শিল্পী জলি: শেষ হইয়াও হইলো না শেষ– ছোট গল্পের বৈশিষ্ট্য। বাচ্চাসহ ডিভোর্স অনেকটা তেমনই। বার বার অসহনীয় চেহারাটিকে দেখতে হয়, বীভৎস অভিজ্ঞতাটির মুখোমুখি হতে হয়, নানাবিধ দেন-দরবার করতে হয়। সত্যিকার অর্থে ডিভোর্স হয় শুধু কাগজে-কলমে। বাকি পীড়ণ-যাতন সবই থাকে। এমনকি নিয়মিত যোগাযোগে কেউ কেউ সেক্সও বৈধ বলে দাবি করে বসতে পারে–আমরা-আমরাই তো, যদি তখনও কোন পার্টনার জুটে না যায় ভাগ্যে!
আমেরিকায় বাঙালী দু’জন মহিলার বাচ্চাসহ ডিভোর্স হয়েছিল। তাঁদের ভোগান্তি দেখেছি। বাচ্চার সুবাদে এক্সের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হতো, বাচ্চার পাওনা টাকা পেতে আলগা খাতির দিতে হতো, কোথায় গেল না গেল তার বিষদ বর্ণনা দিতে হতো, প্রতিবেশী এবং বাচ্চার মাধ্যমে খবর সংগ্রহের চেষ্টা চলতো, আরও কত কী?
যে বর কথায় কথায় বুকের উপর বসে গলা চেপে ধরতো, নিজের আয়ের পঞ্চাশ ডলার খরচ করলে চড়াও হতো, স্নো’র মধ্যে গরম কাপড় ছাড়া বাইরে বের করে দিতো, যার কাছ থেকে বাঁচতে পুলিশের সাহায্য নিতে হতো, সেই বরও ডিভোর্সের পর বাচ্চার সুবাদে পলে পলে ফুল পাঠায়, ‘লাভ ইউ’ জানায়, আবার শুরু করতে চায়।
আর এক্সের যদি বিয়ে হয়ে যায় তার পরেও কি শান্তি জোটে?
মুক্ত হওয়া যায় ঐ সম্পর্কটির ঘানি টানা থেকে? হয়তো সবক্ষেত্রে নয়।
অনেক এক্স-ই তার নতুন বউ কেমন হলো, তার বয়স কত, কত সুখে আছে, কয়টা বাচ্চা হলো, কয়টা বাড়ি হলো, কয়টা গাড়ি হলো, কতটা সভ্য হয়ে উঠেছে …ইত্যাদি নিয়ে প্রাক্তন স্ত্রী’র দরবারে ক্ষণে ক্ষণে হাজিরা দেয়।
বোঝাতে চায়, দেখো কত লোকসান হয়েছে তোমার। আর নতুন বউটি যদি নৈকুলি হয়, ব্যক্তিত্বের পার্টস যদি ঢিলা থাকে, তাহলে সেও তার তালে তালে নাচে। বোঝে না যে এই দিন দিন নয়, খারাপ দিন তারও আসতে পারে। বিবি বদল হলেও জনাব যে একই আছে–রঙ বদলাতে কতক্ষণ ?
ডিভোর্স কোন সহজ বিষয় নয়। বিশেষ করে আমাদের দেশের মত সমাজে। ছোটবেলাতেই আমাদের কানপড়া দেয়া হয় ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। ‘বিয়ে করে বরের ঘরে যাচ্ছো, কাফনের কাপড় পরে বরের ঘর থেকে বের হবে– তার আগে নয়।’
কখনও শেখানো হয় না স্বামী যথাযথ আচরণ না করলে কী করতে হবে? তার পরিবার অত্যাচার করলে কী করতে হবে? স্বামী পরনারীতে আসক্ত হলে কী করতে হবে? বর ডিভোর্স চাইলে কী করতে হবে? যৌতুক চাইলে কী করতে হবে? কথায় কথায় গলাধাক্কা, মারধর, গালাগাল করলে কী করতে হবে?

দেশে যদিও কড়া আইন আছে, তবে সেই সুবিধাভোগের প্রচলন নেই– সমাজ তার ঘোরবিরোধী। এখনও সমাজে ডিভোর্স হলে মেয়েকে দায়ী করা হয়, আকার ইংগিতে তার চরিত্র, রূপ, গুণ, শিক্ষা, দীক্ষা, ক্ষমতা ইত্যাদির ঘাটতিজনিত বিশ্লেষণ করা হয়, জনে জনে ফিসফাস হয়, এড়েটেড়ে কথা চলে। তদুপরি যদু-মধু-কদু হাত বাড়ায় আলগা সুবিধা পেতে, ফাঁকিতে ছুঁয়ে যেতে। অবস্হা দেখে মেয়েটি ধীরে ধীরে সমাজে বাস করেও আইসোলেটেড হয়ে পড়ে।
তাছাড়া, আমাদের দেশে মেয়েদের ডিভোর্স হলেও তাদের অনেকেই দ্বিতীয় বিয়ের কথা ভাবার সাহস করে না, এমনকি বয়স বিশ-বাইশ হলেও নয়। আগে থেকেই তাদের চরিত্র দোষ, পরকীয়া, ইহকীয়া, মাথা খারাপ, বদমেজাজ নানা বিশেষণে বিশেষিত করে কোণঠাসা করে ফেলা হয়, যেন ঘাড় উঁচু করে আর দাঁড়াতে না পারে। তাই শিক্ষিত এবং আত্মনির্ভরশীল মেয়ে এবং তাঁদের পরিবারও সাহস করে না সময়ে যথাযথ পদক্ষেপটি নিতে। কেননা তাঁরা জানে ডিভোর্সের পরের জীবনের যাতনাও কম নয়।
তাই রুমানা, বা আকতার জাহানের মতো মেয়েরাও ভুল বিয়ের ঘানি টানতে গিয়ে হিমশিম খায়, জীবনের অতি মূল্যবান সম্পদ হারিয়ে ফেলে, কখনও বা একেবারেই নিঃশেষ হয়ে যায়– অতি আদরে বড় হয়ে অনাদরে ঘায়েল হয়ে যায়।
অথচ বিয়ে একটি চুক্তি মাত্র, যেটা একপক্ষ চাইলে জীবনের যেকোনো সময় ভেঙে যেতে পারে, করার কিছুই থাকে না। যেটা ধর্মীয় এবং রাষ্ট্রীয়ভাবেও স্বীকৃত। কিন্তু সমাজ এখনও মানতে পারে না। ভালোবেসে বিয়ে করেও কোন মেয়ে যদি ভাবে, না ঐ ঘরে আমি আর থাকতে পারছি না, দম নিতে পারছি না, নিরাপদ অনুভব করছি না, ক্লান্ত হয়ে পড়ছি, জীবন আর টানতে পারছি না– তাহলে চলে আসতে বাধা কোথায়?
বাধা একটিই–সমাজ কী বলবে? লোকে কী ভাববে?
কথায় আছে, নিজে বাঁচলে বাপের নাম ! যার জ্বালা সেই বোঝে।
সমাজ কী ঐ জীবনটি যাপন করছে–বছর, মাস, সপ্তাহ, দিন, ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড হিসেবে?
দিনের পর দিন মানুষ একটি এ্যবিউসিভ রিলেশনে থাকলে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে, ঠিকমতো ঘুমুতে পারে না, খেতে পারে না অথবা দিনরাত খায়, কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, নেগেটিভ চিন্তায় আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। তার সুখ-শান্তি, আশা-ভরসা বলে জীবনে আর কিছু বাকি থাকে না। দিনকে দিন তার ক্লান্তি বাড়তে থাকে। আশার সাথে পাওয়ার মিল না থাকায় সে বর্তমান ভবিষ্যত সবই অন্ধকার দেখে। একটি খালিপান/শূণ্যতা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। হতাশায় এক সময় হয়ত জীবনের ভারও আর বইতে পারে না।
আর বাচ্চাসহ যারা ডিভোর্সের মধ্য দিয়ে যায় তাঁদের অবস্হাতো আরও ভয়াবহ। বেশীর ভাগ সময়ই বাচ্চার টানাটানিতে তাঁকে নানাজনের সাথে শুইয়ে দেয়া হয় অথবা মাথা খারাপের পরীক্ষায় বসিয়ে দেয়া হয়। সমাজও সহজেই ঐ দু’টো লক্ষণ আনন্দের সাথে লুফে নেয়। সেই সাথে থাকে টাকার লড়াই, ক্ষমতা প্রদর্শনের লড়াই, আরও কত কী!
এসব টানাটানিতে অনেক মেয়েই ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছে যায়। যখন তাঁর বেঁচে থাকার জন্যে সত্যিকার অর্থেই মেডিকেল হেল্প এবং কাউন্সিলিং জরুরি হয়ে পড়ে, একটি শক্ত-নির্ভরযোগ্য- মজবুত কাঁধও দরকার হয়। কিন্তু আমাদের সমাজে এসব সহযোগিতাকেও ভালো চোখে দেখা হয় না। তাই লোকলজ্জার ভয়ে মানুষ এই সুবিধাটুকু নিতেও এগুতে পারে না।
অথচ জীবনে চলতে প্রতিটি মানুষই কখনও না কখনও হতাশ হয়ে পড়ে, হাল ছেড়ে দেয়, জীবন থাকলেও জীবনের ছন্দ থাকে না, যখন সহযোগিতা এবং সহানুভূতি অতি জরুরি — এটা ছেলেমেয়ে সবার ক্ষেত্রেই হতে পারে। কেননা মানুষের জীবনে উত্থান-পতন থাকে, ব্যর্থতা থাকে যখন হেল্প পেলে হয়ত জীবনটি আবার জেগে ওঠে বেঁচে থাকতে।
সম্প্রতি দীপিকা পাদুকনের একটি ভিডিও দেখলাম। সে ডিপ্রেশনে আক্রান্ত হয়ে পড়েছিল। সব থাকতেও ভয়াবহ শূণ্যতায় তার মাকে ধরে হাউমাউ করে সে কেঁদে উঠেছিল। ক্লান্তিতে দিনভর শুয়ে থাকতো, শক্তি পেত না, জীবনের অর্থ খুঁজে পেত না, বাঁচার আনন্দ ছিল না। সে যথা সময়ে চিকিৎসা পেয়ে আবার জীবনের হাল ধরেছে। হয়তো আকতার জাহানও সময়ে চিকিৎসা পেলে জীবনের হালটি শক্ত হাতে আবার ধরতে পারতেন।
আমেরিকাতে সাধারণ ডাক্তার দেখাতে গেলেও কিছু ফরম পূরণ করতে হয়। যেখানে নানাবিধ প্রশ্ন থাকে যেমন বাসায় নিরাপদ কিনা, মরে যেতে ইচ্ছে করে কিনা, হোপলেস মনে হয় কিনা, কাজে আগ্রহ আছে কিনা, ডাউন ফিল হয় কিনা….। অতঃপর সব পয়েন্টস যোগ করে অবস্হা বুঝে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হয়, চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয় যেন আত্মহত্যা না করে, যেন জীবনটি তার সহজ হয় ।
ডাক্তার কথা বলে পেশেন্টের চিন্তার ধরন দেখে, খোলাখুলি আলোচনার মাধ্যমে নানা অপশন দেখিয়ে দেন। যারা অতীত, বর্তমান, এবং ভবিষ্যত চিন্তায় সংঙ্কিত হয়ে গোলক ধাঁধায় আটকা পরে তাদের বোঝানো হয় শুধু বর্তমানে ফোকাস করতে, প্রয়োজনে শুধু দিন বা ঘন্টাটি পার করতে।
অতীত যাপন হয়ে গিয়েছে, ভবিষ্যত এখনও আসেনি–আজ ভালো না গেলেও আগামীকাল ভালো হবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। মানুষের সময় ক্ষণে ক্ষণে বদলায়, সেই সাথে আশা এবং চাওয়া-পাওয়াও। আজ যেটা হলো না বলে ভয়াবহ কষ্ট হচ্ছে, কাল হয়তো সেটা পেলেও মন নিতে চাইবে না।
মানুষের নেগেটিভ চিন্তাই তাকে তাড়িত করে। যেটা নানাভাবে সমাজ হয়তো তার মাথায় আদর্শ জীবন হিসেবে ঢুকিয়ে দেয়। তাই সে আর ভিন্ন ধরনের একটি জীবনকে আদর্শ বা কাংঙ্ক্ষিত জীবন হিসেবে ভাবতে পারে না। হাল ছেড়ে দিতে চায়। জীবনের এই পরিস্হিতিতে মানুষ ডাক্তারের কাছে গেলে কথা বলে ঔষধ দিয়ে একদিকে তার বুকের ব্যথা, পেটের চাপ, দম বন্ধ হয়ে যাওয়া ভাব, খাওয়া-ঘুম ফিরিয়ে আনা ইত্যাদির ব্যবস্হা করা হয়, অন্যদিকে সুন্দর একটি জীবনের ছক এঁকে বুঝিয়ে দেয়া হয় যে জীবন এখনও বাকি–পাবার আছে অনেক কিছুই।
অনেক সময় সেরটিনন এর ভারসাম্যহীনতাকে দায়ী করা হয় এই বৈরী পরিস্হিতির জন্যে, তখন যথাযথ ঔষধ সেবনও জরুরি হয়ে পড়ে।
মানুষের আশাই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে। জীবনে যেমন হাজার না পাওয়া থাকে তেমনি লক্ষ পাওয়াও থাকে। আমরা কষ্ট, অবহেলা, বা ব্যর্থতায় না পাওয়াগুলো ভেবে ভেবে বুক ব্যথা করে ফেলি, নিজেকে অযোগ্য মনে করি–আসলে কি তাই? একটি-দুটি ব্যর্থতাই কি পুরো আমি? কোন অর্জনই কি নেই? জীবনে চলার পথে আর কেউই কি মুগ্ধ চোখে তাকায়নি কখনও?
আমার দ্বারা কখনও কি কেউ উপকৃত হয়নি?
হাজার ক্ষেত্র আছে যেখানে মানুষ ছাপ রেখে যায়, বিলিয়ে দেয় নিজেকে, নিজের সময়কে–তার গুরুত্বও কি কম?
নিজেকে দেখতে হয় নিজের চোখ দিয়ে, নিজের অবস্হানে দাঁড়িয়ে– তখনই পুরো নিজেকে দেখা যায়। বাইরে থেকে দেখে বাইরের কেউ কি আর পুরো মানুষটিকে চিনতে পারে?
এক সমাজে যেটা অশোভন, অন্যায়, লজ্জার অন্য সমাজে সেটিই হয়ত সম্মানের। আজ যেই দায় টানা যাচ্ছে না কাল হয়ত সেটিই স্বাভাবিক একটি বিষয় হয়ে উঠবে– সমাজ পরিবর্তনশীল।
মানুষ তার চিন্তার কাছেই বাঁধা পড়ে। সমাজের ঢুকিয়ে দেয়া ধ্যানধারণাই পদে পদে তাকে ঘায়েল করে প্রতিকূল পরিবেশে। বাঁচতে হলে ঐ সীমাবদ্ধ চিন্তা থেকেই মানুষকে বেরিয়ে আসতে হয়। নিজের কাছ থেকেই নিজেকে মুক্ত করতে হয়, স্বাধীন হতে হয়। আর তখনই সে আত্মবিশ্বাস এবং জীবনের আনন্দ ফিরে পায়।
নিজের অধিকার কেউ কাউকে এসে দিয়ে যায় না, নিজেকেই বুঝে নিতে হয়।
খুব ভালো একটা টপিকস নিয়ে লিখেছেন। আমাদের সমাজের বাস্তব চিত্র নিয়ে আলোচনা করেছেন। আসলে আমাদের এই সেকেলে মনমানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসা উচিৎ। শুধু বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে বিবাহিত ব্যাচেলর জীবন কাটানো উচিৎ নয়।
I see some women who take divorce with children. Their mental condition is so weak. They feel like they are done with their lives. They need strong inspiration. Woman can leave without a man, they need to believe it.
অসাধারন লিখা .. এই লিখার পরিপ্রেক্ষিতে আমি যে বিষয়ে দুটো কথা বলতে চাই সেটা হলো
অনেক পরিবার ডিভোর্স এর পর বাচ্চা ওয়ালা নারীদের তাদের বাচ্চাদের দিকে তাকিয়ে জীবন কাটাতে বলে.. কিন্তু এটা বুঝতে চায়না যে একজন জীবন সংগী শুধু বিছানায় সিমাবদ্ধ নয়. এক একটা সম্পর্কের মানে ভিন্ন, ভুমিকা ভিন্ন. যে সন্তানের দিকে তাকিয়ে জীবন কাটিয়ে দেয়া হয় সেই সন্তানরা তাদের ব্যস্ত জীবনে ইচ্ছা থাকা সত্যেও মাকে সময় দিতে পারেনা. বড় জোর তাদের ডাক্তার ঔষুধ অথবা বৃদ্ধাশ্রম কপালে জোটে. অন্তত সেই জীবনে পাশে একান্ত আপন জন হিসাবে থাকতে পারে ভাললাগা বা ভালোবাসার কোনো মানুষ সেটা থাকা তো আমাদের ধর্মে নিষেধ নেই??? ধর্ম শব্দটা এ জন্য উল্লেখ্য যে আমাদের সমাজে কুকাজ সমাধৃত হলেও কেউ দ্বিতীয়বার কাউকে পছন্দ করে সংসার করার অধীকার খাটালে তখন তাকে বাচ্চা দিয়ে এভাবেই ঘায়েল করা হয় যে, কতো বড় পুরুষ পাগল বিয়ে পাগল… বাচ্চা আছে বিয়ের কি দরকার…
আসলে দরকারটা যার সেই বুঝে সব কিছু থাকার মাঝেও অপূর্নতা কিসে.. সেটা পুরুষ বা মহিলা সবার বেলায়ই.