আমার স্কুলটা কখন মাদ্রাসা হয়ে গেল?

বিথী হক: আলস্য ভরে কম্পিউটারের স্ক্রিনে চোখ রেখে ফেইসবুক স্ক্রল করছিলাম। হঠাৎ একটা ছবি দেখে ধড়মড় করে স্ক্রিনের দিকে হেলে পড়লাম। আরে এই ব্যানারে ‘সন্তোষপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়’ লেখা, এটা তো আমার স্কুলের নাম। এক ঝলকে আমার পাঁচ বছরের টুকরো টুকরো অনেক স্মৃতি এক এক করে চোখের সামনে ভেসে উঠলো। এই সেই স্কুল যেখানে আমি অসংখ্য বন্ধু পেয়েছিলাম। তাদের কেউ কেউ হারিয়ে গেছে, আর কেউ কেউ সেই ১৩ বছর আগের মতো এখনো কড়কড়ে নতুন ৫ টাকার নোটের মত হাতের নাগালে রয়ে গেছে। 

Bithy 2
বিথী হক

আমি ছিলাম এসেম্বলি কমান্ডার, স্কুল মাঠের এক মাথা থেকে আরেক মাথায় একসময় আমার কন্ঠের দৌরাত্ম্য ছিল। বন্ধুদের সাথে ব্যবহারিকের ব্যাঙ কাটা, পুরো ক্লাসের সবার জুতো লুকিয়ে পাগলামি করা, গাছের তলায় বসে অংক কষা, হ্যান্ডবল খেলতে গিয়ে প্রতিপক্ষের ছোঁড়া বলে ডিগবাজি খেয়ে কাদার মধ্যে পড়ে নাকাল হওয়া, খেলা দেখতে গিয়ে বিশাল দর্শকের সামনে বেঞ্চ ভেঙ্গে পড়ে গিয়ে নির্লজ্জ হাসিতে ফেটে পড়া; সবকিছু মনে পড়ল। আর মনে পড়ল বাপ্পী স্যারকে, স্যার ছিলেন একাধারে আমাদের সাংস্কৃতিক ও খেলাধূলা বিষয়ক শিক্ষক।

কিন্তু ছবিতে যে স্কুলের ছবি দেয়া আছে সেটা একদমই আমার পরিচিত নয়। স্টিলের দরজার জায়গা দখল করে আছে কাঠের নতুন দরজা, প্লাস্টার না করা নতুন দেয়াল এখন প্রৌঢ়া নারীর মতো চাদর জড়ানো, ইটের দাঁত বের করা হাসিও চোখে পড়লো না। কাঠের রংহীন টেবিলটা এখন আর বাচ্চা বাচ্চা ভাব ধরে নেই, দামি টেবিল-ক্লথ আর তার উপর ফুলদানীতে ফুল-শোভিত কেতাদুরস্ত ইন্টেরিয়র দেখে কেন যেন আনচান করে উঠলো বুকের ভেতরটা। বাপ্পী স্যার এখন চশমাও পরেন। দীর্ঘদেহী দৈত্যের মত শরীরটা এখন শুকিয়ে সমুদ্রের শুঁটকির মত হয়ে গেছেন, বিষন্ন হয়ে গেলাম।
কখনো স্কুলে গেলে আর সেটাকে নিজের স্কুল বলে মনে হবে না ভেবে যখন কষ্টে মুচড়ে যাচ্ছিলাম ঠিক তখনই হঠাৎ চোখে পড়লো বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের বালিকাদের উপর। সারি সারি বেঞ্চে নীল-সাদা রঙের বালিকাদের দেখে হোঁচট খেলাম। একটা বালিকাকও সাদা রঙের ভাঁজ করা ক্রস-ওড়না পরে নেই, বেল্ট নেই; তার বদলে রয়েছে থানের বড় সাদা ওড়না কিংবা হিজাব।

বিশ্বাস করুন, একবিন্দুও বাড়িয়ে বলছি না, সত্যিই একটা মেয়েরও গায়ে স্কুল ড্রেস নেই। তারা যে পোশাক পরে আছে সেটা আমাদের সময় মাদ্রাসার মেয়েরা পরতো। তারা একটা বড় সাদা ওড়নাকে এমনভাবে পেঁচিয়ে নাক-মুখ ঢেকে রাস্তায় বেরুতো যে মনে হত তাদেরকে কেউ দেখে ফেললে যেন বিরাট পাপ হয়ে যাবে! সে সময়ের সমাজ এখনকার চেয়ে বহুগুন বেশি রক্ষণশীল ছিল। মেয়েদেরকে স্কুলে পাঠানের আগে বিয়ে দেয়ার হার এখনকার চেয়ে বেশি ছিল। যা ছিল না তা হচ্ছে, ক্লাসের ২/৩টা মেয়ে ছাড়া আর কেউ বড় সাদা থানের ওড়না বা হিজাব পরতো না।

উল্লেখ না করলেই হচ্ছে না, আমার বাবা গ্রামের মোড়ল ও মসজিদের সর্দার হবার সুবাদে আমাকেও আমার বাড়ি থেকে স্কার্ফ পরিয়ে বের করা হতো। খুব সম্ভবত স্কুলে আমিই একমাত্র শিক্ষার্থী ছিলাম যাকে জোর করে স্কার্ফ পরানো হতো। এবং সে সময়ের লাজুক, “না” বলতে না পারা নিতান্ত একটা মেয়ে সবার কথা আর সমালোচনাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে বাড়ি থেকে ৫০ হাত দূরে এসেই ‘আমার যেমন খুশি তেমন থাকবো’ বলে স্কার্ফ ফেলে দিতাম। এখনকার মতো এতো হিজাব আর জোব্বার সংস্কৃতি তো আগে কখনো ছিল না। মায়েদের সময় ছিল বলে শুনেছি অবশ্য!

আজ এতো বছর পরে এসে একটা স্কুলকে মাদ্রাসা হিসেবে দেখতে হচ্ছে, যা আমার কল্পনারও বাইরে ছিল সেটা চোখের সামনে ভেসে আছে। এই মেয়েগুলো কি কখনো জানবে স্কুল-ড্রেস বলে যে ড্রেসকোডটা আছে সেটা একটা সুখস্মৃতি? অনেক বড় হবার পর রাস্তা-ঘাটে স্কুলড্রেসে মোড়া ছেলেমেয়েদের দেখলে  আমার মত কারো বুক টনটন করবে? কখনো বুঝবে, ক্রস বেল্ট আর তলোয়ারের মত ভাঁজ করা চওড়া ওড়না একটা আত্মবিশ্বাসের প্রতীক ছিল।

একসঙ্গে এতো প্রশ্ন, ভাল-খারাপ প্রতিক্রিয়া, মানসিক নির্ভরতা আর বিষন্নতার দোলাচলে দুলে দুলে উঠছি বারবার। সত্যি এটা আমার স্কুল তো? মেয়েগুলো সবাই আমার স্কুলের তো? হিজাব ছাড়া একটা মেয়েও নেই এটা ঠিক দেখেছি তো? তাদেরকে এমন বানাচ্ছে কে বা কারা? এমন বানানোর পেছনের মোটিভ কি? শুধুই কি পরকালের চিন্তা থেকে নাকি পুরুষের লালসা থেকে বাঁচানোর জন্য বাক্সবন্দী করা? তাহলে কি বাঙালী এবং মুসলমান একইসঙ্গে হওয়া যায় না?

মুসলমান হলেই মাথায় কাপড়ের টুকরো বাঁধতেই হবে? সংস্কৃতির চুল ছেঁড়া মানুষগুলো কি তাহলে সাহিত্য-সংস্কৃতিকে হাদীস-কোরান কেন্দ্রিক করে তুলছে? মুসলমান হলে মাথায় হিজাব ছাড়া বাইরে বের হলে কি আর তারা মুসলমান থাকবে না? আচ্ছা তারা নাচ-গান, অভিনয়, খেলাধূলা করে তো নাকি সেসবও ছেড়ে দিয়েছে? তারা কি তাহলে বাঙালী মুসলমান হবার চেয়ে শুধুমাত্র মুসলমানই হচ্ছে? তাদের কোথাও বাঙালী বলে কোন অস্তিত্ব তৈরি হচ্ছে না?

এসব প্রশ্নের একটারও উত্তর আমার জানা নেই। আমি কারো কোন পোষাকের বিষয়ে আগ্রহী নই, মন্তব্য করা তো দূরের কথা। কারো হিজাব, বোরখা, শাড়ী, বিকিনি কোনটাতেই আমার কিছু এসে যায় না। কিন্তু কোন একটা নিয়ম রাতারাতি বদলে গেলে সেটা ভাবনার বিষয় কিন্তু।

এক্ষণে মনে পড়ল মানুষ ধার্মিক না হয়ে, লোক দেখানো ধার্মিক হয়ে যে জিহাদ ঘোষণা করছে তার পেছনের কারণগুলো কী? এতদিন ধর্ম-জঙ্গী পরিবারের প্রতি যে সহমর্মিতা আর আর সহানুভূতি ছিল তা ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে উঠছে। যতই তড়পানো হোক, প্রত্যেকটা ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যতের পেছনে যে অতীতটা পড়ে থাকে তার দায় পিতা-মাতারই। তাদের সন্তানকে এমন একটা বেড়ার ভেতর আটকাতে থাকলে সে বেড়ার বাইরের সকলকেই দাবড়ানি দেবে, সেটাই সত্যি।

এখনকার মেয়েরা কি তবে এগোচ্ছে নাকি পেছাচ্ছে? তারা কি কথা বলতে শিখেছে নাকি ভুলে যাচ্ছে? নিজেকে নিজের জন্য তৈরি করছে নাকি অন্যের হাতে সঁপে দিচ্ছে? আদৌ কি সময় জিনিসটা মহাকালের গর্ভে হারিয়ে যায় নাকি মহাকাল টার্মটা শুধুমাত্র একটা গোলকধাঁধাঁ, এখানে কিছু হারায় না। মানুষ যেখান থেকে শুরু করে, বারবার সেখানে ফিরে আসে! সময় কি তবে বদলাচ্ছে না আদৌ?

শেয়ার করুন:

shotty kotha blte college uthar pr thekei dekhe aschi meye der mddhe hijab porar probonota bereche. shudhu tai noy, hotath krei meye der mddhe ei dhormo viruta (chul dekhano gunah, shb chul shapp hoe dojokhe kamrabe etc) kotha gula beshi dekha dcche….. kauk jiggesh krle ora ble oder baba ma o nki oder k besh bahbah decche… kintu mr 90% meyer hijab dharmikota noy kmn jani fashion hshbe gorhon krche ble mne hcche…….. trend ja k english a ble….. khub khrp lage jokhn hotath kre oder mddhe erkm akash patal poriborton dekhi….. kno jani uudar hoa thke khub beshi islamic mon mind hoe jacche manush gulo.