‘এই মেয়েগুলোই একদিন লাথি মেরে উড়িয়ে দেবে সব’

ইমতিয়াজ মাহমুদ: আমাদের সময় মেয়েরা ফুটবল খেলত না। আমি বড় হয়েছি গ্রামে-পাহাড়ে -মফস্বলে। আমাদের শৈশবে-কৈশোরে বড় শহরের বাইরে যে মেয়েটি খেলাধুলা করতো বা গানবাজনা করতো তাকে পদে পদে সংগ্রাম করতে হতো। লড়তে হতো তার পরিবারের সাথে, তার পাড়া-পড়শি সমাজের সকলের সাথে। মেয়ে এথলেটদের সেই সংগ্রাম তো আমাদের সময় আমরা নিজেরাই দেখেছি। 

taslima-football
তাসলিমা

ব্যতিক্রম কিছু যে ছিল না তা নয়। পাহাড়ের মেয়েরা এই ব্যাপারে একটু অগ্রসর ছিল- কেননা আদিবাসীদের মধ্যে নারীদেরকে খানিকটা মর্যাদা সবসময়ই দেওয়া হতো। এই যে আমার শৈশব কৈশোরের কথা বলছি, সেই অবস্থার কি একটুও উন্নতি হয়েছে? হয় নাই তো। আমাদের মেয়েদেরকে আমরা আগে যে দৃষ্টিতে দেখতাম এখন তো মনে হয় তার চেয়ে আরেকটু নিচু নজরে দেখি।

এই যে কিশোরী ফুটবলার মেয়েগুলির অবস্থা দেখেন। ওরা তো প্রায় দুনিয়াটাই জয় করে ফিরেছে, কিন্তু এই হতভাগীগুলি নিজের দেশে নিজের মানুষের কাছ থেকে এখনো একটু সম্মানই জিততে পারলো না। দেশের একটা বড় অংশের মানুষের কাছে ওরা এখনো কেবলই মেয়ে- নারী- পুরুষের ভোগের জন্যে ঈশ্বরের দান। ওদের বিবর্ণ, শুকনো মুখগুলো একবার একটু দেখুন, জগতের-সমাজের চিত্র সেখানে দেখতে পাবেন।

তিনবছর আগের এক শরতে বেড়াতে গিয়েছিলাম বাঘাইছড়িতে। সেখানে আমার বন্ধু কেরল চাকমা হেডম্যান। দুইদিন ছিলাম বাঘাইছরিতে। তৃতীয় দিন মারিশ্যা থেকে লঞ্চে করে ফিরছি রাঙ্গামাটি। কাসালং নদী দিয়ে লঞ্চ চলছে। আমার বন্ধু কেরল কেবল যে হেডম্যান তা নয়, জেলা আওয়ামী লীগেরও সে বড় নেতা। লঞ্চের বেশীরভাগ মানুষই কেরলবাবুকে চেনে, সালাম দেয়। লঞ্চের দোতলার কেবিনে কেরলবাবু দরবার বসিয়েছে। সেখানে লোকজন আসে, চা খাওয়া হয়, আওয়ামী লীগের রাজনীতি হয়, সিগারেট খাওয়া হয়। আমি গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে একবার লঞ্চের সামনে যাই আরেকবার পিছনে যাই আর কাসালং নদীর দুইপারের রূপ দেখি। লঞ্চের মানুষ দেখি।

ঘাটে ঘাটে লোক ওঠে, লোক নামে। লঙ্গদুর কাছাকাছি একটা ঘাট থেকে একদল বাচ্চা মেয়ে হাঁসের বাচ্চার মতো লাইন ধরে লঞ্চে ওঠে। আদিবাসী বাচ্চারা সব- দশ এগারো বারো এইরকম বয়স। ওদের পিছে পিছে লঞ্চে উঠে আসে ওদের শিক্ষক। আরে! এ তো আমাদের রুপম! আমাদের সাথে একসাথে রাঙ্গামাটি কলেজে পড়েছে।

‘ও রুপম, কী খবর, দোস্ত কেমন আছিস?’

Football 1রুপম একটু বেশীই চমকে ওঠে। বিস্ময়ে সে আমাকে চিনতে পারে না। কত বছর পর দেখা! রুপম জানতে চায় আমি কি করি? কোথায় থাকি। এখানে কিভাবে? কেন এসেছি? লঞ্চে করে কোথায় যাই? আমি সুপ্রিম কোর্টে ওকালতি করি শুনে ওর বিশ্বাস হতে চায় না।

‘কিন্তু তুই তো আগের মতোই আছিস, একটুও বদলাসনাই।’ আহারে বন্ধু, বন্ধু তো বন্ধুই থাকে। আমার চুল পেকেছে, দাঁত পরেছে, চামড়া কুঁচকেছে, চোখ কানা হয়ে চশমা উঠেছে, ভুঁড়ি গজিয়েছে- আর আমার বন্ধু কিনা আমার মধ্যে এখনো তিরিশ বছর আগের কিশোরকে দেখে! ভালোবাসা মানুষের দৃষ্টিকে আসলেই আচ্ছন্ন করে ফেলে।

রুপম এখন স্কুলের টিচার। স্কুলের মেয়েদেরকে নিয়ে রাঙ্গামাটি যাচ্ছে। কেন? না, বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেসা ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলবে ওর মেয়েরা। এইটা আবার কিসের টুর্নামেন্ট? এটা একদম ছোট ছোট মেয়েদের একটি জাতীয় টুর্নামেন্ট। রুপমের মেয়েরা নাকি এই টুর্নামেন্টে অনেকটুকু এগিয়ে গেছে। চূড়ান্ত পর্যায়ে খেলার জন্যে ঢাকায় যাওয়ার আশা করছে ওরা।

আমি মুগ্ধ চোখে মেয়েগুলিকে দেখি। সাধারণ ঘরের আদিবাসী বাচ্চারা- চেহারা জুড়ে আনন্দ আর দৃষ্টি জুড়ে সরলতা। আনন্দে ঝলমলে এক ঝাঁক শিশু ফুটবলার। দেখলেই বুঝা যায় খুব স্বচ্ছল ঘরের বাচ্চা কেউ না। ওদের পরনে সস্তা কাপড়, পায়ে সস্তা জুতা স্যান্ডেল। একজায়গায় কয়েকজনে একসাথে জটলা পাকিয়ে গল্প করছে। কী কথা বলছে ওরা? এতো কিসের হাসি? দুই টাকার এক ঠোঙ্গা বুট কিনেছে একজন, পাঁচজন ঝাঁপিয়ে পড়েছে সেই ঠোঙ্গার উপর।

দুপুরের লঞ্চের উম্মুক্ত ডেকে প্রখর রোদ ওদের আনন্দকে একটুও ম্লান করতে পারে না।

সেই প্রথম আমি জেনেছি আমদের দেশে মেয়েদের ফুটবলে এতো উদ্যোগ আয়োজন চলে। রাঙ্গামাটির একটা স্কুল সেবার জাতীয় পর্যায়ে ফাইনালে খেলেছে। কোন স্কুল তার নাম ভুলে গেছি। রাঙ্গামাটির এক বন্ধু খবর দিয়েছে- আমি কি বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে যেতে চাই? বলে দিয়েছি, হ্যাঁ, যাবো। এরকম অনেক জায়গায় যাবো ভাবি, আর যাওয়া হয়না। সেদিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামেও যাইনি। রাঙ্গামাটির মেয়েরা কি সেদিন ফাইনালটা জিতেছিল?

Football 2এর অনেকদিন পর একদিন ভূমিকম্পে পুরো নেপাল কেঁপে উঠলো। সেসময় আমাদের মেয়েরা অনূর্ধ্ব উনিশ টুর্নামেন্ট খেলার জন্যে নেপালে। আমার বুকটা ধ্বক করে ওঠে। জানি কোন মিল নেই, তবুও মারিশ্যা থেকে রাঙ্গামাটি যাওয়ার লঞ্চে দেখা সেইসব শিশুর চেহারা ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ভয় পেয়ে যাই। কলজে কেঁপে ওঠে।

আমাদের মেয়েরা ঠিক আছে তো?

আমি কাঠমান্ডুতে আমার বন্ধু তেজ বাহাদুর জারগাকে ফোন করি- তুমি কি আমাকে বাংলাদেশ মিশনের ফোন নম্বর বলতে পারো? তেজ বাহাদুর ওর বউ বাচ্চা নিয়ে ঘরের বাইরে খোলা মাঠে দাঁড়িয়ে আছে। এখনই ওর পক্ষে নম্বর জোগাড় করা সম্ভব না। আমি তেজ বাহাদুরের খোঁজ-খবর নিয়ে ফোন রেখে দিই।

নেপালে বাংলাদেশ মিশনের ওয়েবসাইটে যাই, ওদের ফেসবুক পেইজে যাই- সেখানে টেলিফোন নম্বর আছে। ভূমিকম্পের জন্যে জরুরি কয়েকটা ফোন নম্বরও দেওয়া আছে। আমি ওদের একটা নম্বরে ফোন করি।

Imtiaz Bhai
ইমতিয়াজ মাহমুদ

‘ভাই, আমাদের মেয়েরা কেমন আছে?’ আমার কণ্ঠে কি উদ্বেগ বেশী ছিল? দূতাবাসের সেই ভদ্রলোক আমাকে আশ্বস্ত করেন, না, মেয়েরা সবাই ভাল আছে। দূতাবাস থেকে লোক গেছে ওদের হোটেলে। চিন্তার কোন কারণ নাই। তিনি আমার কাছে জানতে চান, ‘আপনি কি বিশেষ কারো খোঁজ করছেন? আপনার নাম কি? আপনার কেউ আছে? আপনার মেয়ে? বোন?’

আমি কোন জবাব দেই না। আমার কে আছে সেই দলে? আমার কে নেই বাংলাদেশের মেয়েদের ফুটবল দলে?

কলসুন্দরের মেয়েদের ফুটবল গাথা আমি জেনেছি গেল বছর মাত্র। নেপালে থাকা আমাদের মেয়েদের দলের খোঁজ নিতে গিয়ে ওদের কথা শুনেছি। বিস্তারিত জেনেছি বছর খানেক আগে। আমি জেনেছি যে কলসুন্দরের মেয়েরা তো বটেই, উত্তরবঙ্গের দিকে আরেকটা স্কুল আছে, সেখানকার মেয়েরা, আর সারা দেশের মেয়ে ফুটবলাররা- আমাদের মেয়েরা ফুটবলটা খেলে খুব প্যাশনেটলি। আপনি লক্ষ্য করলে দেখবেন এরা প্রায় সবাই অপেক্ষাকৃত কম স্বচ্ছল ঘরের মেয়েরা। আপনি কি কখনো ভেবেছেন ওরা এতো প্যাশনেটলি ফুটবলটা কেন খেলে?

আমার ধারণা এই খেলাটার মধ্যে আমাদের মেয়েরা একধরনের একটা মুক্তির পথ দেখে। নারী জন্মের গ্লানি নিজের শরীর নিয়ে গ্লানি এই যে নানারকমভাবে আমরা নারীদের ছোট করে রাখি- তার সাথে আপনি অজ পাড়াগাঁয়ের পশ্চাৎপদ সমাজের নিগড় যোগ করেন। ফুটবল ওদেরকে মর্যাদা দিয়েছে- মেরুদণ্ড সোজা করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সুযোগ করে দিয়েছে। এইভাবে গুছিয়ে হয়তো মেয়েটা ভাবে না, কিন্তু দেখবেন অপমান লজ্জা গ্লানি আর ভয় সবকিছুকে হারিয়ে মর্যাদার সাথে বাঁচার আকাঙ্ক্ষাই ওদেরকে ফুটবল খেলার প্যাশনটা যোগায়।

এই মেয়েরা হারবে না। ওরা খেলায় হারতে পারে, টুর্নামেন্ট হারতে পারে, কিন্তু জীবনের কাছে ওরা আর হারবে না।

আর ঐ যে কারা যেন আমাদের মেয়েদেরকে বাসে উত্যক্ত করেছে। ওরা হচ্ছে আমাদের টিপিক্যাল মুসলিম কনজারভেটিভ পুরুষের দল। এরা হচ্ছে হেরে যাওয়ার দল। যেখানে যতবার মেয়েরা জিতবে ততবার এইসব পুরুষেরা হেরে যায়। এই হারটা ওদের সহ্য হয় না। এই যে বিশেষভাবে সফল মেয়েদেরকে উত্যক্ত করা- এটা হচ্ছে সেইসব পুরুষদের কাজ। এরা মেয়েদের সাফল্যের মাঝে নিজেদের পরাজয় দেখে। মেয়েরা পাবলিক বাসে যাক, নাকি ট্রেনে যাক, নাকি স্পেশাল বাসে যাক- এদের দেখা আপনি পাবেনই।

ভয় পাবেন না। দুশ্চিন্তা করবেন না। এইসব মেল শভিনিস্ট পিগগুলিকে আমাদের মেয়েরা লাথি মেরে উড়িয়ে দিয়েই অগ্রসর হবে। সেদিন দূরে না।

শেয়ার করুন: