আশাহীন এবং উপায়হীন আকতার জাহান

ড. সীনা আক্তার: আত্মহত্যাকে বলা হয় ”অস্থায়ী” সমস্যার স্থায়ী সমাধান। এই সমাধানের পরিণতি সম্পর্কে সমাধানকারী কখনোই জানতে পারে না। তারপরও কেউ কেউ আত্মহত্যা করে, কেন? মূলত আশাহীনতা বা হতাশা (hopeless)এবং তীব্র অসহায় বোধ (helpless) মানুষকে আত্মহত্যা প্রবণ করে। পারিবারিক, সামাজিক, পেশা এবং অর্থনৈতিক সহ অনেক কারণেই একজন মানুষ তীব্র আশাহত এবং অসহায় বোধ করতে পারে। আকতার জাহান জলির হতাশা এবং অসহায় বোধের কারণ অনেকটা অনুমান করা যায়। সহকর্মী, শিক্ষার্থী সহ অনেকেই অনেক কারণ বলছেন। আমি ভিন্ন বিষয় যোগ করতে চাই।

sina
সীনা আক্তার

আকতার জাহান জলি তাঁর অবমাননাকর, নিপীড়নমূলক সম্পর্ক ছিন্ন করে দীর্ঘদিন টিকে ছিলেন। তার মানে, অতীত সম্পর্কের জটিলতা তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করেছিল মনে হয় না। তবে সেই জটিলতায় প্রভাবিত বর্তমান পরিস্থিতি তাকে হয়তো আশাহীন এবং উপায়হীন করেছিল। জলি-তানভীরের দাম্পত্য মনোমালিন্য, কলহ, বিচ্ছেদ এর প্রত্যক্ষদর্শী তাদের কিশোর ছেলে। জলির জীবনে এই ছেলেটা ছিল একমাত্র আশার প্রদীপ। কিন্তু বয়সের কারণে এ বয়সী অধিকাংশ ছেলে-মেয়েরা মা-বাবার আবেগ-অনুভূতি উপলদ্ধি করতে পারে না।

তাছাড়া, বিচ্ছেদের পর ছেলেটা দীর্ঘদিন বাবার সাথে বসবাস করেছে। এসব ক্ষেত্রে প্রায়ই একপক্ষ সন্তানকে নিজের পক্ষে রাখার জন্য অন্যপক্ষের বিরুদ্ধে রাগ-ক্ষোভ-ঘৃণা প্রকাশের মাধ্যমে সন্তানের কান ভারী করে। জলির ছেলের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়ে থাকতে পারে। বলাই বাহুল্য, আমাদের দেশে অধিকাংশ বিবাহ বিচ্ছেদ তিক্ত প্রক্রিয়ায় শেষ হয়, জলি-তানভীরের ক্ষেত্রে হয়তো এর ব্যতিক্রম হয়নি।

অনেক গবেষণায় দেখা যায়, পারিবারিক কলহ-বিবাদ-বিচ্ছেদের মধ্যে বেড়ে উঠা বাচ্চারা তীব্র মানসিক কষ্টের মধ্যে থাকে; তাদের মধ্যে উদ্বেগ, দুশ্চিন্তা, শিক্ষায় অমনোযোগ এবং বিচ্ছিন্নতায় ভোগার সম্ভাবনা থাকে। দূর্ভাগ্যজনক যে আমাদের দেশে মা-বাবার বিচ্ছেদ জটিলতায় সন্তানের মানসিক স্বাস্থ্যর ব্যাপারটি প্রায়ই উপেক্ষিত। জলির ছেলে হয়তো মা-বাবার কলহপূর্ণ বিচ্ছেদের যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতা বয়ে বেরাচ্ছে এবং ছেলের এই মানসিক অবস্থা হয়তো জলিকে আশাহীন করেছিল। পড়াশোনা, নিয়মাবর্তিতার বিষয় বলার কারণে এমনিতেই কিশোর বয়সীরা মা-বাবাকে ভুল বোঝে। এর সাথে কারো দ্বারা কান ভারি হবার বিষয় থাকলে তাদের মনে ঘৃনার জন্ম হয়। উপরন্তু, কিশোর বয়সীদের ক্ষতিগ্রস্ত মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতিকে অধিক খারাপ করে।

মনে হয় ছেলের সাথে জলি যতটা মানসিক নৈকট্য আশা করেছিল ততটা সে পায়নি, যা হয়তো তাঁকে অভিমানী করেছে, নিরাশ করেছে। একজন কিশোরের পক্ষে যে মায়ের অসহায়ত্ব অনুভব করার কথা না তা হয়তো জলির মন বুঝতে চায়নি। উল্লেখ্য, ছেলের বাবা তার নতুন সংসারে ছেলেটিকে অনেকটা আপদ মনে করে, নিজ স্বার্থেই জলির কাছে পাঠিয়েছিল। শোনা যায়, তার আগে ছেলেকে জলির সাথে দেখা করতে দেয়া হতো না। এর মানে তানভীর আহমেদ ছেলেকে ক্ষমতা’র গুটি হিসাবে ব্যবহার করে জলিকে মানসিক ও মনস্তাত্ত্বিক নির্যাতন করতেন। এসব সত্যি হলে শুধু এ কারণেই ছেলের বাবা তানভীর আহমেদের বিচার হওয়া উচিৎ।

আরো একটি বিষয় জানা যাচ্ছে যে, তানভীর আহমেদ কর্মস্থলে বিভাগের প্রধান হিসাবে জলিকে হয়রানী করতেন। এমনটা প্রায় স্বাভাবিক ঘটনা আমাদের সমাজে। এমনিতেই কর্মস্থলে উর্ধ্বতন অবস্থানের অনেক পুরুষ (সবাই না) নারী সহকর্মীদের উপর অন্যায় কর্তৃত্ব করে, হয়রানী এবং নিপীড়ন করে। আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বিচ্ছেদের পর একজন প্রাক্তন স্ত্রী বহাল তবিয়তে চাকুরী, জীবন-যাপন করছে এটা মেনে নেবার মত উদারতা অধিকাংশ সাবেক স্বামীদের নেই। আর যাদের ব্যাটাগিরি দেখানোর মত ক্ষমতা আছে সেখানে সে সম্ভাবনা আরো কম।

তানভীর আহমেদ তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে জলিকে হয়রানী করেছে কি না, কর্মক্ষেত্রের ক্ষমতা এবং ছেলেকে ব্যবহার করে জলিকে ব্ল্যাকমেল করেছে কি না, এই বিষয়টি তদন্ত করে তাকে জবাবদিহিতার মুখোমুখি করা উচিৎ। ছেলের বাবা এবং বিভাগীয় প্রধান হিসাবে তানভীর আহদেমের ক্ষমতার দাপটে জলি হয়তো ক্লান্ত, বিষন্ন এবং অসহায়-নিরুপায় হয়ে পরেছিলেন।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, তানভীর আহমেদ একজন ভাল বাবা হতে পারেন, শিক্ষক হতে পারেন, নতুন স্ত্রীর কাছে ভাল স্বামী হতে পারেন কিন্তু তার মানে এই না যে সে জলির প্রতি ভাল ছিলেন, সদয় এবং শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। কারণ প্রতিটা সম্পর্কের বৈশিষ্ট (dynamic) ভিন্ন, যেমন একজন ভাল বাবা একই সাথে একজন ভয়ঙ্কর স্বামী হতে পারে।  

আপাত দৃষ্টিতে জলির পাশে কেউ ছিল না, নিজ বাবা-মা-ভাই-বোন, ছেলে, সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব কেউ না। সে প্রকৃতই আশাহীন এবং অসহায় একজন ছিলেন। আত্মহত্যা কখনোই কোন সমাধান না, সমর্থনযোগ্য কিছু না। তবে একজন মানুষের অসহায়ত্বের গভীরতা আরেকজনের পক্ষে কখনোই অনুধাবন করা সম্ভব না এবং কতটা হতাশায় অবস্থায় একজন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয় তা উপলদ্ধি করাও অসম্ভব।

একজনের আবেগ-অনুভূতি একান্তই সেই মানুষটির ব্যক্তিগত বিষয়। সবকিছুর উপরে আকতার জাহান জলি একজন রক্তে-মাংষে মানুষ ছিলেন, তাই তাঁর আত্মহত্যার সিদ্ধান্তকে জাজ করা মানে তাঁকে অসন্মান করা। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

ড. সীনা আক্তার: সমাজবিদ, প্যারেন্টিং পেশাজীবী।

 

শেয়ার করুন: