মায়ের এই বদলে যাওয়া

মুমিতুল মিম্মা: বন্ধু অয়ন আর রিমা বাসায় এসেছিল আইসক্রিম নিয়ে। মাকে বলল, “আন্টি আপনার জন্যে!” মা কী খুশি! ভাই বাসায় ফিরলেই মা মাথা ঝাঁকিয়ে বললেন, “জানো ওরা না আমার জন্যে আইসক্রিম নিয়ে এসেছিল!”

এই শিশুসুলভ উচ্ছ্বলতা পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই নারীর জন্যে অদ্ভুত ঠেকে। এখন কেউ মায়ের জন্যে আইসক্রিম বা চকলেট নিয়ে আসলেই মা খুশি হয়। শাড়ি গয়নার সাধ এখন আর নেই। এই বয়সে এসে ওগুলো বড় পার্থিব চাওয়া হয়ে যায় বলেই হয়তো মা এখন চকলেট আর আইসক্রিম নিয়েই অপার্থিব আনন্দে আত্মহারা হন।

nimmah
মিম্মা

মায়ের জীবনটা বড় এলোমেলো। ২২ বছরে বিয়ে হয়, ২৪ বছরেই সংসারে টানাপোড়েন, ২৬ বছর বয়সেই তথাকথিত ‘স্বামী পরিত্যক্তা’। জীবনের ভীষণ উচ্ছলতার বয়সটা কেটেছে তার আমাদের নিয়ে বিধবার বেশে। ‘বাবা’ খুব দায়িত্বশীল একটা শব্দ, তাই আমি তাকে পিতা হিসেবেই চিনি। মা কখনও চাননি তার প্রতি আমার বিরূপ ধারণা তৈরি হোক, তাই একা জীবনেও তিনি স্বামীর পরিচয় নিয়েই টেনে গেছেন সংসারের ঘানি। গ্রাজুয়েশন শেষ করার পরেও তিনি ‘গৃহিণী’ হয়ে থাকবার লোভেই কিনা কিছু করেননি।

ভেবেছিলেন যার ‘ঔরসজাত’ তিনি তো তার ঔরশের জের টানবেনই। আহারে মা, বোকা মা আমার! টিপিক্যাল বাঙালি মেয়ে। সমাজের কিছু মানুষের চোখে তিনি ‘দেবী’ কারণ এক স্বামীর ঘর করে গেছেন বলে। আমার চোখে আমার মা বড় সাধারণ। দেবী হবার প্রশ্নই আসে না। কারণ যে মেয়ে লেখাপড়া করেও শুধু গৃহিণী হয়ে থাকেন, আর দায়িত্বজ্ঞানহীন বরের দায়িত্বের পরিচয় পাবার প্রতিক্ষায় থাকেন – তিনি বোকা, ভীষণরকম বোকা।

আমার বয়স যখন ৪ বছর, ভাইয়ের বয়স দেড় – পরকিয়ায় জড়ানো পিতা আবার বিয়ে করে সুখি। দ্বিতীয় বিয়ের পর মাকে পাঠানো তার এক চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, “আপনার জীবনে দ্বিতীয় বসন্ত আসুক!” বক্তব্যের কী নির্মম ভাষা!

পিতা টাকা দিতেন নামে মাত্র। যে কখনও দায়িত্ব নিতে চায় না তাকে জোর করে কী হবে এটা ছিল মায়ের বক্তব্য। তাই মা আইনি জটিলতায় যান নি। আমাকে নিয়ে অনেক টানা হেঁচড়া চলেছিল তখন। পিতা চেয়েছিলেন আমাকে তার কাছে রাখতে, মা দেন নি। মায়ের একা যুদ্ধের শুরুটা সেই থেকেই। আমার এস এস সি ফর্ম ফিলআপের টাকা জমা দেয়ার শেষ দিন পিতাকে ফোন করেছি টাকার জন্যে, তিনি ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। ছোট ভাইয়ের কলেজের টাকা জমা দেবার শেষ দিন তিনি ফোন ধরছিলেন না। আমার বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির টাকা লাগবে, পিতার বক্তব্য, “জোগাড় করে নাও।”

কোত্থেকে কে জানে! কিন্তু আমরা সব যাত্রায় বেঁচে গিয়েছি মায়ের জোরে। মাকে হয়তো তার আত্মীয়রা কেউ কোন অনুষ্ঠানে টাকা দিয়েছেন মা নিজের জন্যে কিছুই না কিনে টাকাটা জমিয়ে রেখেছেন ভবিষ্যতে লাগতে পারে বলে। মনের সুখ, শরীরের সুখ সব বাদ দিয়ে এই আমাদের ভবিষ্যতের জন্যেই নিজের সমস্ত সুখ আল্হাদ বিবর্জিত সন্ন্যাস জীবন বেছে নিয়েছিলেন তিনি!

ছেলেবেলায় মা আমাকে কড়া শাসনে রাখতেন। ভাবতেন যদি ভুল করে বসি। তার এই শাসন মাঝেমধ্যে দমবন্ধ করা লাগতো আমার কাছে। বয়ঃসন্ধিকালীন আমি মাকে কেমন যেন অপছন্দ করতে শুরু করলাম। একটু একটু করে দূরত্ব বাড়তে লাগলো। দূরত্ব কমলো মা যখন জরায়ু অপসারণ অস্ত্রোপচারের জটিলতায় আইসিইউতে।

তদ্দিনে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে পা রেখে ফেলেছি। মা ছাড়া আছেন কে- ভাবতে ভাবতে দিশেহারা অবস্থা। মা সুস্থ হবার পরে কেমন যেন আমূল বদলে গেলেন। মায়ের এই ভার্সনটা কেমন যেন অদ্ভুতুড়ে ঠেকল। এই মা-টা ভীষণ রকম ভালো। এই মা আমার সাথে বই নিয়ে গল্প করেন, ভীষণ রকমের স্বাধীনচেতা, কিছু একটা করার জন্যে উদ্বেল। সংসার টানতে হয় আমাকে, তাই আমিই কর্তা।

মা এখানে খানিকটা নিশ্চিন্ত পাখির মত নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অনেকদিন পরে বেড়াতে গেলেন নানুবাড়ীতে। আমার পরীক্ষা, ছোট ভাইয়ের পরীক্ষা। তাতে কী? একাই বেড়িয়ে আসলেন চড়ুই পাখির দুরন্তপনা নিয়ে। আমার সাথে পাল্লা দিয়ে তিনি এখন নিয়মিত বইও পড়েন। বই নিয়ে তর্কে আমি হেরে যাই তার কাছে।

আমার হারতে ভালো লাগে। মায়ের এই রূপ দেখার জন্যে চাতকের মত অপেক্ষা করতাম বয়ঃসন্ধিতে। সময়টা পেরিয়ে গেছে একাকিত্বে। এখন আর আমার উচ্ছ্বলতার বয়সটা নেই। এখন আমি অবাক হই তার উচ্ছ্বলতা দেখে। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে আমি কেমন যেন বুড়িয়ে গেছি। মেয়ের টিপ পরার বয়স হলে নাকি মাকে টিপ ছাড়তে হয়। আমার মায়ের এখন উচ্ছ্বলতার বয়স, আমার কী আর উচ্ছ্বলতা সাজে?  

একটু একটু করে আমি মায়ে রূপান্তরিত হচ্ছি আর মা আমাতে। বয়স ফেরে চক্রাকারে!

 

 

শেয়ার করুন:

কজন মেয়েই বা পারে মা কে তার উচ্চ্বলতার জায়গাটা ছেড়ে দিতে? খুব সাহসী, খুব অসাধারণ এমন আরো কিছু মেয়ে পৃথিবীতে থাকলে হয়ত মায়েদের সব দুঃখ মুছে যেত….. আমি নিজেও যদি এমন হতে পারতাম!!!!!

Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.