‘প্রেমের প্রস্তাব’ ও পুরুষতন্ত্রের দখলদারী

শান্তা মারিয়া: একটি মেয়ের শরীরটাকে শুধু প্রয়োজন। ভালোবেসে তার মন জয় করার কোনো প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন নেই তার প্রতি নিজের ভালোবাসা প্রকাশের জন্য কোনো আত্মত্যাগের। ‘আমি তোর শরীর চাই’ সেটাই তো যথেষ্ট। তুই স্বেচ্ছায় রাজি হলে ভালো। না হলে তোকে ধর্ষণ করা হবে। আর সেটাও সম্ভব না হলে তোকে খুন করা হবে। খুন করা হবে কারণ যে জিনিসটি আমি দখল করতে পারিনি সেটা অন্য কাউকেও দখল করতে দিব না’।

Shanta 2
শান্তা মারিয়া

এখানে প্রেম কোথায়? এই সব দখলদারিত্ব ও যৌনঅপরাধকে ‘প্রেমের প্রস্তাব’ ‘প্রেম প্রত্যাখ্যান’ ইত্যাদি বিশেষণে বিশেষায়িত করার কোনো মানে হয়? এগুলো মারাত্মক ও কঠোর শাস্তিÍযোগ্য অপরাধ।

পুরুষতন্ত্র বরাবরই নারীর মানবিক সত্তাকে অস্বীকার করে। একজন পুরুষ যখন কোনো নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয়, তখন মনে করে তার আকৃষ্ট হওয়ার বিষয়টিই প্রধান। অপরপক্ষের কোনো কিছু বলার নেই। আর থাকলেও তা মৌনং সম্মতি লক্ষণম।

যে পুরুষের অর্থ, বিত্ত, শিক্ষাগত যোগ্যতা আছে, আছে সমাজের উচ্চস্তরে শক্ত অবস্থান সে এগুলোর জোরে নারীকে কিনে নিতে চায়। এগুলোর বদৌলতে অনেক ক্ষেত্রেই সে নারীকে করায়ত্ত করে ফেলে। যে পুরুষের এসব কিছুই নেই, সে কী করবে? সে তখন নিজের লৈঙ্গিক পরিচয় বা পুরুষ হয়ে জন্ম নেবার বিষয়টিকেই বড় করে দেখে। সে মনে করে সে যে পুরুষ হয়ে জন্ম নিয়েছে সেই যোগ্যতাতেই সে যেকোনো নারীকে দখল করার অধিকার রাখে।

এ প্রসঙ্গে একটি সত্যি ঘটনা বলি। আমার পরিচিত এক ব্যক্তি নব্বই দশকে প্রিয়াংকা গান্ধীর প্রেমে পড়েছিলেন। সেই ব্যক্তি তখন বাংলাদেশের একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে খুব কম বেতনে চাকরি করতেন। শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং চেহারা সুরত গড়পরতার চেয়েও অনেক নিচে। তো সেই ব্যক্তি কিছু টাকা-পয়সা যোগাড় করে ভারত গেলেন। এবং প্রিয়াংকার বাসভবনের সামনের ফুটপাথে আস্তানা গাড়লেন। পরে পুলিশের সহায়তায় তাকে ওখান থেকে হটানো হয়। এবং কোনোরকম ঢাকঢোল না পিটিয়ে ভারতীয় পুলিশ তার বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা করে। না সে লোকটি প্রিয়াংকার কোনো ক্ষতি করতে পারেনি, কারণ সে সামর্থ্য তার ছিল না। যদি থাকতো হয়তো সে তা করার চেষ্টা করতো। কিন্তু লোকটি একবারও চিন্তা করেনি প্রিয়াংকার মতো মেয়ের পাশে সে কী ভয়ংকর বেমানান! এবং প্রিয়াংকা তাকে চেনেনও না, বন্ধুত্ব বা অন্য কিছু তো আরও অসম্ভব।

বাংলাদেশে এমন মানসিকতার বখাটেদের সংখ্যা অগণিত। তারা নিজেরা হয়তো বেকার এবং কোনো রকম শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। কিন্তু তারা অনায়াসে স্কুল বা কলেজ পড়ুয়া একটি মেয়েকে উত্যক্ত করছে। এই উত্যক্ত করাকে আবার ‘প্রেমের প্রস্তাব’ নামে অভিহিত করা হচ্ছে। প্রেম বা বন্ধুত্ব কোনোটাই কি প্রস্তাব পাশ করে হয়? এটা তো পারস্পরিক পছন্দের ভিত্তিতে নিজে থেকেই হয়ে যায়।

আর এই সব বখাটেরা ‘প্রেমের প্রস্তাব’ এর নামে যেটা করে তাহলো যৌন হয়রানি যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এই বখাটেরা মনে করে করে একটি মেয়ে যত যোগ্যতাসম্পন্নই হোক না কেন সে দুর্বলতর অবস্থানে রয়েছে তার নারীত্বের কারণে। আর সে নিজে যেহেতু পুরুষ তাই মেয়েটির সমান বা কাছাকাছি যোগ্যতা না থাকলেও, এমনকি কোনোরকম যোগ্যতা না থাকলেও সে ওই মেয়েটির শরীর দখল করার অধিকার রাখে। কারণ সে একজন পুরুষ।

এই তথাকথিত ‘প্রেমের প্রস্তাব’ মেয়েটি গ্রহণ করবে না সে তো বলাই বাহুল্য। আর গ্রহণ না করলেই তখন সেই কথিত প্রেমিক হিংস্র হয়ে উঠবে। সে তখন মেয়েটিকে ধর্ষণ বা হত্যা করতে উদ্যত হবে। কারণ মেয়েটির সাহস তো বড় কম নয়। একজন নারী হয়ে সে মহাশক্তিশালী পুরুষের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়ানোর দুঃসাহস দেখিয়েছে তাকে এবং তার ভয়ানক ‘প্রেম’কে সে গ্রহণ করতে চায়নি। এই বেয়াদবির শাস্তিÍ হিসেবে তো তার মৃত্যুদণ্ডই প্রাপ্য।  চর দখলের মতো নারীকে দখল করার এবং তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাওয়ার এই মানসিকতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বাইপ্রোডাক্ট।

পত্রিকায় যখন এই ধরনের অপরাধের বিষয়ে লেখা হয় ‘প্রেমে প্রত্যাখ্যাত’ হয়ে কিংবা ‘প্রত্যাখ্যাত প্রেমিকের কাণ্ড’ ইত্যাদি তখন প্রেম ও প্রেমিকের মতো একটি মানবিক বিষয়কে অপমান করা হয়।

প্রেমিক তো কাউকে আঘাত করে না। প্রেমিক কখনও পারবে না তার প্রেমিকাকে আঘাত করতে বা তাকে কোনোভাবে অপমানিত করতে। বরং সে সর্বদা নিজের স্বার্থত্যাগ করবে বা নিজেকেই আঘাত করবে। আর যে মানসিকতা অন্যকে আঘাত করতে, হত্যা করতে চালিত করে সেটা দখলদারী মানসিকতা, লালসা কিংবা অন্য আর যা কিছু হোক, প্রেম নয় কিছুতেই।

 

শেয়ার করুন: