ফাহরিয়া ফেরদৌস: এরই মধ্যে অর্গাজম নিয়ে বেশ কয়েকটি লেখা হয়েছে। অনেকের কাছে বিষয়টি নতুন। এ সমস্ত বিষয় নিয়ে কথা বলা মানা, কিন্তু তারপরও এই বিষয়টি নিয়ে এখন কথা বলা দরকার। আইনের সাথে এর সরাসরি কোন সম্পর্ক নেই, তবে আইনজীবিরা সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ার আর মানুষের কর্ম নিয়েই আমাদের কাজ।
আমরা যখন কাজ করি তখন সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়েই কাজ করি; মানুষের কর্মগুলো যদি বিশ্লেষণ করি তবে ঘটনাগুলো ঘটার পেছনের কারণগুলোও বোঝা যায়। পরিবার হলো যেকোনো মানুষের জীবনের প্রথম ইন্সিটিউশান, যেখান থেকে মানুষ শিক্ষা পাওয়া আরম্ভ করে, কিন্তু এখন পরিবারগুলোও আর ইন্সিটিউশান হিসেবে কাজ করছে না।

সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে হাসি মুখে ছবি দেখে ভাববার কোন কারণ নেই যে, বাস্তব জীবনেও এরা খুব সুখী দম্পতি। একজন দম্পতি আসলে সুখী না অসুখী তা কেবল ওই দম্পতিই জানেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি বিবাহ বিচ্ছেদের বিপক্ষে; তবে মারামারি না করে, একই বাড়িতে থেকে দুই রুমে বসবাসের চাইতে, একজন আরেকজনকে অসম্মান করার চেয়ে, আলাদা হয়ে যাওয়া ভালো।
পারিবারিক বিষয়গুলো এলে আমি অনেক প্রশ্ন করি, আলাদা হয়ে যাবার কারণ কি!! অনেকগুলো কারণে সংসার ভেংগে যাচ্ছে;
১। একজনকে আরেকজনের কন্ট্রোল করার মানসিকতার বা ইগো সমস্যার কারণে, ২। পরিবারের বা বাইরের মানুষের প্ররোচণায়, ৩। মানসিক বা মনের মিল না হবার কারণে এবং ৪। শারীরিক সমস্যার কারণে।
প্রথম তিনটি বিষয় মেয়েরা অকপটে স্বীকার করলেও শেষের বিষয়টি প্রথমে স্বীকার করতে দ্বিধা করে। পরে অবশ্য বলতে বাধ্য হয় যে, শারীরিক সমস্যার কারণেই বিবাহ বিচ্ছেদ চায়। অবাক হলেও সত্যি যে শুধুমাত্র মনের বনিবনা না হবার কারণে নয়, শারীরিক বনিবনা না হবার কারণেও এখন ডিভোর্স হয়ে যাচ্ছে। ছেলেরা তার বউয়ের মাধ্যমে তৃপ্ত না হলে যত সহজে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বা আরেকটি বিয়ে করার কথা বলতে পারে, মেয়েরা সেটি পারে না।
সেক্স বিষয়টি মেয়েদের কাছে একটি ট্যাবু। এটি নিয়ে তারা সহজে আলোচনা করে না। মেয়ে বন্ধুরা একসাথে হলে ও এই বিষয়টি নিয়ে কথা বলে না। শারীরিক চাহিদা একটি প্রাকৃতিক বিষয়। একটি বয়সের পর এটি মৌলিক চাহিদার অন্তর্ভুক্ত হয়। তাই মানুষ একে ডিনাই করতে পারে না। আগের দিনে মেয়েরা নিজের শরীর সম্পর্কে বেশি জানতো না, তাদের অনেক সন্তান থাকতো, ছেলেদের ও চাহিদা ছিল ভিন্ন রকম। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নারীর শারীরিক সৌন্দর্য পরিবর্তন হয়েছে।
এখন মিডিয়া ও নিজের প্রতি সচেতন হবার কারণে মেয়েরা অনেক কিছু জানছে আবার তারা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের ফিট রাখছে; কিন্তু সমস্যা হলো, ছেলেদের শারীরিক সৌন্দর্য কোনদিনই সংজ্ঞায়িত হয়নি। আবার মেয়েরা যেহেতু ছেলোদের কোনকিছু বলে না তাই তারা জানে না যে, তাদের মনের সাথে সাথে শারীরিক সৌন্দর্যও মেয়েদের দরকার।
মেয়েরা তার শারীরিক অতৃপ্তির কথা বলতে পারে না কারণ, ছেলেরা নিজেদের পুরুষত্বের প্রতি আঘাত মেনে নিতে পারে না, আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মেয়েটি নিজেই, কারণ তখন স্বামীটি স্ত্রীকে সন্দেহ করতে থাকে, মেয়েটির জীবন আরও কঠিন হয়ে পরে। সন্তান না হলে যত সহজে মেয়েটির উপর আঙুল উঠে, তার চাইতে মানুষ অনেক ভয় পায় ছেলেটিকে ডাক্তারের কাছে যাবার জন্য বলতে, আর ছেলেটি নিজেও নিজের অক্ষমতাকে গ্রহণ করতে এতো ভয় পায় যে সে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে পারেনা।
এখন সেখানে মেয়েটি যদি ছেলেটিকে বলে যে, মেয়েটি শারীরিকভাবে অতৃপ্ত তার দ্বারা তাহলে সেই ছেলে হয়ে উঠে সন্দেহ প্রবন আর ক্ষেত্র ভেদে হিংস্র। একটি ঘটনায় দেখছি ছেলেটি শারীরিকভাবে কম ক্ষমতাসম্পন্ন হবার কারণে সে মেয়েটিকে মেরে চোখ অন্ধের কাছাকাছি নিয়ে গেছে।
আরেকটি ঘটনায় দেখেছি ছেলেটি নিজের অক্ষমতাকে মেনে নিতে পারেনি, তার বাড়িতে সর্ব প্রকার মিডিয়া এমনকি ফোনও ব্যবহার করতে দেয়েনি মেয়েটিকে, আর মেয়েটির মুখশ্রী নষ্ট করে দেবার জন্য নখ দিয়ে আঁচড় দিয়ে দেয় যেন চেহারা নষ্ট হয়ে যায়, আর সে কোন পুরুষকে আকৃষ্ট করতে না পারে।
এখন ছেলেরা নিজেরা বিভিন্ন ধরনের এ্যাডাল্ট মুভি দেখছে, আর্টিকেল পড়ছে সাথে নিজের বউকে ও পড়াচ্ছে। এতে একসময় ঘটনা হিতে বিপরীত হচ্ছে। ছেলেটি যেমন শিখছে, মেয়েটিও শিখছে। এখন মেয়েদের কুড়িতে বুড়ি হয়ে যাবার যুগ শেষ হয়ে গেছে। ছেলেরা মেয়েদের ফিট বডি বা কার্ভ ফিগার চাচ্ছে; মেয়েরা ও তার পুরুষ সঙ্গীটিকে খুশি করার জন্য ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে নিজেদের ফিট রাখছেন।
সেদিক থেকে দেখা যাচ্ছে যে ছেলেরা পিছিয়ে আছে। ছেলেরা নিজের সঙ্গীটিকে আকর্ষণীয় দেখতে চাইছে, কিন্তু নিজেকেও যে তার সঙ্গীর কাছে প্রেজেন্টেবেল রাখতে হবে, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারনে তারা এটা উপলব্ধি করে না। তারা নিজেদের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাগুলোও স্বীকার করতে চায় না। তাদের পৌরুষ নারীকে ছোট করে দেখার প্রবণতা তাদের সেটিকে স্বীকার করতে বাধা দেয়!
পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের জন্য অপনি দূরে সরে যাচ্ছেন আপনার প্রিয় মানুষটির কাছ থেকে, তৈরী হচ্ছে পারিবারিক অশান্তি। যে মেয়টিকে একদিন আপনি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন, সেই মেয়েটির সাথে একই ছাদের নিচে বসবাসের পরেও মনের দিক থেকে থাকছেন অনেক দূরে।
ছেলেদের শারীরিক যে সমস্যাটি আছে, সেটি কিন্তু ডাক্তারের কাছে গেলে নিরাময় যোগ্য হতে পারে, আবার অনেক সময় মানসিক কারণেও এধরনের সমস্যা হতে পারে, তাই প্রয়োজন অনুযায়ী ডাক্তারের কাছে যান, বিষয়টি নিয়ে কথা বলুন আপনার স্ত্রীর সাথে, ভালো করে বসবাসের যোগ্য করে তুলুন নিজের বাসগৃহটি, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবকে দূরে রেখে হাত ধরে এগিয়ে চলুন।
ফাহরিয়া ফেরদৌস।
আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
লেখাটা ভালো লেগেছে