কামরুন নাহার (রুমা): বাপে তাড়ানো মায়ে খেদানো ছেলেমেয়েদের সাথে সবাই বিমাতাসুলভ আচরণ করে –এটা একটা রেওয়াজের মতো এই দেশে। তাই কলসিন্দুরের মেয়েদের সাথে যেটা হয়েছে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা আমি একটুও অবাক হইনি। কারণ অভিভাবকহীন যে কেউ জনগণের সম্পদ যার যেমন ইচ্ছে আচরণ করবে, যেভাবে ইচ্ছে ব্যবহার করবে তাতে কার কী! যে পুরুষরা বা পুরুষটি এই মেয়েগুলোর সাথে ‘’পুরুষসুলভ’ আচরণ করেছে তাদের আমি একেবারেই দোষ দেখি না।
মেয়েকেগুলোকে এতো বড় অর্জনের পরও যারা এত সম্মান (!) দিয়ে বিদায় জানালো আমার আপত্তি তাদের মানসিক দৈন্য নিয়ে। মেয়েদের খেলাধুলার জন্যও বাজেট যে একেবারে কম দেয়া হয় তা নয়। যা দেয় তাতে তদেরকে আলাদা বাস দিয়ে, আনুষঙ্গিক খরচ দিয়ে খুব ভালভাবে কলসিন্দুরে পাঠানো যেতো। বরাদ্দ ছিল নিশ্চয়; গেলো কই সেই বরাদ্দ! এসি বাসে বমি হয়, নন এসি মিনিবাসবাস বা মাইক্রোবাস নেই বুঝি দেশে – নয় জন মেয়ের জন্য আলাদাভাবে সেটার ব্যবস্থা করা যায়নি! আমি সাড়ে সাত বছর ক্রীড়া প্রতিবেদক ছিলাম। খুব কাছ থেকে অনেক অনিয়ম আর দুর্নীতি দেখে এসেছি। ক্রীড়া সাংবাদিক হবার সুবাদে ২০০৭ সালে ‘অ্যাকশনএইড’ থেকে পাওয়া এক ফেলোশিপের আন্ডারে “State of Women Sports in Bangladesh” শিরোনামে আমি একটি গবেষণা করেছিলাম যেখানে মোটা দাগে যে চিত্রটা উঠে এসেছিলো তা নিম্নরুপ :
১। মেয়েরা যারা খেলছে্ন তারা অধিকাংশই মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং দরিদ্র পরিবার থেকে উঠে আসা এবং খেলাধুলায় আসতে তাদেরকে ধর্মীয় ও সামাজিক নানান নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হয়েছে।
২। খেলোয়াড়দের অধিকাংশই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন
৩। মেয়েদের খেলাধুলায় বাজেট অপেক্ষাকৃত কম; যাও পাওয়া যায় তার সবটুকু ব্যয় হয় না , অন্যান্য খাতে বা নানান ভাগ বাটোয়ারায় শেষ হয়ে যায়।
৪। পৃষ্ঠপোষকতা এবং আর্থিক সহযোগিতার অভাবে জেলা পর্যায় থেকে মেয়েরা জাতীয় পর্যায়ে আসতে পারেন না
৫। মেয়েদের জন্য খেলার মাঠ বরাদ্দ পাওয়া যায় না, যা ও দুই একটা (সুলতানা কামাল ক্রীড়া কমপ্লেক্স) আছে তাও সারা বছর কোন না কোন অনুষ্ঠানের উছিলায় প্যান্ডেলের নিচে চাপা পড়ে থাকে এবং পরবর্তীতে সেই মাঠ খেলার উপযোগী করতে সময় অপচয় হয় এবং তা ঠিক করতে যে অর্থের প্রয়োজন হয় তা পেতেও নানান ঝামেলা হয়।
৬। অধিকাংশ ক্রীড়া সাংবাদিকরাই চান না তাদের সন্তান বিশেষ করে মেয়েরা খেলাধুলায় আসুক।
৭। নারী খেলোয়াড়রা নানান ধরনের বাজে এবং বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হন –কলসিন্দুরের মেয়েদের সাথে আজ ২০১৬ তে যা হোল আরকি। যৌন হয়রানির ঘটনাও আছে কিন্তু সেগুলো চাপা পড়ে থাকে।
৮। সারা বাংলাদেশ থেকে নারী খেলোয়াড় বের করে আনার জন্য কোন প্রোগ্রাম নেই – পুরুষদের ভুরিভুরি আছে ।
৯। অপেক্ষাকৃত বিত্তবান পরিবারের মেয়েরা খেলাধুলায় নাই বললেই চলে। যারা আছে তারাও টেনিস বা ক্রিকেটের বৃত্তে বন্দী।
১০। সবচেয়ে যেটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা হোল নারী ক্রীড়াবিদদের জন্য স্পন্সর পাওয়া যায় না ।
১১। পত্রপত্রিকাতে নারী খেলোয়াড়দের যতটা উত্তেজক আর আকর্ষণীয় ছবি ছাপা হয় চার কলামে, ততটা তাদের সাফল্যের সংবাদ ছাপা হয় না।
উঠে এসেছিল এমনই আরও অনেক বিষয়। কিন্তু সদ্য সমাপ্ত এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাই পর্বের কথা যদি আমরা একবার ভাবি পুরুষ ফুটবলের সাথে তুলনা করে তাহলে বলতে হয় ছেলেদের পেছনে যে ব্যয়, তাদের প্রতি যে যত্ন তাতে তারা যা দিয়েছেন তার চেয়ে অনেক বেশি কি দেয়নি এই কম যত্ন পাওয়া বাচ্চা মেয়েগুলো! তারপরও বাফুফের কী অবহেলা এই মেয়েগুলোর প্রতি।
এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের বাছাই পর্বে বাংলার দামাল মেয়েরা ইরান, সিঙ্গাপুর, কিরগিজস্তান ও চাইনিজ তাইপেকে বড় ব্যবধানে হারিয়ে অাগামী বছর অনুষ্ঠেয় এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ ফুটবলের চূড়ান্ত পর্ব নিশ্চিত করেছে। টানা পাঁচ ম্যাচের জয়ে ১৫ পয়েন্ট নিয়ে অপরাজিত থেকে বাছাই পর্ব শেষ করে তারা। আমরা যদি এই বছরের সাউথ এশিয়ান গেমসের কথাই ধরি তাহলেও কি একজন মাবিয়া বা
মাহফুজা যথেষ্ট নয় মেয়েদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য! ২৩টি ডিসিপ্লিনের মধ্যে অন্যতম ভারোত্তোলনে স্বর্ণ যেতেন মাবিয়া। নারীদের ৬৩ কেজি ওজন শ্রেণিতে মোট ১৪৯ কেজি তুলে স্বর্ণ জেতেন মাবিয়া। আর মাহফুজা আক্তার শীলার হাত ধরে এসএ গেমসে দু’টি স্বর্ণ আসে বাংলাদেশে। ৫০ মিটার ব্রেস্ট স্ট্রোকে স্বর্ণ জেতেন মাহফুজা। ৩৪.৮৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে বাংলাদেশের নারী এ সাঁতারু নিজের দ্বিতীয় স্বর্ণ জেতেন। এরপর আরও একটি স্বর্ণ জেতেন যশোরের নোয়াপাড়ার মাহফুজা। ভারোত্তোলক মাবিয়াকে কোচের পরামর্শে অনেক প্রোটিনসমৃদ্ধ খাবার খেতে হতো, কিন্তু মুদি দোকানি বাবার পক্ষে সেই খাবার যোগান দেয়া সম্ভব হতো না। এমনকি অর্থের অভাবে পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে গেছে তার।
আর অভাবের তাড়নায় তো মাহফুজার জেতা স্বর্ণপদক বিক্রি পর্যন্ত করতে হয়েছিল তার পরিবারকে। আমি সাড়ে সাত বছর ক্রীড়া সাংবাদিকতা করেছি। এই সময়ে আলদাভাবে নারীদের কোন বড় ইভেন্ট আমি কাভার করার সুযোগ পাইনি, হয়ইনি তো করবো কী! ২০০৭ সালে নারী ক্রীড়ার চিত্রটা যা ছিল ২০১৬তে এসে তা যে খুব পাল্টেছে তা নয়। কারণ এই ২০১৬ এসেও মেয়েরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে, বৈষম্যের শিকার
হচ্ছে। তবে যতটুকু পাল্টেছে ততটুকু ইতিবাচক অবশ্যই। নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, সমাজ নারীবান্ধব হয়েছে, স্পন্সররা উদার হয়েছে খানিকটা যার বদৌলতে মাশরাফিদের পাশাপাশি সালমাদের ও দেখা যায় আজকাল টিভি বিজ্ঞাপনে; তবে তা এই ডিজিটাল সময়ের প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যারা ভাবছেন আমি এখানে পুরুষ ক্রীড়ার নিন্দা করতে বসেছি তারা ভুল ভাবছেন। ক্রীড়া বলতে
সারা বিশ্বে সবার আগে পুরুষ ক্রীড়ার কথাই মাথায় আসে। আমাদের দেশও তার ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু নারী ক্রীড়াবিদের তাদের যোগ্যতা প্রমাণের জন্য, নিজেদের মেলে ধরার জন্য যা যা দরকার তার সবটুকু দিতে হবে। নারীরা সবক্ষেত্রে এগিয়ে গেছে, যাচ্ছে। বড় কোন সাফল্যের পর সাময়িক সময়ের জন্য অনেকেই নারী ক্রীড়াবিদদের পাশে দাঁড়ান, কিন্তু সেটা স্থায়ী হয় না বা
দীর্ঘমেয়াদি হয় না।
কৃষ্ণা, শিউলিদের গড়ে তোলার সময় এখনই – তাদের হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না দারিদ্র্যের করাল গ্রাসে। মেধা থাকলে দারিদ্র্য আর অবহেলাকে জয় করে যে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছানো যায় সেটা মাবিয়া, মাহফুজা, কৃষ্ণা, শিউলিরা ইতিমধ্যে প্রমাণ করে দিয়েছে। শুধু দরকার একটু সহযোগিতা। কারণ যারা পর্যাপ্ত সহযোগিতা ছাড়াই পারে অনেকদূর যেতে তারা সবটুকু সহযোগিতা যদি পায় তাহলে “স্কাই উইল বি দ্য লিমিট ফর দেম “।
তাই নারী ক্রীড়ায় বরাদ্দকৃত বাজেটের যথাযথ ব্যবহার কাম্য। এই টাকা ভাগ বাটোয়ারায় বসে গেলে লোকাল বাসে করেই পুরুষদের নানাবিধ স্পর্শ সয়ে আর বাণী শুনতে শুনতেই মেয়েদের কোন একদিন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি হাতেও ফিরতে হতে পারে।
জ্যেষ্ঠ প্রভাষক, সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগ,
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি