গার্হস্থ্য অর্থনীতি কি শুধুই নারীর জন্য?

ফাহমি ইলা: আমাদের স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত কো-এডুকেশন থাকলেও ক্লাস সিক্স থেকে মেয়েদের মর্নিং শিফট আর ছেলেদের ডে-শিফটে ভাগ হয়ে গিয়েছিলোক্লাস সিক্সে ওঠার পর নতুন একটি সাবজেক্ট সংযোজন হলো- গার্হস্থ্য অর্থনীতি যা মেয়েদের জন্য এবং কৃষি ব্যবস্থাপনা ছেলেদের জন্য। যদিও সাবজেক্ট পছন্দ করবার ব্যাপার ছিলো, কিন্তু মেয়েরা দু একজন কৃষি পছন্দ করলেও কোন ছেলে গার্হস্থ্য অর্থনীতি নিয়েছে বলে আজ পর্যন্ত আমি শুনিনি।

ela
ফাহমি ইলা

কারণ, ‘বাহির=পুরুষ আর ঘর=নারী’ এ চিন্তাধারা থেকে বের হয়ে আসা উচিৎ- এ বিপ্লবে নামলেও বাহির আসলে পুরুষ এবং সেইসকল তথাকথিত বিপ্লবী নারীসহ ঘরটা সকল নারীর একারই রয়ে গেছে। এই বেলায় কোন পুরুষ কি একটু ছোটখাটো বিপ্লব ঘটিয়ে কখনো জোরালো গলায় বলেছেন যে ‘না, ঘর শুধু নারীর না, পুরুষেরও’?

ঘর যে নারীর একার জগত- এ চিন্তাধারা থেকেই মাধ্যমিক শিক্ষায় গার্হস্থ্য অর্থনীতি মেয়েদের জন্য চালু হয়েছে বলে আমার মনে হয়। কোন ছেলে যদি গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিষয় পছন্দের বিষয় হিসেবে নিতে চায় তাহলে তার অবস্থাটা কী হবে তা একবার কল্পনা করুন তো! বেশিরভাগ মানুষ এটা মেনেই নিতে পারবে না

শিক্ষিত অনেক পুরুষ আছেন যারা মানতে নারাজ যে ঘরের কাজ শুধুমাত্র নারীদের নয়। নারীদের কাজ বলে খ্যাত গৃহ ও গৃহ-সম্পর্কিত বিভিন্ন কাজে পুরুষের সংযুক্ততাকে অনেক পুরুষ হেয়, মেয়েলি, নিচ, লজ্জাকর হিসেবে দেখেন। ঠিক তাদের কাছেই নারী হচ্ছে সেকেন্ড জেন্ডার এবং পুরুষ ফার্স্ট জেন্ডার!

সেকেন্ড জেন্ডারের ট্যাগকৃত কাজ ফার্স্ট জেন্ডার করলে তা লজ্জাকরই বটে! যারা নারীসঙ্গীর সাথে ঘরের কাজগুলো করেন, তাদেরকে ঘরকুনো, ছাপোষা, বৌ-পাগলসহ এমন অনেক সম্বোধনও শুনতে হয়এর কারণ সেই ‘বাহির=পুরুষ আর ঘর=নারী’ মানসিকতা। আমার সঙ্গীকে স্বজনদের কাছ থেকেও এহেন কথা শুনতে হয়েছে এবং একইসাথে আমাকে শুনতে হয়েছে ‘স্বামীর প্রতি আধিপত্যশীল’ শব্দটি। কারণ আমি নাকি জোর না করলে কিংবা ডমিনেট না করলে সে এই কাজগুলো করতো না, কারণ এগুলো শুধুই আমার কাজ!

আমার প্রশ্ন হলো- যখন একইসাথে ঘরের পুরুষ এবং নারীটি বাইরের জগতে সমানভাবে বিচরণ করছে, তখন বেলা শেষে ঘরে ফিরে ঘরের কাজগুলো একলা কেনো নারীর?

শুরু করেছিলাম মাধ্যমিক পর্যায়ে দুটো পাঠ্যবিষয় নিয়ে যা প্রচণ্ডভাবে জেন্ডার-বায়াসড। জন্মের পর থেকেই বিভিন্নভাবে লিঙ্গীয় বৈষম্য তৈরি হলেও শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক পর্যায়ে এসে নারী আর পুরুষকে একেবারেই আলাদা করে দেয়া হচ্ছেযেখানে স্পষ্ট করে দেয়া হচ্ছে নারীর সকল বিষয় পড়ার পরও কোন বিষয়টা নারী হওয়ার কারণে পড়তে হবে এবং ভাইস ভার্সা।

পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এহেন জেন্ডার-বায়াসড শিক্ষাব্যবস্থা চালু আছে কিনা আমার জানা নেই। এ অঞ্চলে ‘গার্হস্থ্য অর্থনীতি’ স্কুল কলেজ ছাড়িয়ে উচ্চশিক্ষায় সংযুক্ত হয় ১৯৬১ সালে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হয় ‘গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ’। যা শুধুমাত্র নারীদের জন্য চালু হয়েছিলো এবং এখনো তাই চালু আছেএটি আমেরিকার ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা স্টেট ইউনিভার্সিটির সহায়তায় স্থাপিত হয়। ১৯৬১ সালে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক এবং ১৯৬৩ সাল থেকে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে পাঠদান শুরু হয়। এখানে বর্তমানে পাঁচটি বিভাগ চালু আছে- খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান, সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও এন্টারপ্রেনরশিপ, শিশুবিকাশ ও সামাজিক সম্পর্ক, শিল্পকলা ও সৃজনশীল শিক্ষা এবং বস্ত্র পরিচ্ছদ ও বয়ন শিল্প।

সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্ত আজিমপুরের গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের ‘নারী শিক্ষার্থী’রা এ বছর থেকে তাদের কলেজে ছাত্র ভর্তি করে সহশিক্ষা কার্যক্রম (কো-এডুকেশন) চালুর দাবি জানিয়েছেন। ‘নারী শিক্ষার্থী’ শব্দটা ব্যবহার করলাম এ কারণেই গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজে শুধু নারীরাই পড়েন এবং নারীদেরই পড়া উচিৎ এ ধারণা সবাই পোষণ করে।

এ আন্দোলন নিয়ে অনেকে ঠাট্টা বিদ্রুপ কটাক্ষ করছেন। অশ্লীল কথা বলতেও পিছপা হচ্ছেন না।

এখনো শিক্ষিত মানুষজন এটা মানতে নারাজ যে এ বিষয়ে পুরুষের আদৌ জ্ঞানলাভের প্রয়োজন আছে! যারা মানতে পারছেন না তারা তো ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছেন ঘরের কাজ মায়ের, বাইরের কাজ বাবার এবং তারা স্কুলে দেখেছেন গার্হস্থ্য অর্থনীতি নামের একটা সাবজেক্ট আছে যেটা মেয়েরা পড়ে আর ‘কৃষি ব্যবস্থাপনা’ ছেলেরা পড়ে।

অনুন্নত, পশ্চাদপদ, সামন্ত-পুঁজিবাদী, পিতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় গৃহস্থালীর কাজগুলোকে কেবলমাত্র নারীর কাজ বলে ধরে নেওয়ায় গার্হস্থ্য অর্থনীতি সম্পর্কিত বিষয়গুলোকেও নারীর ও গৃহের কাজ বলে মনে করা হয়। এছাড়া যেহেতু ঘর গৃহস্থালীতে প্রদেয় শ্রমের অর্থমূল্য নির্ধারণ করতে এ পিতৃতান্ত্রিক সমাজ নারাজ, সেহেতু তারা মনে করে গার্হস্থ্য অর্থনীতি শিক্ষাব্যবস্থায় যে বিষয়গুলো পড়ানো হয় সেগুলোরও অর্থনৈতিক উপযোগিতা তেমন নেই এবং যদি বা থাকেও তা শুধুমাত্র নারীর জন্যই।

গৃহ, গৃহ ব্যবস্থাপনা, খাদ্য ও পুষ্টি সম্পর্কিত জ্ঞান, শিশু লালন-পালন প্রক্রিয়া, টেক্সটাইল এন্ড ক্লথিং এসব একজন নারীর যেমন শেখা উচিৎ, একজন পুরুষেরও শেখা উচিৎ বলে আমি মনে করি। এবং একইসাথে মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় যে স্পষ্ট লিঙ্গীয় বৈষম্যমূলক দুটো বিষয় পড়ানো হয় তাও উঠিয়ে দেয়া উচিৎ বলে আমার মনে হয় সেক্ষেত্রে দুটো মিলে একটা যৌথ বিষয় হতে পারে কিংবা দুটোই আবশ্যিক করা যেতে পারে।

homeeconomicscollegeআমি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজের নারীদের এ আন্দোলনের সাথে সম্পূর্ণ একমত পোষণ করছিকারণ যেসকল বিষয় এখানে পড়ানো হয় সেসকল বিষয়ে শুধু নারীকে সংযুক্ত করে রাখার মানে দাঁড়ায়- ‘বাহিরে তোমার পদার্পণ ঘটেছে ঠিকই, ঘরটাও যেন আরেকটু বৈজ্ঞানিকভাবে চালাতে পারো এজন্য তোমাকে এসব বিষয়ে শিক্ষিত হওয়া জরুরি এবং গার্হস্থ্য অর্থনীতি সম্পর্কিত সকল শিক্ষা, পেশা শুধু তোমারই জন্য।’

নারীরাই শুধু গার্হস্থ্য অর্থনীতি পড়বে, এ ট্যাবু থেকে বেরিয়ে আসা খুবই জরুরি। মেয়েরা এই আন্দোলনে সফল হোক এ কামনা করি।

 

শেয়ার করুন:

আমি শাহীন স্কুলে পড়েছি৤ ওখানে ক্লাস সিক্সে আমাদের গার্হস্থ্য বিজ্ঞান এবং কৃষি বিজ্ঞান সাবজেক্ট ছিল৤ তবে আমরা চাইলে কৃষি বিজ্ঞান নিতে পারতাম৤ কৃষি বিষয়ে নারীরা পড়ছে তেমনি গার্হস্থ্য বিষয়ে পুরুষরা পড়তে পারে৤ আরেকটা বিষয় লক্ষ্যনীয় বিসিএস এ বেশি নাম্বার আসে বলে অনেক ছেলেরাও গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিষয়টা পছন্দ করতো৤ এখনকার করে কিনা আমার জানা নেই৤ আমিও নিয়েছিলাম৤ যত সহজ মনে করে নিয়েছিলাম তত সহজ মনে হয়নি৤ ফাহমি ইলা আপার লেখাটা ভালো লেগেছে৤

Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.