে পাত্তা দেয় না, যারা পুরুষের গুষ্টি উদ্ধার করে, তারাই নারীবাদী। নারীবাদ কথাটা শুনলেই পুরুষরা যেন নারীর প্রতিপক্ষ হয়ে যান। আর প্রতিপক্ষ মানেই হলো দ্বন্দ্ব-সংঘাত। যেসব নারী নারীবাদে বিশ্বাস করেন তারা যেন পুরুষকে আক্রমণ করার জন্য অস্ত্র শানাচ্ছেন অথবা নানা ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করবেন। অস্ত্রটা কি? অস্ত্রটা হলো পুরুষ-বিদ্বেষ। অর্থাৎ নারীবাদী নারীমাত্রই পুরুষ বিদ্বেষী। পুরুষেরা যাই করুক, তার বিরোধিতা করা ছাড়া তাদের আর কোনো কাজ নাই। পুরুষকে আঘাত করাই নারীবাদী নারীদের লক্ষ্য।

নারীবাদ সম্পর্কে পুরুষের আরেকটা ধারণা হচ্ছে, নারীমাত্রই উগ্র। উগ্রতার প্রথম ব্যাখ্যা কি? তাদের ব্যাখ্যা হলো, নারীবাদী নারীরা পুরুষেরা যেমন চান তেমন নন। অর্থাৎ নরম-সরম, ভব্য-ভদ্র অথবা যাহা বলিব তাহাই পালন করিবে, এইরকম নন। নারীবাদী নারীরা কাউকেই মানেন না, এমনকি স্বামীকেও নয়। মানেনা কথাটার অর্থ হলো পুরুষ যেমন চায় এই নারী তেমন নন। এই হলো উগ্রতার একটা অর্থ। আরেকটা অর্থ হলো, নারীর চালচলন পোশাক-আশাক নারীসুলভ নয়। আমাদের সমাজে বাঙালি নারীর যে রূপ পুরুষ দেখে আসছেন, অর্থাৎ শাড়ি পরবে, সালোয়ার কামিজ পরবে, হিজাব পরবে, বোরখা পরবে, এই হলো নারীর ড্রেস কোড। এই ড্রেস কোডের বাইরে গেলেই সেই নারীর পোশাক-আশাক উগ্র আর সে নারীবাদী হয়ে গেছে, এই হলো পুরুষের ধারণা। নারী কখনও প্যান্ট-শার্ট পরতে পারে, বুট জুতা পরতে পারে, জিনস পরতে পারে, স্কার্ট পরতে পারে, এমনটা ভাবতেই পারেন না। স্কার্টের চল অবশ্য বাংলাদেশে তেমন নাই, কিন্তু সাধারণভাবে প্যান্ট-শার্ট বা জিনস পরাটাকে পুরুষ সহজভাবে নেন না। প্রচলিত পোশাক-আশাকের বাইরে গেলেই সেই নারীকে উগ্র বলে আখ্যায়িত করে থাকেন। বিষয়টা এমন যে এই ধরনের পোশাক পরলেই সে উগ্র হয়ে গেল, না পরলে নয়।

সবচেয়ে মারাত্মক যে ধারণাটি পুরুষ পোষণ করেন সেটা হলো, নারীবাদী নারী যৌন-যথেচ্ছাচার করে বেড়ান। অনেক পুরুষ বন্ধু তার, অনেক সুলভ তিনি।

kolomআমাদের দেশে পুরুষের কাছে এই হলো নারীবাদ। নারীবাদ মানেই নষ্ট হয়ে যাওয়া উগ্র নারী, যে প্রচণ্ডভাবে পুরুষ-বিদ্বেষী। আপনি যদি এসব ব্যাখ্যা শোনার পর জিজ্ঞেস করেন, আচ্ছা নারীবাদের প্রকৃত অর্থ কী? তাহলেই দেখবেন সেই পুরুষটি ফাঁপরে পড়ে যাবেন। আমতা আমতা করে খুঁজতে থাকবেন যুৎসই কোনো ব্যাখ্যা। কিন্তু নারীবাদের কোনো গভীর ব্যাখ্যা তো দূরের কথা সাধারণ ব্যাখ্যাও দিতে পারবেন না। আসলে নারীবাদ সম্পর্কে যার কোনো ধারণা নাই, সে কী করে নারীবাদের ব্যাখ্যা দেবেন? সমস্যাটার শিকড় আসলে আরও গভীরে। পুরুষতন্ত্রই সমস্যা।

প্রথমত, যে পুরুষটি নারীবাদ বলতে পুরুষ-বিরোধিতা মনে করেন, তিনি তো পুরুষতন্ত্রের দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে আছেন। শাদা চোখে তিনি দেখছেন, নারীদের অধিকার আদায়ের জন্য একদল নারী রাজপথে মিছিল করছেন, সভা করছেন, শ্লোগান দিচ্ছেন। এরা তো ‘নম্র-ভদ্র-সভ্য’ হতে পারেন না। এরা তো রাজপথে নামেন, দু-হাত তুলে শ্লোগান দেন। হিজাব পরা বা বোরখা পরা নারীরা এরকম রাজপথে নেমে আন্দোলন করেন না। পুরুষতন্ত্রকে সমালোচনা করে শ্লোগানও দেন না। এরা বেয়াদব, রাষ্ট্রযন্ত্র আর পুরুষদের প্রচলিত বিধি-বিধানকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন। সুতরাং তাদেরকে সমর্থন করা যায় না।

দ্বিতীয়ত, এই পুরুষেরা মনে করেন, নারীবাদীরা পুরুষের সমান হতে চান। এরা পুরুষের সঙ্গে সহজভাবে মেশেন, পুরুষের মতো প্রায় সবধরনের কাজ করতে চান। সেসব না হলে, সমানাধিকারের দাবি তুলে আন্দোলন করে দাবি আদায় করে নিতে চান। কিন্তু নারী কি কখনও পুরুষের সমান হতে পারেন? তাদের ধারণা পারেন না। অধিকাংশ পুরুষেরই এই ধারণা। প্রথমেই তারা প্রশ্ন তোলেন নারীর শরীর পুরুষের সমকক্ষ নয়, সুতরাং নারী-পুরুষ সমান নয়। পুরুষের সমান অধিকার নারী পেতে পারেন না। হ্যাঁ, শারীরিক পার্থক্য আছে, কিন্তু মেধার তো পার্থক্য নাই, শারীরবিজ্ঞানীরা তো তাই বলেন। নারী তো গর্ভধারণ করতে পারেন, পুরুষ সেটা পারেন না। হ্যাঁ, পুরুষ ছাড়া মানবপ্রজন্মের ধারাক্রম রক্ষা হবে না, কিন্তু নারী ছাড়াও তো হবে না। তাহলে নারী কেন পুরুষের সমান অধিকার পাবেন না? এই সরল কথাটা ওইসব পুরুষের মাথায় ঢোকে না। ফলে, যেসব নারী সমানাধিকার নিয়ে সোচ্চার তাদের নারীবাদী বলে প্রকাশ্যে না হলেও মনে মনে গালাগাল করেন অনেক পুরুষ। কিন্তু এটা যে অযৌক্তিক সেটা ভেবে দেখার বোধবুদ্ধিও তাদের নাই।

তৃতীয়ত, এইসব পুরুষের ধারণা, নারীবাদী হলেই নারী যৌন-যথেচ্ছাচারে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু যৌন-যথেচ্ছাচার আসলে কি, সেই ধারণাও তাদের নাই। প্রত্যেকটি মানুষেরই তার নিজের সিদ্ধান্ত অনুসারে চলার অধিকার আছে। নারীরও আছে। ফলে সমাজের অন্য কারো ক্ষতি না করে সে তার নিজের ইচ্ছায় কোনো না কোনো সম্পর্কে জড়াতেই পারেন। সেটা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার হয়ে থাকলে সেই সম্পর্ক নিয়ে মাথাব্যথার তো কোনো কারণ নাই। আর ঢালাওভাবে বলে দিলেই হলো যে নারীবাদে বিশ্বাসীরা এরকম? হ্যাঁ, এটা তো ঘটতেই পারে, একজনের সঙ্গে সম্পর্ক না টিকলে, যা আমাদের সমাজে ঘটে থাকে, নারী হোক কিংবা পুরুষ, অন্য আরেকটি সম্পর্কে জড়াতেই পারেন। কিন্তু তাই বলে তারা যৌন-যথেচ্ছাচার করছেন, একথা তো বলা যায় না।

আসলে সমস্যা এইখানে, প্রতিবাদী, অধিকার সম্পর্কে সচেতন, পরিবারে-সমাজে-অফিস আদালতে সহজভাবে চলা নারী অথবা পুরুষের পাশাপাশি চলা অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর নারীমাত্রই পুরুষতন্ত্রের চক্ষুশূল। নারীবাদী নারীরা যেসব বিষয় নিয়ে সোচ্চার, যার কথা আগে উল্লেখ করেছি, নারীবাদেরও যা মূলকথা, সে সব প্রশ্ন তুললেই বা আন্দোলন করলেই অধিকাংশ পুরুষ সেটা ভালো চোখে দেখেন না। পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই নারীবাদের অপব্যাখ্যা দেন তারা। এরা নারীবাদ কী সেটাও জানেন না। নারীবাদ যে আসলে নারীর মানবাধিকার, এই বোধ অধিকাংশ পুরুষেরই নাই।

পুরুষ হয়েও আমি তাই পুরুষদের বলবো, আসুন পুরুষতন্ত্রকে ছুঁড়ে ফেলে আমরা সবাই নারীবাদী হয়ে যাই। নারীবাদ মানেই উগ্রতা নয়, যথেচ্ছাচার নয়, নারীবাদ নারীর অধিকারকে মেনে নেওয়ার কথা বলে, প্রতিষ্ঠার কথা বলে। একটা সমতাভিত্তিক, সমানাধিকার ভিত্তিক সমাজের জন্য যা জরুরি এবং একটা অনিবার্য বাস্তবতা।                                    

 

শেয়ার করুন:

Thanks for writing this excellent article on feminism. I am not disagreeing with your opinion but I am so confused about feminism! What is feminism? Right to speak out, right for doing what ever they want, right to give slogan on the road and so on..?
I am a woman , who wears hijab, and of course by my own choice(my husband did not want it). I worked in Various English medium school in Chittagong. Presently. I work with special needs children with autism as well after school program in a public school and teach science to typical kids from kindergarten to grade 5 in Canada. No body stopped me, not my husband or anybody. My husband helped me a lot. When I was young, my father helped me to see the world. I never seen in my family or surroundings to disrespect any woman.
I believe, if you give slogan or ask for your freedom or for others freedom on the road, it will not change anything. You will have to educate yourself in each and everyway. Just think about Begum Rokeya. I find so called those feminist(women feminist) aboused their helping hands, mother in laws or daughter in laws at home. .Are you kidding? Even, I found in my own life, my father in law was always helpful than my mother in law. I know few feminist( my relatives) who are so called social worker. Screaming on the street, going abroad , and at the same time abusing their mother in laws! Is this feminism? If a man abuse a woman that is against feminism, then what you would say when a woman abuses another woman. especially if this happens by a so called social worker?
In Bangladesh, girls are so powerful now! They are in the school system, in politics, in corporate world , in banking and in everywhere. Women, We need to change our attitude and behaviour. Stop domestic violence. I would say not only few men but most women to be a feminist in outside and at home.

২ নং পয়েন্টের শেষ প্যারায় আপনি লিখেছেন –
” ফলে সমাজের অন্য কারো ক্ষতি না করে সে তার নিজের ইচ্ছায় কোনো না কোনো সম্পর্কে জড়াতেই পারেন। ”
এই বাক্যটা আপনার বক্তব্যকে স্ববিরোধীতার দোষে দুষ্ট করে ফেলেছে। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে একজন নারী তাঁর স্বাধীন ইচ্ছের চর্চা করতে চাইলে সমাজের কারো না কারো অথবা কোনো অংশের ‘ ক্ষতি ‘ করবেই। এই টাইপের ক্ষতির ঘটনা সমাজে যতোবেশি ঘটবে ততোই এ সমাজ পিতৃতান্ত্রিকতার শেকল থেকে মুক্ত হবে।

তথাপি চমৎকার লেখা। ভাল লেগেছে। আপনাকে ধন্যবাদ।