বাঙালির ভণ্ডামিসমূহ

শান্তা মারিয়া: আমরা ভণ্ড, ভণ্ড, চূড়ান্ত ভণ্ড ব্যক্তিগত জীবনে ভণ্ড, সামাজিক জীবনেও ভণ্ড আমরা সম্পর্কগুলো নিয়েও কেবলি ভণ্ডামি করি সবচেয়ে বেশি ভণ্ডামি করি মৃত্যু নিয়ে একজন আকতার জাহান জলি যখন মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন, তখন আমরা ফেইসবুকে হা হুতাশ করি, কেউ বা তার সমালোচনায় মুখর হই। উপদেশ দিতে থাকি, আত্মহত্যা ক্রাইম, ব্যর্থরাই আত্মহত্যা করে, আত্মহত্যা মানে হেরে যাওয়া, ইত্যাদি ইত্যাদি।

Fruits of Bandit Queens-Nazia Andaleeb Preemaঅথচ তিনি যখন দিনের পর দিন হতাশার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন তখন তার নিকটজনেরা কতোটুকু আঁচ পেয়েছেন জানি না, পেয়ে থাকলেও হয়তো কিছুই করেননি। ‘কিছুই করার নেই’ এমন একটি ভাব নিয়ে এড়িয়ে গেছে, উপরন্তু তাঁর বেঁচে থাকাকে সহজ করার জন্য সত্যিকারভাবে তেমন কোনো উদ্যোগই নেননি।

একজন মিনার মাহমুদ যখন আত্মহত্যা করেন তখন দুঃখে আমাদের প্রাণ একেবারে ফেটে যায়, অথচ তিনি বেঁচে থাকতে যখন চাকরি খোঁজেন আমরা অবলীলায় তার মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে দেই

আমরা রিশার হত্যা নিয়ে কথা বলছি। এর আগে বলেছি মিতুর কথা। কিছুদিন আগে আমরা  তনুর ধর্ষণ ও হত্যার বিচার চেয়ে মুখে ফেনা তুলেছি। অথচ এখন আমরা তাদের কথা ভুলে গেছি। আমাদের দেশে প্রতিদিন কোনো না কোনো মেয়ে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, খুন হচ্ছে|। সে বিষয়েও আমরা নিশ্চুপ।

আমাদের স্ত্রী, স্বামী, মা, বোন,ভাই, বন্ধু যখন জীবনে একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তখন তার জীবনধারণ একটু সহজ করার জন্য আমরা কিছুই করি না আর তিনি যখন আত্মহত্যা করেন কিংবা কাউকে খুন করেন কিংবা এমনিতেই মারা যান তখন তার নামে মিলাদ পড়ানোর জন্য আমাদের ঘুম হারাম হয় কোনো হতাশ মানুষকে আশা দেই না বরং তাকে কিভাবে আরও হতাশায় ঠেলে দেওয়া যায় সেটার আয়োজন করি আমরা জীবিতকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করায় বিশ্বাসী নই, মরণোত্তর পদক প্রদানে আগ্রহী

আমরা সরকারিভাবে ভণ্ড। বেসরকারিভাবেও ভণ্ড। আমাদের রাজকোষ থেকে টাকা চুরি গেলে সমস্যা হয় না। কিন্তু সমস্যা হয় যখন সেই চুরির খবর ফাঁস হয়। তখন আমরা ভীষণ নাখোশ হই। তখন নগরপালকে বলা হয় যেভাবে হোক চোর ধর। আর নগরপাল কোনো এক বজ্রসেনকে ধরে খাড়া করে। তাকে বাঁচাতে আবার প্রাণ দেয় কোনো কিশোর উত্তীয়।

আমাদের বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানগুলো কাজের চেয়ে সেমিনার বেশি করে। দরিদ্র মানুষের উন্নয়নে তারা যত অর্থ ব্যয় করে তারচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করে তারা উন্নয়নের রিপোর্ট তৈরিতে।

আমরা পারিবারিকভাবে ভয়ানক রকম ভণ্ড। উৎসবে অনুষ্ঠানে, আত্মীয় মাহফিলে আমরা সুখি দম্পতির এমন অভিনয় করি যে অস্কারজয়ী লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও বেচারাও আমাদের অভিনয় দেখে লজ্জায় নিজেকে নবিশ ভাববে। তারপর যখন সহ্যের শেষসীমায় পৌঁছে স্বামী-স্ত্রীর কেউ একজন আত্মহত্যা করে তখন পত্রিকায় ছাপা হওয়া কেচ্ছা কাহিনি পড়ে আমরা যারা একটু বাইরের মানুষ তারা আবার গোপন আনন্দ অনুভব করি। তখন আমরা জীবিতরা ভাবি ‘যাক বাবা, ও মরেছে মরুক, আমি কিন্তু এহেন পরিস্থিতি পড়েও মরবো না বরং কথাটা আরও ভালোভাবে চেপে রাখবো’। আমরা কার্পেটের নিচে সব ময়লা চালান করে দিয়ে পরিচ্ছন্ন গৃহের ভাবমূর্তি বজায় রাখি।

আমরা শিশু অধিকার নিয়ে দারুণ সোচ্চার। অথচ নিজের বাড়িতে ‘পিচ্চি’ রাখতে খুবই অভ্যস্ত। গৃহকর্মীর অধিকার নিয়ে সেমিনারে গলাবাজি করে বাসায় ফিরেই তেড়িয়া হয়ে উঠি কিশোরী ‘কাজের মেয়ে’র প্রতি। সে কোন কোন কাজ করেনি তার ফিরিস্তি শুনতে বা বলতে আমাদের কোনো ক্লান্তি নেই। অথচ আমি তার কোন কোন অধিকার হরণ করেছি সেটা ভাবতেও আমি নারাজ। আমাদের স্বামীরা যখন কাজের মেয়ের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টি করে তখন আমরা সেই মেয়েটিকেই বাড়ি থেকে বিদায় করে দেই, অথবা তাকে মারধর করি। অথচ এই আমরাই যখন এধরনের কথা ওঠে তখন ঘৃণায় নাক কুঁচকে সরে আসি। যেন এসব আমাদের ঘরে কখনও্ ঘটে না।

আমরা ধর্মীয় জীবনেও ভণ্ড। আমাদের আরাধনার চেয়ে আড়ম্বর বেশি। ভক্তির চেয়ে ভীতি প্রদর্শন বেশি।পূজার চেয়ে প্রচার বেশি। ফরজের চেয়ে আমরা নফল পালনে অধিক উৎসাহী। শ্রদ্ধার চেয়ে শোরগোল বেশি। আমরা ঘোমটার তলে খ্যামটা নাচা পাবলিক।

বাঙালি যৌনজীবনেও অসৎ। প্রকাশ্যে রুচিশীলতার জিগির তুলি, কোন নারীর, কোন অভিনেত্রীর শরীরের কাপড় কতটুকু সরেছে তা নিয়ে সোরগোল তুলি আর গোপনে ল্যাপটপে পর্নোগ্রাফি দেখে আনন্দ পাই।

আমাদের ডাক্তার, উকিল, সাংবাদিক, শিক্ষক, আমলা, রাজনীতিবিদ, পুলিশ, ছাত্র, সংস্কৃতিকর্মী, কবি, লেখক সবাই ভণ্ড। চিকিৎসার চেয়ে ওষুধের আর অপ্রয়োজনীয় টেস্টের তালিকা প্রণয়নে ব্যস্ত ডাক্তার, বস্তনিষ্ঠার চেয়ে স্টান্টবাজিতে ব্যস্ত সাংবাদিক, শিক্ষার চেয়ে রাজনীতিতে ব্যস্ত শিক্ষক, প্রশাসনের চেয়ে বিদেশভ্রমণে ব্যস্ত আমলা, শিল্পের চেয়ে একলাফে তারকা হতে আগ্রহী শিল্পী, সৃষ্টির চেয়ে চাটুকারিতায় ব্যস্ত সাহিত্যিক আর অপরাধী ধরার চেয়ে ধান্দাবাজিতে ব্যস্ত পুলিশকে ভণ্ড ছাড়া আর কি বলা যায়?

আমরা প্রশংসা করতে শিখিনি চাটুকারিতা শিখেছি, বিনয় শিখিনি তবে আত্মসম্মান বিকিয়ে দিতে শিখেছি।

