সাদিয়া নাসরিন: আকতার জাহান জলি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক। ছিলেন, গত দু’দিন আগেও। আজ নেই। চলে গেছেন কোন অস্তদুর পারাবারে। কী জানি, কী আছে ওপারে ! জীবনের বিনিময়ে কী পাওয়া যায় ওই নিঃসীম শূন্যতায়? কোনদিন জানা হবে না আমাদের কী পেয়েছেন জলি এইসব পাওয়া ছেড়ে গিয়ে!
“এই ঘুম চেয়েছিলে বুঝি !
রক্ত ফেনামাখা মুখে মড়কের ইঁদুরের মত ঘাড় গুঁজি
আঁধার ঘুজির বুকে ঘুমায় এবার ;
কোনদিন জাগিবে না আর ।
শোনা গেল লাশকাটা ঘরে
নিয়ে গেছে তারে;
যখন গিয়েছে ডুবে পঞ্চমীর চাঁদ
মরিবার হল তার সাধ…
‘কোনদিন জাগিবে না আর
জানিবার গাঢ় বেদনার
অবিরাম অবিরাম ভার
সহিবে না আর –’
আমাদের চোখে শুধু ভেসে থাকবে প্রবল ব্যক্তিত্বের সাথে খাপ না খাওয়া এক জোড়া বিষন্ন চোখ। এক জীবন হতাশা। এক জোড়া বিষন্ন চোখ ছাপিয়ে গেছে একটা জীবন। যে জীবন জাগবে না আর, বইবে না কোন বেদনার ভার। যে জীবন একলা ছিল, যে জীবন একলা বেঁচে ছিল। প্রিয়জন ছিল না পাশে ঘুমিয়ে, শিশুটিও ছিল না। এমন তো কতজনেরই থাকে না! আবার কতজনেরই তো পাশে সবাই থেকেও কেউ থাকে না !! কত মানুষই কিছু না থেকেও শুধু বাঁচবে বলেই জীবন ভালোবাসে। অথবা জীবন ভালোবাসে বলেই বাঁচতে চায়।
তোমার কী এমন হয়নি কখনোই জলি? একটা জীবন, একটা মানব জীবন কিভাবে এমন তুচ্ছ করলে, বলো? আমি জানতে চাইবোনা, কেন তুমি তোমার ছেলেটার কথা ভাবলেনা? আমি জানি, পরিস্থিতির চাপে যে মানুষ নিজের জীবনের লোভ ত্যাগ করতে পারে, সন্তান সেখানে কোন ছার! তবু বলবো, একটা খরচের জীবনের জন্য এতো আয়োজন কেন করেছিলে তুমি? এতো আয়োজনই করেছিলে যদি, তবে এমন বাজে খরচ কেন করলে সে জীবন?
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়…তবে কী এমন বিপন্ন বিস্ময় রক্তে খেলা করছিলো তোমার? কী খেলা তোমাকে এমন ক্লান্ত করেছিল যে ক্লান্তি থকে মুক্তি পেতে লাশকাটা ঘরে ঘুমিয়ে গেছো তুমি?
মর্গে কী তোমার হৃদয় জুড়লো, বলো? জীবনের এই স্বাদ, এই ভাদ্রের-আশ্বিনের বিকেল, জোনাকির অমল আলো, প্রেম-শিশু-ঘর আর কী ফিরে পাবে ওই মর্গের গুমোট ঘরে তুমি? সব শেষ হয়ে যাবার আগে কেন নিজেকে ভালোবাসলেনা আর একবার? কেনো নিজেকে জড়িয়ে ধরলে না ওই ভীষণ একলা রাতে? কেন নিজের কানে কানে বললে না, “তুমি পারবে”?
যোগাযোগের মানুষ ছিলে তুমি। তবু যোগাযোগেই কী ভীষণ নির্মমভাবে হেরে গেলে, বলো! তুমি বলেছো, শরীর ও মনে ভীষণরকম ক্লান্ত ছিলে। আর পারছিলে না! একজন মানুষ কতোটা পারে তার সীমারেখাটা কেন টেনেছিলে? জানি পারে না, তবু তো পারতে হয়। কেন ভাবলে না, তুমি হেরে গেলে সেই মেয়েরাও হেরে যাবে, যারা নিজেকে ভালোবেসেই স্রোতের উল্টোদিকে সাঁতরে কাটিয়ে দিচ্ছে পুরোটা জীবন? কত খানা-খন্দ ময়লা-গুগলি পার করে বেঁচে থাকে মানুষ একটা মানব জীবন কাটাবে বলে?
কেউ বোঝেনি? আপোষ করতে কষ্ট হচ্ছিলো? ভাংচুর হচ্ছিল নিজের ভেতরে সিরামিকের মতো? সে তো হবেই। জীবনটা তো এরকমই, জলি। কত জলতরংগ জলে ভাসিয়ে দিয়ে এ জীবন টেকাতে হয়, সে কি জানতে না তুমি? কত মেয়ে নিজের হাতে তালা খুলে ঘরে ঢুকে ভেঙ্গে টুকরো হতে হতে আবার জীবনের পসরা সাজিয়ে বসে? কতবার ভেঙে পড়তে পড়তে গুড়িয়ে যাই আমরা! আবার সেই ভাঙ্গা টুকরোগুলো কুড়িয়ে এনে জীবন গাঁথি। নিজের সাথে কথা বলি, নিজকে জড়িয়ে ধরি, জড়িয়ে রাখি। নিজের জন্য নিজে বাঁচি। বাঁচতে হয় বৈকি!
জীবনযুদ্ধে হাঁপিয়ে উঠা বন্ধুরা, চলো আবার ভাবি। খরচের হিসাব বন্ধ করে রেখে চলো আগামীর পাতার ভাঁজ খুলি। নিজেকে এপ্রিশিয়েট করি, এতোদিন পারার জন্য। নিজেকে বাহবা দিই এতদূর হেঁটে আসার জন্য। নিজের সাথে থাকি যত দুঃসময়ই আসুক না কেন। আজ রাতের একলা আধাঁরই তো জীবন নয়, জীবন মানে আগামীর ভোর। রাতের আঁধার দেখে নিজেকেই যদি শেষ করে দিলাম তো কাল সকালের অরূপ আলোর ভোর কে দেখবে? নিজেকে নিঃস্ব ভেবোনা, বন্ধু আমার। তোমার জীবন কি এতোই সস্তার যে কেউ এসে পাশে দাড়ালেই কেবল সে জীবনের দাম থাকে! নিজের জীবনের ভার বইতে পারার গভীর আনন্দ যদি না বুঝতে পারো তবে যে মানব জীবনেরই অপমান!

এমন মানব জনম আর কি হবে!! মৃত্যুতে মিলে না কিছুই, কেবল একটা জীবনের অপচয় ছাড়া। শুয়োপোকা থেকে মাথা বের করা প্রজাপতি জীবন, তাকে আকাশ নিয়ে খেলতে না দিলে তো বড় অবিচার হয়। শীতের জীর্ণতা, রুক্ষতায় সব পাতা হারিয়ে বসন্তের অপেক্ষায় থাকে যে জীবন সে জীবনের অভিজ্ঞতা তো ফেলনা নয়। মরে যাওয়া গাছে নতুন গজানো সবুজ পাতার, রঙ্গিন ফুলের সেই গর্বিত জীবনে তুমি বাঁচবে না? তুমি জানবে না পথের কাঁটায় রক্ত ঝরিয়ে আসা জীবন কত মধুময়?
দুঃখ থেকে পালিয়ে বেঁচে জীবনের আনন্দ পাওয়া যায় না বন্ধু। দুঃখকে স্বীকার করো, দুঃখকে ধরা দাও। দুঃখকে জয় করো। আপনা মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়। নিজের ভেতরের আগুনটা জ্বালিয়ে রাখো। নিজের শক্তিকে ভরসা করো। একলা রাতের অন্ধকারে তুমি হও পথের আলো। জানি এ কাজ দুরুহ। এই দুরুহ কাজেই নিজেকে পরিচিত করো তুমি। সহজ কাজ সবাই করতে পারে, কঠিনকে না হয় তুমিই গ্রহন করো।
কান পেতে শোন ভবিষ্যতে জীবনের ডাক। এই ডাক উপেক্ষা করোনা। জীবনে ফিরো বন্ধু, জীবনেই থাকো। জীবনে রাঙ্গো, জীবনেই বাঁচো।
“দুঃখ যদি না পাবি তো দুঃখটা তোর ঘুচবে কবে
বিষকে বিষের দাহ দিয়ে, দহন করে মারতে হবে
ফিরিয়ে তারে পালাস নারে, ধরা দিতে হোস না কাতর
দীর্ঘ পথে ছুটে ছুটে, দীর্ঘ করিস দুঃখটা তোর
মরতে মরতে মরণটারে শেষ করে দে একেবেরে
তারপরে সে জীবন এসে আপন আসন আপনি লবে”।
মৃত্যুতে মিলে না কিছুই, কেবল একটা জীবনের অপচয় ছাড়া।