কাবেরী গায়েনের লেখা এবং আমার কিছু প্রশ্ন

মৌসুমী কাদের: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আকতার জাহান জলি’কে নিয়ে সম্প্রতি কাবেরী গায়েনের একটা লেখা (উইমেন চ্যাপ্টারে প্রকাশিত) পড়লো। কিছু বিষয় এতোটাই ঘোলাটে যে লিখতে বসতে বাধ্য হলাম। তার লেখার একটা জায়গায় আছে:
শাওলী মাহবুব (উইমেন চ্যাপ্টারের আরেকটি লেখায়) লিখেছেন, জলি শেষদিনগুলোতে মেলামাইনের প্লেটে ভাত খেতেন। কাম অন, জলি সহযোগী অধ্যাপক, থাকতেন জুবেরীতে, বাস করতেন রাজশাহীতে। তাঁর মেলামাইনের প্লেটে ভাত খাবার মতো অর্থনৈতিক দারিদ্র ছিলো না। কিন্তু যে সমাজকে তিনি ট্যাক্স দিয়ে চলেছেন, সেই সমাজের অদৃশ্য চাহিদামাফিক বিয়ে-বিচ্ছেদ হয়ে যাওয়া নারীর যে গরীব চেহারাটা কাম্য, তিনি সেই চেহারাটার প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছেন। অজান্তেই।‘

akter-jahanকাবেরী গায়েনের এই লেখায় এক ধরনের দোষারোপের সুর আছে। যখন মানুষ আত্মহত্যা করে তার আগে সে অনেকগুলো স্তর পার করে আসে, তারপর একটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন ধরুন, যদি তাঁর চিন্তাশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সমাজের নানা ঘটনাগুলো সে ঠিকঠাক মেলাতে পারেনা, সচেতনতাবোধ রোধ পায়, ভাল মন্দ বিচারের ক্ষমতা থাকেনা, বাস্তবতা বোঝার ক্ষমতা লোপ পায়, বা পারিপার্শ্বিক অনেক কিছু তুচ্ছ হয়ে যায়…ইত্যাদি। এখানে দরিদ্র থাকার প্রতি বিশ্বস্ত হবার কিছু নেই। মেলামাইনের প্লেট কেন সে যদি হাড়ি থেকেও ভাত খায় সেটার সংগে দারিদ্রতার তুলনা করা ভুল হবে। তার চিন্তাশক্তি তাঁকে যেদিকে তাড়িত করেছে মানসিক স্বাস্থ্যের সেই স্তর থেকে সে জীবন যাপন করেছে।

আরেক জায়গায় লিখেছেন, ‘ সমাজ আর পিতৃতন্ত্রের চাহিদামাফিক স্বামীহীন নারীর সবক’টি চিহ্নের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে গিয়ে ক্রমাগত তিনি নিজেকে বঞ্চিত করেছেন এবং সেই বঞ্চনা তাঁর শক্তি আর লড়াই করার ক্ষমতাকে তিলে তিলে শেষ করে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা পর্যন্ত ঠেলে দিয়েছে।‘

আসলে কি তিনি নিজেকে বঞ্চিত করেছেন? না কি তাকে বাধ্য করা হয়েছিল সেটা করতে। তিনি বিশ্বস্ত থাকতে চেয়েছিলেন, এটাই বা বোঝা গেল কি করে? আমরা তাঁর শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্য, পারিবারিক সম্পর্ক, সামাজিক বা ব্যক্তিসম্পর্ক, দৈনন্দিন যাপিত জীবনের চাপ, পারিবারিক ইতিহাস, সাইকোট্রপিক মেডিসিন ইউজ, স্পিরিচুয়েল ক্যাপাসিটি ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি কতটা গভীরে জেনে এই কথা গুলো লিখছি? একটা মানুষ ‘আত্মহত্যা’ কেন করেছে সেটার জন্য জাজমেন্টাল হবার কোন উপায় নেই। We don’t see the world what it is, we see the world what we are, আর একারনেই এই দেখাটা সম্পূর্ণতা পায়না। (কমন রিস্ক ফ্যাক্টর নিয়ে লেখা লিখলে – (যেমন আশাহীনতা, ইনসমনিয়া, সম্পর্কের ভাঙন’ প্রতিশোধ পরায়নতা, সমাজিক/ পারিবারিক চাপ থেকে মুক্তি)সেটি সেই ব্যক্তির আত্মহত্যার মূল কারণ কে অন্যদিকেও সরিয়ে দিতে পারে।

mou
মৌসুমী কাদের

আরেক জায়গায় কাবেরী লিখেছেন; ‘বিচ্ছেদপ্রাপ্ত নারীর যে সর্বস্বহীন অবয়ব নির্মিত হয়ে আছে আমাদের চারিপাশে, সেই অবয়ব ধরে রাখার অবিরত লড়াইয়ে একধরনের ‘শ্রদ্ধা’ কুড়িয়ে তিনি আত্মহননের পথেই মুক্তি খুঁজলেন। এই ‘ফাঁপা শ্রদ্ধা’র ফাঁদ থেকে বেরিয়ে না আসা পর্যন্ত মেয়েদের মুক্তি নেই।

ব্যক্তিগত জীবনে কোন নারী বিচ্ছেদপ্রাপ্ত হলে সে ‘সর্বস্বহীন অবয়বে একধরনের শ্রদ্ধা কুড়াতে চান’ সেটাই বা কাবেরী জানলেন কী করে? তিনি কি জানতেন জলির আদৌ শ্রদ্ধা কুড়াবার কোন সখ বা ইচ্চছা ছিল কীনা? তিনি কি জানতেন, জলির ‘ক্লিনিক্যাল মেন্টাল ডিজঅর্ডার’ ছিল না কি ‘পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার’ ছিল? এগুলোর কোনটাই কি গভীরে যাচাই করা হয়েছিল? আবার বলছি, ‘আত্মহত্যা নিয়ে সরলীকরণ’ করা উচিত নয়। ব্যক্তি বিশেষে ‘মেন্টাল স্টেট’ ভিন্ন হয়। এক কথায় ‘উনি আত্মহত্যা করে শ্রদ্ধা কুড়াতে চেয়েছেন’ এটা বলে আসলে উনি জলিকে আরো ছোট করলেন। কাবেরীর লেখাটা খুব গড়-পড়তা না হলেই বোধহয় ভাল লাগতো।

শেয়ার করুন:

যতই ব্যবচ্ছেদ করেন, এই ফ্যাক্টটা তো থেকেই যায় তিনি আত্নহত্যা করেছেন। আর এটাও একলাইনে বলা যায় তাঁর এক্স এইজন্য দায়ী।
লেখা পড়ে মনে হল আপনি আক্তার জাহানের প্রাক্তন স্বামীর বন্ধু। বন্ধুত্ব ভাল, অন্ধত্ব কিছুতেই কাম্য না।