আমাদের অনুষ্ঠানের চেয়ে বিজ্ঞাপন বেশি। স্কুলের চেয়ে কোচিং সেন্টার বেশি।

আমরা মানবিকতা প্রদর্শন করতে যতটা আগ্রহী, মানবিক হতে তার তিলমাত্রও নই।

Shanta 2
শান্তা মারিয়া

আমরা খুব ভণ্ড ভণ্ডামি আমাদের রগে রগে  মাতৃভাষা দিবস নিয়ে আমাদের উৎসাহের সীমা নাই অথচ এদেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের ভাষার ব্যাপারে আমাদের কোনো মাথা ব্যথাই নেইবিদেশের কোনো ঘটনায় আমরা প্রোফাইল পিকচার পরিবর্তন করি, বিদেশে মানবতার পতনে আমরা মূহ্যমান হয়ে পড়ি, কার আগে কে সমবেদনা প্রকাশ করবো তার হুড়াহুড়ি লেগে যায়। অথচ আমাদের পাহাড়ে যে প্রতিনিয়ত নির্যাতন, হত্যা চলছে তা নিয়ে আমাদের কোনো প্রতিবাদ নেই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির শিশু বা তরুণ খুন হলে, মেয়ে ধর্ষণের শিকার হলে আমরা কোনো প্রতিবাদ জানাই না আমরা অমুক তমুকের সাথে ব্রাদারহুড ফলাই কিন্তু এদেশের চাকমা, গারো, মুরং, হাজং, সাঁওতাল আমার ভাই নয়কারণ তারা গরীব ‘কেরোসিন শিখা বলে মাটির প্রদীপে, ভাই বলে ডাক যদি দেব গলা টিপে হেনকালে গগনেতে উঠিলেন চাঁদা, কেরোসিন শিখা ডাকে এসো মোর দাদা।’

আমাদের একমাত্র ধান্দা কিভাবে ওই গরীব মানুষগুলোর জায়গাজমি দখল করা যায়কেন? তারা কি আমাদের দেশের মানুষ নয়? আমরা কি একই দেশের নাগরিক নই? এত বৈষম্য কেন? উটপাখি বালিতে মুখ গুঁজে রাখে আমরা তার চেয়েও খারাপ পাহাড়ি ও ক্ষুদ্র জাতিস্বত্তার জনগোষ্ঠির সমস্যা ও ক্ষোভের প্রতি চোখ বন্ধ করে রেখে আমরা ভাবি সব কিছু ঠিক আছেগারো ও সংখ্যালঘু নারী ধর্ষণের শিকার হলে, খুনের শিকার হলে তখন কেন সেই সম্প্রদায়ের মানুষকেই সোচ্চার হতে হয়? আমরা কেন তখন লোকদেখানি মিনমিনে স্বরে কথা বলি?

বর্তমানে আমরা চরম ভণ্ডামি করছি সুন্দরবন নিয়ে। আমরা কথায় কথায় বলি বাঘ,হরিণ, ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট আমাদের জাতীয় সম্পদ অথচ সুন্দরবন ধ্বংস হলে আমাদের কিছুই যায় আসে না। আমরা ক’জন আছি যারা সুন্দরবন রক্ষার জন্য প্রতিবাদে রাজপথে নেমেছি? ক’দিন পর আমরা সুন্দরবনের কথাও ভুলে যাবো একথা নিশ্চিত। এবং বন ধ্বংস হলে আহাজারি করে ফেইসবুকে পোস্ট দিব, তারপর সেখানে ক’টা লাইক শেয়ার পড়ে সেটা নিয়ে মনে মনে হিসাব কষবো।

ভণ্ডামি ছাড়া বাঙালি নারী-পুরুষ একটি কাজেই দক্ষ। বউ পেটানো, কাজের মেয়েকে পেটানো আর বউ বা স্বামীকে কথার খোঁচা দেয়া ছাড়া আমাদের অন্যকাজে দক্ষতা বড়ই বিরল।

‘মুক্তবুদ্ধির চর্চা’ কথাটি বলে বলে আমরা তালু শুকিয়ে ফেলেছি অথচ আমরা একমাত্র যেটা বুঝি সেটা হলো স্বার্থবুদ্ধি। চাপাতির কোপ যে খায় খাক, আমি না খেলেই হলো।নিজেরটা আঠারো আনা বুঝলেও পরেরটা এক আনাও বুঝতে চাই না।

বাঙালির স্বার্থবুদ্ধি এতই প্রবল যে আমরা নিন্দাও করি স্বার্থ বুঝে।সরকারি দলের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ার আশায় আমরা নিন্দা করি বিরোধী দলের। আর বিরোধীদলের সঙ্গে খাতির থাকলে আমরা নিন্দা করি সরকারের।মনে আবার আশা থাকে বিরোধীদল ক্ষমতায় গেলে গুড়ের ছিটেফোঁটা আমাদের কপালে জুটবে। আমাদের এখন নিরপেক্ষ নিন্দুক প্রয়োজন। আমাদের এখন স্বার্থবুদ্ধিহীন নিন্দুকের দরকার। যে নিন্দুক কড়াভাষায় সত্য কথাটি বলতে ভয় পাবে না। যে নিন্দুক নিজের স্বার্থ না দেখে জনতার স্বার্থ দেখবে।

আমরা যথেষ্ট চতুর, চালাক, ধান্দাবাজ, ভাড়াটে নিন্দুক দেখেছি।আমরা ঘুরিযে পেচিয়ে নিজের কোলে ঝোল টেনে, ধরি মাছ না ছুঁই মার্কা কথা বলা বুদ্ধিমানদের দেখেছি। এখন সত্যি কথা, সোজা ভাষায়, দ্বিধাহীনভাবে বলার মতো বোকা নিন্দুক দরকার।

 

শেয়ার করুন: