কখনো কি ধন্যবাদ দিয়েছি আপনাদের? হ্যাটস অফ!

শারমিন শামস্: তিনজন নারী জঙ্গি ধরা পড়েছে। একজন পুরুষ জঙ্গি নিহত। খবরে জানলাম, দরজায় ধাক্কা দিলে ভিতর থেকে ‘আসছি’ বলে জঙ্গিরা দরজা খুলে দেয়। কিন্তু হাতে ছিল মরিচের গুড়া আর ধারালো অস্ত্র। দরজা খুলেই পুলিশ সদস্যদের দিকে মরিচের গুড়া ছুঁড়ে এবং ছুরি মেরে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তারা। একই সঙ্গে গ্রেনেডের বিস্ফোরণও ঘটায়। আগত পাঁচ পুলিশ সদস্য, যাদের কেউ কেউ চোখে দেখতে পাচ্ছেন না, চোখ ভালো হবে কীনা এই নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন চিকিৎসক।

policeপুরো ব্যাপারটা অনুধাবন করার চেষ্টা করলাম। সাংবাদিকতার সুবাদে অনেক জায়গায় যেতে হয়েছে। কিন্তু অফিস থেকে সবসময়ই বলা হয়েছে, নিজেকে নিরাপদ রেখে যেন কাজ করি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সেই সুযোগ নাই। আজিমপুর, কিংবা নারায়ণগঞ্জ, কল্যাণপুর, শোলাকিয়া বা গুলশানে যে অসম সাহসী পুলিশ, র‍্যাব, সোয়াত সদস্যরা নিজেদের সমূহ বিপদ জেনেও অভিযানে অংশ নিয়েছেন এবং এখনো নিচ্ছেন, তাদের কর্তব্যপরায়ণতা ও সাহসিকতার জন্য পুরো জাতির পক্ষ থেকে শতবার ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানালেও কম হয়ে যাবে বলা।

গুলশানের হোলি আর্টিজানে ভয়াবহ হামলার পর মনে আছে, বাসায় ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলেও কেঁপে উঠেছি। নিজের সন্তান, বাবা-মা, পরিবার নিয়ে কী অসম্ভব এক মানসিক যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে গিয়েছি। ছোটখাটো গুজব, প্রচারণা যাই শুনতাম, সবাইকে ফোন করে বলতাম, ‘খবরদার কোন শপিং মল বা রেস্তোরায় যেও না’।

কী নিদারুণ অসহায় ছিল সেই দিনগুলো! ঈদ যে ঈদ নয়, যেন একরাশ বিমর্ষতা আর দু:শ্চিন্তা আতঙ্কের নাম নিয়ে এলো। তারপর শোলাকিয়ার ঘটনা। দেখলাম, নীল পাঞ্জাবি পরা একজন পুলিশ অফিসার বারবার এগিয়ে যাচ্ছেন জঙ্গিদের দিকে অস্ত্র হাতে। লড়ছেন। না তারা থেমে যাননি। তারা পিছিয়ে আসেননি। কল্যাণপুর, নারায়ণগঞ্জ, আজিমপুরসহ একের পর এক অপারেশনের খবর পেতে লাগলাম, আর সেই হারিয়ে যাওয়া স্বস্তি, নিরাপত্তাবোধ একটু একটু করে ফিরতে লাগলো।

আজীবন পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপারে আমাদের অভিজ্ঞতা অত্যন্ত খারাপ। ছোটবেলায় আমাদের কখনো শেখানো হয়নি, বিপদে পড়লে পুলিশের কাছে যাবা। বরং বলা হয়েছে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুঁলে একশো ঘা। তো এই অবস্থায় প্রত্যকেরই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে পুলিশ একটি আতঙ্ক, কখনো কখনো ঘৃণারও অপর নাম। এই তো সেদিনই আমার সাবেক সহকর্মীকে পিটিয়ে নির্যাতন করে সমালোচিত হলো পুলিশ বাহিনী। আমিও তুমুল ঘেন্না ঢেলে লিখলাম। তো এই অবস্থায়, পুলিশ যখন আমাকে, আমার পরিবারকে এত বড় একটা বিপন্নতার বোধ থেকে ধীরে টেনে তুললো, আমি তখন তাকে ধন্যবাদ দেব না কেন? আমি তো চাই ধন্যবাদ দিতে।

আমি আজ গর্বিত আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাফল্যে, তাদের সাহসিকতায়, তাদের কর্তব্যবোধে। আমরা তো জানি, অভিজিৎ রায়, নীলয় নীল, রাজীব, দীপনসহ একের পর এক হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আমাদের ক্ষোভ, যন্ত্রণা আর হতাশার পারদটা ঠেলতে ঠেলতে কোথায় গিয়ে ঠেকেছিল। বারবার আমরা প্রতিবাদ জানিয়েছি, অনুরোধ করেছি, দাবি জানিয়েছি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলের প্রতি।

জানি না, কোন অজানা রহস্যময় কারণে তারা গুলশান হামলার আগ পর্যন্ত আমাদের আর্তনাদে কর্ণপাত পর্যন্ত করেননি। বরং নাস্তিকতা আর লেখালেখি নিয়ে নানা উপদেশ দিয়ে গেছেন। কিন্তু তবু বলি, আজ যখন রাষ্ট্র, সরকার ঘুরে দাঁড়িয়েছে, উপলব্ধি করছি, একটি দক্ষ, পেশাদার এবং সর্বোপরি সাহসী, অকুতোভয় ও ত্যাগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আমাদের আছে, যারা ঈদের দীর্ঘ ছুটির এই দিনগুলোতে, পরিবার, আনন্দ, আরাম বিলাস ফেলে এগিয়ে গেছেন এমন সব অভিযানে, যেকোন মুহূর্তে যেখানে লাশ হয়ে ফিরতে পারেন তারা। এবং ঘটছেও। অনেক পুলিশ অফিসারকে হারিয়েছি ইতিমধ্যে। কিন্তু অভিযান থেমে থাকছে না।

swatআমি কৃতজ্ঞ। আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ আপনাদের প্রতি। আমি জানি, এটা আপনাদের পেশাদারিত্ব। এটা আপনাদের কাজ। তবু। বিষন্নতা, আতঙ্ক, হতাশা আর অস্থিরতার যে বিশাল সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়েছে আমাদের, তার থেকে আপনারা মুক্তি দিচ্ছেন আমাদের। আমরা তো এতোদিন এটাই চেয়েছিলাম। আপনাদের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

আমি জানি না, গুলির বা ছুরির আঘাতে কতটা কষ্ট হয়, মরিচের গুড়ায় চোখ অন্ধ হয়ে যাবার পরিস্থিতিতে ক্যামন লাগে! আপনাদের কষ্ট ধারণ করতে পারবো কতটা, জানি না। শুধু বলতে পারি, হ্যাটস অফ!

আমাদের সাহসী ভাই ও বোনেরা, যারা আমাদের জন্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন, আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা। আপনারাই পারেন। সম্পদ, লোকবল, অস্ত্র, প্রশিক্ষণ সবকিছুই সীমিত। বেতন ভাতা- সে তো নামেমাত্র, জানি। জানি অনেক সীমাবদ্ধতা আর কঠিন কঠোর পথ পাড়ি দিতে হয় আপনাদের। তারপরও আপনারাই পারলেন। সামনে আরো বহু কঠিন পথ বাকি। আপনারাই পারবেন অন্ধকার সরিয়ে আলোর দিগন্ত খুলে দিতে। হ্যাটস অফ! হ্যাটস অফ!

 

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.