আঁধার-বাঁধন ছাড়িয়ে উঠুক মেয়েরা

ফারহানা আনন্দময়ী: বেঁচে উঠতে শিখুক আমাদের কন্যা সন্তানেরাওদেরকে বেঁচে উঠতে শেখাও, মায়েরা। আমাদের মা-খালা-চাচীরা আমাদেরকে কেবল ‘ভাল মেয়ে’ হতে বলেছিলেন। ভাল মানুষ হওয়ার কথা একবারও বলেননি। স্বতন্ত্র মানুষ হয়ে বেঁচে থাকার কথা কখনো বলেননি। তাঁদের কিছু কথা কানে ঢুকেছে, বেশিরভাগই কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আর তাইতো, নিজকন্যাকে ‘বেঁচে ওঠার’ কথা বলতে পেরেছি। ওর স্বপ্ন ওকে দেখতে শিখিয়েছি

Farhana Anando
ফারহানা আনন্দময়ী

ঘরে আমার কন্যাসন্তান ঠিক ততটুকুই সিদ্ধান্ত নেয়ার স্বাধীনতা, প্রশ্ন করার অধিকার ভোগ করে, যতটুকু পুত্রসন্তান করে। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে কন্যা বরং বেশিই করে। এইসব চর্চা দেখে আমার পুত্রের মগজে নারীর স্বতন্ত্রসত্তায় বিশ্বাস করার বিষয়টি গভীরে গেঁথে গেছে। ভাল-মন্দ দুটো চর্চাই সে চোখের সামনে দেখেছে, তার মায়ের জীবনের আলোকে। এবং সে ভালটাই গ্রহন করেছে। আমি বিশ্বাস করি, এই ছেলে কোনোদিন একটি নারীকেও অশ্রদ্ধা করবে না, তার কথায় এবং কাজে। মা হিসেবে এটা আমার পরম প্রাপ্তি

কন্যাকে শুনিয়েছি, শেকড় ছুঁয়ে শিখর স্পর্শের মন্ত্র। সে আত্মস্থ করতে পেরেছে, অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হয়ে কিছুতেই মুক্তি মিলবে না। সে পথচলা শুরু করেছে সেই গন্তব্যের লক্ষ্যে। স্বজন-পরিজনের নিরুৎসাহী কথা, সমালোচনা, উদ্বেগ সব পেরিয়েই সে পা বাড়িয়েছে। এখনও ছোট মেয়ে (১৮ বছর!), বিয়ে না দিয়ে কেন পাঠাচ্ছি, ওখানে গিয়ে বিধর্মী-ইহুদি কাউকে যদি পছন্দ করে বসে, পশ্চিমা পোশাক পরছে!

এমনও অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার, মেয়েকে এয়ারপোর্টে দিয়ে বাসায় ফিরেছি কেবল, … একজন পরমাত্মীয় ফোন করে বলেছেন, “ মেয়ে যখন লেখাপড়া শেষ করে ফিরবে তখন তো বিয়ে দেয়ার জন্যে পাত্র পাবি না। ওর অনেক বয়স হয়ে যাবে।“… এরকম অনেক অনেক কথা। আমার দিক  থেকে উৎসাহ না পেয়ে তারা চুপসে গেছে। আমাকে শুনতে হয়েছে, “ওর মা-ই তো ওকে বাতাস দিচ্ছে!”

হ্যাঁ, দিয়েছি। বাতাস দিয়েছি। সবকটা জানালা ওর খুলে দিয়েছি। তোমার পৃথিবীর দরজা এবার তুমি নিজে খুলতে শেখো, মেয়ে

মেয়েকে বলেছি, বেঁচে ওঠো। ‘তুমি আঁধার-বাঁধন ছাড়িয়ে ওঠো…’

মুক্ত পৃথিবীর মুক্ত মানুষ হয়ে বেঁচে থাকো

এইসব উদ্বেগকারীর দিকে তাকিয়ে আমার পাল্টা প্রশ্ন জাগে, এতোটা বয়স পর্যন্ত যে মেয়ে আমার চোখের সামনে বড় হলো, মন্দ-ভালোয়, আলোয়-আঁধারে এতো চেনা যে আমার, তাঁর প্রতি আমার কোনো ভরসা থাকবে না অথচ একটি অজানা পরিবারের অচেনা একটি পুরুষ, শুধু বৈবাহিক সূত্রে যে আমাদের পরিচিত হবে সেই পুরুষকে আমার নিজ সন্তানের চেয়েও বেশি ভরসাযোগ্য ভাববো? কেনই বা ভাববো? আত্মনির্ভরশীল হয়ে বেঁচে থাকার প্রথম ধাপেই কন্যাকে পরনির্ভরশীল রে তুলবো?

women-anandoপ্রশ্নকারীরা কি মনে করেন, মা-বাবা হয়ে নিজ কন্যাকে তবে এতোদিন কোনো জীবনবোধে, মূল্যবোধে শিক্ষিত করতে পারিনি? কেবল স্কুল-কলেজের একটা সার্টিফিকেট তাঁর গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছি? অথচ এই প্রশ্নকারীদের পুত্ররা যখন উচ্চশিক্ষার জন্যে দূরে যাবে তখন কিন্তু তাঁরা পুত্রকে বিয়ে দিয়ে দূরদেশে পাঠানোর চিন্তা ভুলেও মাথায় আনবেন না। নারী-পুরুষের এই ভেদাভেদের বীজ রাষ্ট্র এবং সমাজের আগে পরিবারেই বপন করা হয়। এবং দূর্ভাগ্যজনকভাবে সেই পরিবারগুলো আবার সার্টিফিকেটের বিচারে উচ্চশিক্ষিত

মা হয়ে তাঁকে আমি বলি, বিয়েটাই নারীজন্মের একমাত্র লক্ষ্য নয়, সূর্যমুখি হয়ে বাঁচাটাকেই জীবনের লক্ষ্য ক’রে এগোও গন্তব্যের পথে যদি কখনো মনে হয়, কোনো সম্পর্ক বিয়েতে পরিণাম পেলে তোমার জীবনটা আরো অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে, তখন বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ো তার আগে কিছুতেই নয়

আর কন্যাদের মায়েদেরকে বলি, অনুগ্রহ ক’রে আপনাদের কন্যাকে আরেকজনের ঘাড়ে চড়িয়ে দেয়ার জন্যে লালন-পালন করবেন না। নিজের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, হেঁটে-ফিরে চলতে পারে, এভাবেই ওদেরকে প্রস্তত করুন।

নিজের কন্যাদেরকে ভরসা করতে শিখুন, ওদের বোধ-বিশ্বাসে আস্থা রাখুননিজের বেঁচে ওঠার লড়াইটা কঠিন ছিল ব’লেই কন্যার  পথটাকে সহজ করতে তাকে পাশে থাকুন। তারাই কথা বলবে যারা নিজেরা বেঁচে উঠতে পারেনি… তাদেরই চোখ জ্বলবে, জ্বলতে দিন।

তসলিমা নাসরিনকেই ধার করে বলি,

“তুমি মেয়ে,

তুমি খুব ভাল করে মনে রেখো

তুমি যখন ঘরের চৌকাঠ ডিঙোবে

লোকে তোমাকে আড়চোখে দেখবে।

তুমি যখন গলি ধ’রে হাঁটতে থাকবে

লোকে তোমার পিছু নেবে, শিস দেবে।

তুমি যখন গলি পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠবে

লোকে তোমাকে চরিত্রহীন বলে গালি দেবে।

তুমি যদি অপদার্থ হও

তুমি পিছু ফিরবে

আর তা নাহলে

যেভাবে যাচ্ছ, যাবে।“

কবিতার কথাগুলো শুধু মেয়ের জন্যেই প্রযোজ্য নয়, বাতাস-দেয়া মায়েদের জন্যেও প্রযোজ্য। আর ওই যে ‘লোক’ বলা হলো… তারা শুধু পুরুষ নয়, নারীও থাকে তাদের মধ্যে। ###

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.