বাফুফে কর্তৃপক্ষের কাছে উপযুক্ত জবাব চাই

সুমন্দভাষিণী: অনূর্ধ্ব-১৬ মেয়েরা কেন লোকাল বাসে করে বাড়ি ফিরে গেল? আবার ধোবাউড়ার কলসিন্দুরের মতোন একটি জায়গায়! কেন? এতোবড় সম্মান আনার পর কি তাদের ভাগ্যে কোনো পরিবহন প্রাপ্তি ছিল না? ফিরতি পথে যাত্রা পথের কষ্ট ছাড়াও তাদের হতে হয়েছে নানারকম হয়রানি-টিপ্পনির শিকার। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন কি তাদের একটি বাসে তুলে দিয়েই দায়িত্ব সেরে নিয়েছে? নাকি গরীবের মেয়ে বলে তাদের মান-সম্মানের কোনো ভয় থাকে না?

girls-footballer-2আমিনুল হক পলাশ নামে একজন ফেসবুকে যথার্থই লিখেছেন, ” বাফুফে চলে এদেশের মানুষের ট্যাক্সের টাকায়। এখন তাদের জিজ্ঞেস করার সময় হইসে যে তারা তাদের নধর শরীর নিয়া ওই সুরম্য বাফুফে ভবনে করে টা কি? একজন লোকও পাওয়া গেল না যে কিনা অনুর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল দলের মেয়েদের তাদের বাড়িতে পৌছে দিবে!! এসি বাসে নাকি মেয়েরা যেতে চায় নাই। এই আষাঢ়ে গল্প মাইনা নিয়াই বাফুফে কর্তাদের কাছে একটা ছোট প্রশ্ন, বিদেশে খেলতে যাবার সময় কোন কম্পানির নন এসি প্লেন দিয়ে তাদের নিয়া যাওয়া হয়?

একজন গার্মেন্টস কর্মীর নূন্যতম মাসিক বেতন ৫৩০০ টাকা। অনুর্ধ্ব-১৬ দলের মেয়েরা তিনমাস ক্যাম্পে ছিলো। ক্যাম্প চলাকালীন মেয়েদের হাতে কোন টাকা দেয়া হয় নাই। মানে খাস বাংলায় বলতে গেলে এই মেয়েরা পেটে ভাতে তিনমাস দেশের জন্য খাটসে। আমার আরেকটা প্রশ্ন হইলো, কোন হিসেবে মেয়েদের হাতে ৫০০০ টাকা কইরা দিয়া বিদায় দেয়া হইলো?

এসব প্রশ্নের উত্তর দেয়ার জন্য কাউরে পাওয়া যাবে না। কেননা এক অদ্ভুদ উটের পিঠে চড়েছে বাফুফে। এই প্রতিষ্ঠানটি যেভাবে চলছে সেটা দেখলেই একটা প্রতিষ্ঠান কিভাবে চলা উচিৎ না সেই ব্যাপারে পরিষ্কার ধারনা পাওয়া যায়”।

কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের কোন জায়গায় এমন বয়সী মেয়েরা একা যাতায়াত করে? ওদের জন্য কি একটা পরিবহনের ব্যবস্থা করা সম্ভব ছিল না? খুব বেশি টাকা খরচ হয়ে যেত? বাফুফে’র কি টাকার টান পড়েছে কোথাও?

তো, টাকার অভাবই যদি ছিল তাহলে বলতো, আমরা সাধারণেরাই টাকা তুলে ওদের যাতায়াতের ব্যবস্থা করতাম। এমনকি এই দরিদ্র পরিবারের মেয়েগুলো জানে, বাড়িতে ওদের জন্য আলাদা কোনো খাবারের ব্যবস্থা নেই, যা ওদের খেলাধুলার জন্য বড্ড বেশি প্রয়োজন। শুনেছি ওরা ফিরতে চায়নি। বাফুফে যদি সেই দায়িত্বটুকু না নিতে পারে, আমাদের কাছে ছেড়ে দিক, আমরা ওদের খাবারের ব্যবস্থা করবো।

girls-footballerবাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন বা বাফুফে’র দুর্নীতি বা অব্যবস্থাপনা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। এই সমস্যা জাতীয় সমস্যা। জাতীয়ভাবেই এর সমাধান না করা হলে আমরা চুনোপুটি হয়ে অল্প জলে ফালাফালিই সার হবে। ওদের মোটা পেট আরও স্ফীতাকার হোক, আপত্তি নেই। শুধুমাত্র মেয়ে বলে আর দরিদ্র পরিবারের বলেই কি ওদের এমনভাবে ছেড়ে দেয়া হলো? ওরা কি দেশের সম্পদ নয়?

অবাক লাগছে ভেবে যে, মাত্র দুদিন আগেও যে মেয়েগুলো একের পর এক জয় দিয়ে পুরো বাংলাদেশকে মাতিয়ে রেখেছিল, সাবাশ সাবাশ ধ্বনিতে ফেসবুক ফেটে পড়েছিল, সেই সাবাশওয়ালাদের কজন খবর রাখে মেয়েগুলোর হাঁড়ির কথা! কী দুর্দশাগ্রস্ত জীবনই না ওদের কাটাতে হয়। সারাদেশকে আশার আলো দিয়ে, হাসিয়ে, আনন্দে ভরিয়ে দিয়ে ওরা আবার ফিরে গেল সেই দারিদ্র্যময় জীবনে।

যমুনা টেলিভিশনের একটি রিপোর্টে দেখলাম, ফিরে যাওয়ার পথটাও ছিল বেদনাদায়ক। শুধুমাত্র মেয়ে বলে বাসভর্তি লোকজনের সামনে ওদের অপমান করা গেছে। যারা অপমান করেছে, ওদের মোক্ষম জবাব দিতে মেয়েগুলো শেখেনি। আর করবেই বা কী, ছোট ছোট মেয়ে, সাথে নেই কোনো অভিভাবক, পথে পথে যাত্রী তুলছে যেই বাস, সেই বাস আর তার ভিতরের যাত্রীদের বিশ্বাসই বা করা যায় কী করে? ফুটবলে লাথি দেয়া শিখলেও ওসব জানোয়ার পুরুষগুলোর অণ্ডকোষ বরাবর লাথিটা মারতে এখনও শেখেনি মেয়েরা। সেটাই শেখাতে হবে।

কথা দিচ্ছি, ওরা আরেকটু বড় হলে ওদের জেন্ডার ট্রেনিং দেয়া হবে, দিতেই হবে। যাতে ওরা কীভাবে তাদের দাবি আদায় করে নিতে হয়, কীভাবে অপমানের জবাব দিতে হয়, সব শিখে নেয়। বাফুফে যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে কথা দিচ্ছি, উইমেন চ্যাপ্টার ওদের বাড়ি বয়ে গিয়ে সেই ট্রেনিং দিয়ে আসবে। মেয়েগুলোকে হারিয়ে যেতে দেয়া যাবে না। 

দেশের সুনাম এনে দেবে মেয়েরা, সম্মান বয়ে আনবে মেয়েরা, আর সেই মেয়েদের সামাজিক অবস্থানের উন্নতি তোমরা ঘটাবে না, বরং প্রতিনিয়ত তাদের সাথে খারাপ আচরণ করবে, তাতো হতে পারে না। সেদিন একজন নারী ফটো জার্নালিস্ট বলছিল আরেকজন স্পোর্টস ওম্যান এর কথা, যে কিনা দেশের জন্য অসামান্য গৌরব অর্জন করে এনেছে, যার জাতীয় সঙ্গীতের সাথে কান্না দেখে আমরাও অঝোর ধারায় কেঁদেছি, সেই মেয়েটির অনুশীলনের জন্য ভাল কোনো জায়গা নেই। যেটুকু আছে, সেখানে টয়লেটের দুর্গন্ধে যাওয়া দু:সাধ্য। কিন্তু মাবিয়া অবিচল তার সিদ্ধান্তে। সে জেনে গেছে, তার সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থা তাকে এর চেয়ে বেশি কিছু দেবে না।

Football 2এই মাবিয়াই যখন সোনা জিতে দেশে ফিরেছিল, তাকে আনতে কেউ এয়ারপোর্টে যায়নি। লজ্জা, কষ্ট রাখার জায়গা নেই আমাদের। শুধুমাত্র ক্রিকেট ক্রিকেট করে একটা জানি কতকিছুই না করে। সেই ক্রিকেটও তো কখনও হাসায়, কখনও কাঁদায়। তাহলে? অন্য যারা দেশের নাম উজ্জ্বল করে দেশের মাটিতে, তখন তাদের কী ন্যূনতম সম্মানটুকু জানানোর প্রয়োজনও কেউ মনে করে না?

একজনের কাছে এই রাগের কথাটা প্রকাশ করাতে সে বললো, “হুম। গরীব তার উপরে মেয়ে, বাসেই তো ফিরবে। ওরা কি সাকিব? ওরা কি মুস্তাফিজ যে প্রধানমন্ত্রী নিজে এয়ারপোর্টে গিয়ে তাদের কোলে বসাবে, আর দুনিয়াদারি লিখে দিবে তাদের নামে”?

আমিনুল ইসলাম নামে এক ফেসবুক বন্ধু লিখেছেন, ১৬ বছরের নিচের বাচ্চা মেয়েগুলো পুরো দেশকে আনন্দে ভাসিয়ে মূল পর্বে খেলার যোগ্যতা অর্জন করলো ফুটবলে; আর আমরা তার পুরষ্কার হিসেবে তাদের বাড়ীতে ফেরার সময় দিয়েছি লক্করঝক্কর মুড়ির টিন মার্কা বাসের টিকেট। শুধু তাই না, রাস্তায় বখাটেরা তাদের সাথে দুর্ব্যবহার করেছে। বাসের ড্রাইভার বাধা দিতে গিয়ে নাকি হেনস্থাও হয়েছে!

শুনলাম এই মেয়েদের অনেকেই নাকি ঈদের ছুটিতে বাড়িতে ফিরতে চাইছিলো না এতো সব ঝামেলার জন্য। তাছাড়া তাদের বাড়িতে খেলোয়াড়ের জন্য যেই রকম খাদ্য থাকা উচিত সেই রকম সুযোগ সুবিধাও নেই!

এখন প্রশ্ন হচ্ছে সুযোগ সুবিধা দেয়ার জন্য আর্থিক সামর্থ্য কি আমাদের আছে কিনা? সেই সামর্থ্য আছে কি নেই, আমার জানা নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি, খেলোয়াড়রা সুযোগ-সুবিধা পাক না পাক, কর্মকর্তারা কিন্তু লোকাল বাসে না, এসি বাস কিংবা সম্ভব হলে বিমানে করে ঘুরে বেড়ায়! তখন কিন্তু সামর্থ্যের অভাব হয় না! এভাবেই আমরা আমাদের প্রতিভা গুলোকে হত্যা করি। সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে কিছু চার পেয়ে প্রাণী বিশেষ, যাদের না আছে কোন প্রতিভা, না আছে কোন যোগ্যতা! অবশ্য একটা যোগ্যতা আছে বৈকি! সেটা হচ্ছে “তৈল বাজি!” সেই প্রতিভা কাজে লাগিয়ে তারা বড় কর্তা হয়ে সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করে। আর যারা প্রকৃত প্রতিভাধর তারা পদে পদে নাজেহাল হয়ে ঝড়ে পড়ে!

শিপ্রা বোস লিখেছেন, আমি স্তম্ভিত। ফুটবল ফেডারেশন, ক্রীড়া বিষয়ক অথরিটি কোথায়? নাকি মেয়েদের টিম বলে তাদের কোনো দায়িত্ব বা উৎসাহ কোনোটাই নেই? সেক্সিজম, জেন্ডার-বেইজড অসমতার অতুলনীয় উদাহরণ। এর জোর প্রতিবাদ হোক, দায়িত্বে অবহেলার জন্য সংস্লিষ্ট কর্মকর্তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক, কৃতি পুরুষ খেলোয়াড়দের তরফ থেকে এর জোর প্রতিবাদ হবে আশা করছি।

আর সব পায়ের তলায় থাকুক, এই মেয়েগুলির জন্য প্রাণ উজাড় করা ভালবাসা। কাছে পেলে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করতাম তোদের। আমরা অনেক লেখালেখি চেঁচামেচি করে যা করতে পারছি না, তোরা লাথি মেরে তা বুঝিয়ে দিয়েছিস, আমরা’ও’ নয়, আমরা’ই’ পারি।

এখন একটি প্রস্তাব, হয় বাফুফে তাদের ব্যর্থতার কথা স্বীকার করবে, ক্রীড়াবিদ মেয়েদের জন্য বরাদ্দ অর্থের হিসাব দেবে, যথোপযুক্ত প্রশিক্ষণ, খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করবে। একান্তই না পারলে তা জনসমক্ষে স্বীকার করবে। আমরা তখন দেখবো কী করা যায়। প্রয়োজনে আমরাই দায়িত্ব নেবো, কথা দিচ্ছি।

শেয়ার করুন:

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন নারী।অনুরোধ রইলো এ ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এবং কলসিন্ধুর গ্রামের কিশোরী ফুটবলারদের সবদিক থেকে সুরক্ষা করতে।নেপালে এ ফুটবলারদের ইর্ষনীয় সাফল্যে কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক এর অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড তাদের গৃহ বৈদ্যুতিকরণ করে।অথচ এরা ফুটবল ফেডারেশন হতে কি ধরণের বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হল তা ভাবতে অবাক হতে হচ্ছে।