আকতার জাহানের আত্মহত্যা এবং দাম্পত্য সম্পর্কের পুনর্পাঠ

ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা: আকতার জাহান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। তিনি আমার বেশকিছু পরিচিতজনের অতি কাছের মানুষ, আর এই কাছের মানুষ থাকাটা আমি তার আত্মহত্যা এবং তদপরবর্তী সংবাদ হয়ে উঠার সময় টের পেতে থাকি।

shuvra
ফাতেমা সুলতানা শুভ্রা

আকতার জাহানের আত্মহত্যা নিয়ে একসারি লেখা উইমেন চ্যাপ্টার নামে একটি ওয়েব পোর্টালে ছেপেছে। সুস্মিতা চক্রবর্তী, শাওলী মাহবুব, কাবেরী গায়েন- প্রমুখ অগ্রজ’রা আকতার জাহানকে নিয়ে লিখেছেন। আজকে সকালেই পড়ছিলাম বন্যা আহমেদের লেখা, উনি কাবেরী গায়েনের লেখা প্রসঙ্গে বলছিলেন, লেখাটার কিছুক্ষেত্রে বন্যা আহমেদের দ্বিমত থাকার অর্থ এই নয় যে আলোচনাটায় কোন অর্থবহ প্রসঙ্গ নাই। আকতার জাহানের আত্মহত্যা বিষয়ে আমার অগ্রজদের সকল লেখা প্রসঙ্গে আমার অবস্থানটা ঠিক এইরকম। (আত্মহত্যা নিয়ে আমার কোন অরুচি নেই, আমি বিশ্বাস করি যে কেউ তার জীবনে যেকোন সময় যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে ততোক্ষণ পর্যন্ত যতোক্ষণ সেটি অন্যের কোন ক্ষতির কারণ না হয়। ফলে আত্মহত্যা নিজকে হত্যা তার নিজস্ব ভাবনা ও চিন্তার বিষয়।)

আকতার জাহানের কাছের মানুষদের লেখালেখি থেকে যা জানা যায়, বিশেষ করে শাওলী মাহবুব সমেত আরো অপরাপর অনেকের লেখায় যে তিনি খুবই মৃদুভাষী কিংবা খুব কম কথা বলতেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি শাওলী মাহবুবের জুনিয়র কলিগ গেল পাঁচ বছর ধরে। উনাকে এতোদিন ধরে বহুবার আমি নিজে বলে এসেছি, আপা, আপনি কথা বলেন চিৎকার করেন [একাডেমিক বিষয়ে, ধরেন কোন বিভাগের সাথে বাতচিত করা প্রসঙ্গে]। শাওলী মাহবুব যখন বলেন, আকতার জাহান অনেক কম কথা বলেন সেটি অবশ্যই একটা ভাবনার বিষয়। আমাদের নারীবাদী ভাবনা থেকে প্রশ্ন তোলা উচিত যে সমাজের উঁচুস্তরের রক্ষণশীল পরিবারগুলোতে কী প্রক্রিয়ায় আসলে এভাবে “সাত চড়ে রা করে না এমন মেয়েদের জন্ম হয়।”

আকতার জাহানের মৃত্যুর সবচাইতে বড় বিপ্লবটাই হচ্ছে তার এই আত্মহত্যার দরুণই তার প্রসঙ্গে অনেকগুলো রা রা রা উঠেছে। এইজন্য তার আত্মহত্যার সিদ্ধান্তকে আমি মারহাবা জানাই। কারণ তার কাছের বন্ধুরাও বন্ধুত্বের খাতিরেও, বন্ধুত্ব রাখবেন না এই হুমকি দিয়ে হলেও তার মিউটেডনেস বা নিশ্চুপ থাকাটাকে একটু সবল করতে পারেননি।

ব্যস্ততার এই সময়ে আসলে আমরা কেউই পারি না। কেউই কারো সাথে থাকতে পারি না। যতোই ভগিনীবন্ধনের কথা বলি না কেন। কীভাবে এই ভগিনীবন্ধন আরো জোরদার করা যায়, ক্যাম্প না করে, সেটা নিয়ে ভাবা যায়। আর ভাবা যায় কীভাবে আরো আরো তথ্য আমাদের হাতে আসতে পারে। এখন প্রশ্ন হলো কিসের তথ্য?

বিয়ের সম্পর্ক এই পুরুষালী সমাজব্যবস্থায় কখনই সমতার সম্পর্ক নয়। বিয়ে মানেই পুরুষালী মতাদর্শের জয়জয়কার, যেখানে পুরুষালী ভাবনার ধারক হিসেবে পুরুষকে সম্মান ও রাজার আসনে অধিষ্ঠিত করা হবে। বিয়ের সম্পর্কে যাওয়া মানেই অসমতার মধ্যে যাওয়া। এই অসমতা সামাজিক-টাকাকড়ির-মর্যাদার-শারীরিক ও মানসিক। সবসময় যে পুরুষই অসম থাকে এমন নয়, যেখানে পুরুষ নাই অসমতায় সেখানে নারী অংশটি বিয়ের সম্পর্কে অসম ক্ষমতা চর্চা করতে শুরু করে। খোদ বিয়ে একটি সামন্তবাদী প্রতিষ্ঠান। মিষ্টত্ব যদি কিছু থেকে থাকে, তবে এখনও পর্যন্ত আমার মনে হয় এতে সেটি হলো সন্তান, বাচ্চা একটা পুতুলের মতো, দেখলে ভাল লাগলে, কিছু ব্যতিক্রম বৈবাহিক সম্পর্ক তো আছেই। উনাদের সালাম।

যেহেতু আমি টুকটাক সহিংসতা নিয়ে কাজ করি, পারিবারিক নির্যাতন নিয়ে আমার কাছে কিছু গবেষণার তথ্য আসে। আকতার জাহানের যারা বন্ধুস্থানীয় তাদের লেখা [শাওলী মাহবুব, রিফাত ফাতিমা, আ-আল মামুন, বর্ষা জোহিন প্রমুখ] আকতার জাহানের বিবাহকালীন স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের কথা বলে। খুবই ভাল কথা, কারণ এই নিপীড়নের ঘটনাগুলো তো জানা ছিলো না। কিন্তু বিষয় হলো, নিপীড়নের কারণেই তো আসলে ডিভোর্স হয়েছে। আমরা দাম্পত্য সম্পর্কে থাকাকালীন আমাদের উপরে যে যে নিপীড়ন হয় সেগুলো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখবার তাগিদে কোনদিনই কোন চিহ্ন রাখি না। আকতার জাহান, উচ্চ মধ্যবিত্তের ঢাকাইয়া রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে তিনি রাখবেন না- এটা খুবই স্বাভাবিক। ধরেন ছয় মাস ধরে আপনি জানেন আপনি ডিভোর্স দিবেন, বা দিতে পারেন এর মধ্যে আপনাকে দিলো মার, আপনার উচিত থানায় গিয়ে ডিভোর্স যাকে দিবেন তার বিরুদ্ধে জিডি করা।

এগুলো কেবল ডিভোর্স নয়, আপনার বাচ্চার কাস্টডি, আপনার উপরকার নির্যাতন মামলা দায়ের করবার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিবেচিত হবে। যেহেতু আকতার জাহান এসব করেন নাই এবং ডিভোর্স হয়েছে, তাহলে তানভীর আহমেদ তার প্রাক্তন স্বামী যিনি নিপীড়নের কারণে ডিভোর্সড হয়েছেন তাকে দ্বিতীয়বার আর শাস্তি দেওয়া যায় না, উপায়ও নাই।

তানভীর আহমেদ, আকতার জাহানের মৃত্যুর পর তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন যে আকতার জাহানের সাথে তার ডিভোর্স হয়েছিলো পরকীয়া বা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের কারণে। এটি আকতার জাহান এবং তার বন্ধূদের খুবই স্টিগমাটাইজড করে। আমাকে কেউ যদি বেশ্যা বলে, আমার তেমন মন্দ লাগে না, বরং খদ্দের বললে লাগলেও লাগতে পারে। বিষয় হলো, পরকীয়া যদি আকতার জাহানের থেকে থাকে, তবে কি তার সাথে বিয়ের সম্পর্কে থাকাকালীন নিপীড়ন করাটা জায়েজ হয়ে যায়? কিংবা তানভীর আহমেদের পরকীয়া করাটা জায়েজ কিংবা তানভীর আহমেদের পরকীয়া না থাকলেই কি উনি তার স্ত্রী কিংবা ডিভোর্স দেওয়া স্ত্রীকে শায়েস্তা করতে পারেন?

মানে, ধরেন, যে নারী পরকীয়া করেছে, ফলে সমাজের ভাবনায় “ভাল মেয়ে না” তাকে আত্মহত্যায়” প্ররোচনা” দেওয়ার মামলা করবার কোন উপায় নাই? সাক্ষ্য আইন কিন্তু এই ক্ষেত্রে বলবৎ নয়।

সুস্মিতা চক্রবর্তী একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা হাজির করেছেন। তিনি বলছেন, আকতার জাহানকে, তার প্রাক্তন স্বামী বিভাগীয় সভাপতি হিসেবে নানাভাবে বিভাগীয় কর্মকাণ্ডে নাজেহাল করেছেন। আমি বলবো, এটি হয়রানি এবং নারী কর্মী হিসেবে যৌন হয়রানি। বিয়ে শেষ হয়েছে বলে ঝাল মেটানোর ক্ষেত্র বিভাগের পরিসর যে নয় সেটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিশ্চিতভাবে একাডেমিক ও কাঠামোগতভাবে ধারণ করবার কথা। আত্মহত্যা ও হয়রানির অভিযোগ অবশ্যই একাডেমিক কমিটির রেজুলেশান খাতা থেকে তদন্ত করে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত।

একটি সুষ্ঠু তদন্ত প্রকাশিত হোক, দেখা হোক আকতার জাহানকে কী কী ভাবে হেনস্থা করা হয়েছে- যেমন ধরেন, কোর্স পড়ানো হয়েছে, খাতা দেখতে দেওয়া হয়নি [তাতে টাকা পাবেন না (খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া, শিক্ষার্থীদের কাছে পঙ্গু করে দেওয়া), একসারি পরীক্ষার ডিউটি থেকে বাতিল করা হয়েছে, সিনিয়র হিসেবে বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব না দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। বিভাগের সহকর্মী যারা হয়রানির সাক্ষী ছিলেন তারা মামলার জন্য এগিয়ে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে গুরুত্বের সাথে পাবলিক একাডেমিক পরিসরকে ব্যক্তিগত রোষ ও ঝাল মেটানোর জায়গা বিবেচনার প্রবণতা রোধ করবার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসতে রাজনৈতিক চৈতন্যে এগিয়ে আসতে বাধ্য করেন। সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামো তার সদস্য- ছাত্র শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী ও প্রশাসন দিয়েই সবল ও সজীব রাজনীতি ধারণ করে।

মার খেয়ে নীরব থাকা কোন সমাধান না। ভদ্র থাকা তো নয়ই। ভদ্রতা কেবল ঘেন্নাই জন্মায় এমনকি নিজের জন্যও।

১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬

 

শেয়ার করুন:

সমাজের মাঝে বিয়ের যে ধরন রয়েছে সেটিতে কোন না কোন পক্ষ অসম অবস্থাতেই থাকে। লেখক গুরুত্বের সাথে এই সামাজিক বিশ্লেষণটি হাজির করেছেন। আমরা সর্বক্ষণ সাদা কালোতে দেখি। ফলে বিয়ে সম্পর্কের মধ্যে সমস্যা দেখা মানেই লিভ টুগেদারকে সমাধান হিসেবে দেখার কথা কোথায় বলা হলো আমি অন্তত এই লেখায় তার কোন আভাস পেলাম না।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক আকতার জাহান আত্মহত্যায় বিভাগের সভাপতি তানভীর আহমেদের ব্যক্তিগত রোষানল কাজ করেছে কিনা এবং তিনি সেজন্য বিভাগকে ব্যবহার করেছে কিনা- এই অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির দিকে ইঙ্গিত করবার জন্য লেখককে ধন্যবাদ জানাতে চাই। সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার পাবলিক পরিসরকে মানবতাবাদী পরিসরমূখী করে তুলবে বলে বিশ্বাস করি।

উপরের কমেন্টস পড়ে মনে হল ওনি আসলে পুরুষতন্ত্রের জান্ডাধারী ছাড়া আর কিছুই না।

“বিয়ে হচ্ছে পুরুষতন্ত্রবাদী আধুনিক সমাজ ব্যবস্থায় দাসত্ব প্রথার চরম নিদর্শন”

আপনার বিশ্লেষণ ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।

লেখাটা আমার ভাল লাগলো। বিশেষ করে শেষের এই অংশটুকু …

‘একটি সুষ্ঠু তদন্ত প্রকাশিত হোক, দেখা হোক আকতার জাহানকে কী কী ভাবে হেনস্থা করা হয়েছে- যেমন ধরেন, কোর্স পড়ানো হয়েছে, খাতা দেখতে দেওয়া হয়নি [তাতে টাকা পাবেন না (খুবই গুরুত্বপূর্ণ, অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দেওয়া, শিক্ষার্থীদের কাছে পঙ্গু করে দেওয়া), একসারি পরীক্ষার ডিউটি থেকে বাতিল করা হয়েছে, সিনিয়র হিসেবে বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কাজের দায়িত্ব না দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। বিভাগের সহকর্মী যারা হয়রানির সাক্ষী ছিলেন তারা মামলার জন্য এগিয়ে আসেন। বিশ্ববিদ্যালয়কে গুরুত্বের সাথে পাবলিক একাডেমিক পরিসরকে ব্যক্তিগত রোষ ও ঝাল মেটানোর জায়গা বিবেচনার প্রবণতা রোধ করবার জন্য জরুরি পদক্ষেপ নিতে এগিয়ে আসতে রাজনৈতিক চৈতন্যে এগিয়ে আসতে বাধ্য করেন। সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় কাঠামো তার সদস্য- ছাত্র শিক্ষক কর্মকর্তা কর্মচারী ও প্রশাসন দিয়েই সবল ও সজীব রাজনীতি ধারণ করে।
মার খেয়ে নীরব থাকা কোন সমাধান না। ভদ্র থাকা তো নয়ই। ভদ্রতা কেবল ঘেন্নাই জন্মায় এমনকি নিজের জন্যও।

আমাদের কিছু কিছু নারী আছেন যারা এ ধরনের কথা বলে বা লিখে একটু বিজ্ঞজন বা স্পষ্টভাষী হবার চেষ্টা করেন। বিপ্লবী হবার প্রয়াস পান।
অশিক্ষিত সমাজে ব্যতিক্রম আছে অবশ্যই। আমি বলব সচরাচর পুরুষেরাই বরং বেশি নিয্রাতীত হয় আমাদের সমাজে।