জেসমিন চৌধুরী: আপনি বা আমি দেখতে কতোটা সুন্দর? কীসের মাপে তা স্থির হয়? সুন্দর হবার জন্য কতটুকু কৃতিত্ব প্রাপ্য একজন মানুষের?
দেখতে সুন্দর হবার উপযোগিতা আর ঝক্কি, দু’টোই শিখে গিয়েছিলাম খুব কম বয়সেই। কখনো যথেষ্ট সুন্দর না হবার জন্য সুবিধা বঞ্চিত হয়েছি, কখনো সুন্দর হবার জন্য ঝামেলায় পড়েছি। নিজের থেকে বেশী সুন্দর মানুষদের দেখে ঈর্ষার খোঁচায় বিদ্ধ হয়েছি। শারীরিক সৌন্দর্যের এই অপ্রয়োজনীয়, অসুন্দর মূল্যায়ন থেকে মুক্ত হতে না পারার অসৌন্দর্য আজকাল প্রায়ই আমাকে ভাবায়।
ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে। সম্ভবত ১৯৭৯ সালের কথা। জানা গেল শাহপরানের মাজার জিয়ারত শেষে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান আমাদের স্কুলের সামনা দিয়ে যাবেন, এবং গাড়ি থেকে নেমে ছাত্রদের সাথে হাত মেলাবেন তিনি। শুনে আমাদের সাদামাটা গ্রাম্য জীবন হঠাৎ করেই উৎসবমুখর হয়ে উঠল। স্যাররা বলে দিলেন হাতমুখ ধুয়ে পরিষ্কার জামা জুতা পরে স্কুলে আসতে, যদিও বেশীর ভাগ ছাত্রদের স্পঞ্জের স্যান্ডেলই ছিল না। যা’ই হোক, লাইন ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ছাত্রছাত্রীদের মধ্য থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ভিত্তিতে আমি আর আমার ফুফুতো বোন লীনা প্রেসিডেন্টকে মালা পরানোর জন্য নির্বাচিত হলাম। গর্বে আমাদের মাটিতে পা পড়ে না।
দু’জনে মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি, কালো রোদ চশমা পরা হাস্যোজ্জ্বল জিয়াউর রহমান রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের সাথে হাত মেলাতে মেলাতে এগিয়ে আসছেন। কোন ভুল করে ফেলার আশংকায় আমার মালাধরা হাত কাঁপছে। কিন্তু কাছে এসে আমার হাত এবং হৃৎপিণ্ড উভয়েরই কম্পন থামিয়ে দিয়ে তিনি মাথা নিচু করলেন লীনার সামনে, মালা পরা হলে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘তুমি অনেক বড় হও, ইন্দিরা গান্ধীর মতো হও’।
আমার দিকে তিনি ফিরেও তাকালেননা। কষ্টে অপমানে আমি যখন ঝরঝর করে কাঁদছি, তখন আমার মনের জ্বালা শতগুণে বাড়িয়ে দিয়ে ক্লাসের মেয়েরা বললো, ‘লীনা’র রং বেশি ফর্সা তাই তিনি তার হাতেই মালা নিয়েছেন’।
জিয়াউর রহমান নিশ্চয়ই সাত/আট বছরের একটা মেয়ের হাত থেকে মালা নিতে গিয়ে এসব কথা ভাবেননি, কিন্তু সেই বয়সেই আমার ক্লাসের মেয়েরা জানতো, ফর্সা হওয়া একটা গুণের বিষয়। পরবর্তিতে অবশ্য ফেয়ার এন্ড লাভলী জাতীয় কিছু না মেখেই কিভাবে যেন আমি বেশ ফর্সা হয়ে উঠলাম। লোকে যখন গায়ের রঙের প্রশংসা করতো, শুনতে ভালই লাগত, কিন্তু সাজগোজে খুব একটা মনোযোগী বা পারদর্শী ছিলাম না কখনোই।
একবার আমি যে স্কুলে শিক্ষকতা করতাম সেখানে মজা করার জন্য বৈশাখী কুইন প্রতিযোগিতা হলো। শিক্ষিকারা সবাই বৈশাখী শাড়ি পড়ে সেজে গুজে এলেন, শিক্ষকরা ভোট দিলেন। শূন্য ভোটে হেরে গিয়ে আমি অবাক হয়ে গেলাম। সাজগোজ করিনি বলে একটা ভোটও কি পেতে পারতাম না?
আমার এক পুরুষ সহকর্মী বুঝিয়ে বললেন, ‘আপনাকে তো আমরা ঠিক মেয়েমানুষ হিসেবে দেখিনা, বরং কাজের মানুষ হিসেবে দেখি। আপনাকে দেখলে কাজ ছাড়া আর কিছু মনে পড়ে না আমাদের’।
আমার মনে হলো এত অসাধারণ প্রশংসা বাক্য আমি আগে কখনো শুনিনি। সত্যিই তো, কেন মেয়েরা সেজেগুজে পুরুষের সামনে নিজেকে সৌন্দর্যের বান্ডিল হিসেবে উপস্থাপন করে ভোট কুড়োবে? সেই থেকে সৌন্দর্যের প্রশংসা নয় বরং কাজের প্রশংসা শুনতেই ভাল লাগত। কিন্তু তারপরও অমুক দেখতে সুন্দর, তমুকের গড়নটা আকর্ষণীয়, এসব ভাবনা মাথায় কাজ করতো।
একদিন আমার ছেলের একটা কথায় আমি নিজের সংকীর্ণতার খোলস থেকে ঠিকরে বেরিয়ে এলাম। কথা হচ্ছিল একটা মেয়েকে নিয়ে। আমি বলছিলাম, ‘মেয়েটা যে কেন নিজের চেহারা নিয়ে এতো ভাবে। ও তো দেখতে অনেক সুন্দর’।

আমার ছেলে বললো, ‘তোমরা এভাবে কথা বলো বলেই মেয়েরা এতো ভাবে। তোমরা কেন যে ‘সুন্দর’ ‘অসুন্দর’ এসব শব্দ ব্যবহার করো। এসব শব্দই ডিস্ক্রিমিনেটিং। একজনকে সুন্দর বলার অর্থই হলো অন্যদেরকে অসুন্দর বলা। যাদেরকে তোমরা সুন্দর ভাবো না, তাদের কী দোষ? তারা কী করবে? এসব চিন্তাই কুৎসিত’।
ছেলের কথায় একটা শিক্ষা হলো আমার। মা-বাপের কাছ থেকে ধর্ম-কর্ম শিখেছিলাম, আর সন্তানদের কাছে শিখছি মানবতা।
তারপর থেকে যখনই ফেইসবুকে কারো ছবিতে ‘সুন্দর লাগছে’ লিখতে যাই, হাত কেঁপে যায় একটু। তার মানে কি বাকিদের অসুন্দর লাগছে? তাই বড়জোর লিখি, ‘শাড়িটা সুন্দর’ অথবা ‘তোমাকে স্মার্ট লাগছে’।
এই দ্বিধা কাজ করে বিশেষ করে বাচ্চাদের বেলায়। সেদিন এক বন্ধুর ছেলের জন্মদিনে আপ করা এক ছবিতে লিখতে গিয়েছিলাম, ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউর হ্যান্ডসাম ইয়ং ম্যান’, কিন্তু কী ভেবে থেমে গেলাম। কতজনের কত বাচ্চার কত ছবি আসে, কীসের ভিত্তিতে আমরা ঠিক করি একটা বাচ্চা আর সব বাচ্চাদের থেকে একটু বেশি সুন্দর? এরকম বিচারের মাপকাঠি কি আদৌ থাকা উচিৎ?
এবং সৌন্দর্যের এই কদর্য মূল্যায়নের শিকার হয় মেয়েরাই বেশি।
গেল বছর মেয়েকে নিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছি। ঘরে ঢোকার পর ওই নারীর প্রথম মন্তব্য ছিল, ‘মাশাল্লাহ মেয়েটা সুন্দর হয়েছে, কিন্তু মা’র মতো ফর্সা হয়নি’। সাথে সাথে আমার মেয়েটার মুখ মলিন হয়ে গেল, আমার ভীষণ মন খারাপ লাগতে লাগল।
কয়েকদিন আগে ফেইসবুকে এক বন্ধুর প্রোফাইল পিকচারে এক লোক লিখেছে, ‘আপনার রঙ আরেকটু ফর্সা হলে ভাল হতো’। লোকটার উপর রেগে যেতে যেতে ভাবলাম, এই দোষে দোষী আমরা সবাই। হয়তো আমরা এভাবে অভদ্র মন্তব্য করি না, কিন্তু যে পৃথিবীতে শারীরিক সৌন্দর্য বলে একটা কন্সেপ্ট আছে সেই পৃথিবীতে এধরনের মন্তব্য খুব বেশী অন্যায় নয় নিশ্চয়ই।
একটা মেয়েকে দেখলে প্রথমেই আমরা ভাবি মেয়েটা দেখতে কতটুকু ফর্সা, কতটুকু সুন্দর, চোখ টানা কি’না, নাক খাড়া কি’না। সে মানুষ হিসেবে কেমন, সে কী ভাবে, তার কোন বিশেষ যোগ্যতা বা হবি আছে কি’না সেসব আমাদের মাথায় আসে অনেক পরে, অথবা কখনোই না। মানুষ স্বভাবতই সৌন্দর্য পিপাসু তাই সে ফুল ভালবাসে, কিন্তু ফুল ফোটাতে গিয়ে পাতার নিরলস পরিশ্রমের সৌন্দর্যের কথা মানুষ ভাবেনা।
জেনেসিসের গল্প অনুযায়ী নিষিদ্ধ ফল তুলে নেয়ার সময় ইভের কাছে সেগুলোকে যেমন সুখাদ্য তেমনই ‘নয়নাভিরাম’ বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু সেই আদিমতম সময় থেকে মানুষের ঋত এই ‘সুন্দর’ শব্দটাই আজকাল আমার বিরক্তির উদ্রেক করে। হোক তা ইতিবাচক অথবা নেতিবাচক, যে শারীরিক বৈশিষ্ট্যে আমার নিজের কোন হাত নেই, তার কথা কেন আমাকে বারবার শুনতে হবে?
শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে ভাবনা এবং মন্তব্যের কালচার থেকে আমরা জন্ম দিয়েছি একটা আত্মবিশ্বাসহীন প্রজন্মের যারা অনেক বেশি সময় এবং মনোযোগ দিচ্ছে নিজেকে শারীরিকভাবে আকর্ষণীয় করে তোলবার পেছনে। তারপরও কী তারা স্বস্তিতে আছে?
গল্প, কবিতা, গান, টেলিভিশন, বিজ্ঞাপণ সর্বত্র শারীরিক সৌন্দর্যের জয় জয়কার। এবং এইসব মাধ্যম কিছু নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যকে সৌন্দর্যের চিহ্ন হিসেবে এমনভাবে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছে যে, একটা মেয়ে খুব সহজে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারে যে সে দেখতে ভাল নয়। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন, স্কুলের শিক্ষকরা, এমনকি মাবাবা পর্যন্ত একটা শিশুকে বুঝিয়ে দিতে কার্পন্য করেননা যে সে দেখতে সুন্দর নয়।
সরাসরি বলতে হয় না, একটা বাচ্চা যখন দেখে আরেকজনকে সবাই সুন্দর বলছে কিন্তু তাকে বলছেনা, সে জেনে যায় তাকে নিয়ে অন্যরা কী ভাবছে।
একটিবার ভাবুন তো তার কেমন লাগে নিজের আপাত অসুন্দর শরীরকে এই সৌন্দর্য পিপাসু পৃথিবীর বুকে বয়ে বেড়াতে?
Sundor shobdo ta ashole moner jonne projojjo! Shorirer jonne noe! Amra shobai jeno kaj pagol “sundor” manush hote pari………
Good piece of writing. Let us all try to recognize the inner Beaty in all- irrespective of men and women. I remember during my medical college year I went to a wedding ceremony where a lady was looking for a suitable match for her very eligible son and of course she found out a very fair tall girl who happened to be married. In distraught she was loudly speaking to herself ‘all beautiful girls are booked, all are gone, they do not last for very long…. The most beautiful ones are taken so early that you do not find any beauty in universities, medical colleges…. All ugly girls get higher education….” I was so stunned, such humiliation of whole existence only because you do not fulfill certain criteria!
I would request all to teach your children to value inner quality and focus on self improvement. We canno t chage the whole society but yes we can plant the seeds in our children… Give our all to make them better human being.
‘Beauty is a form of Genius–is higher, indeed, than Genius, as it needs no explanation. It is one of the great facts of the world, like sunlight, or springtime, or the reflection in the dark waters of that silver shell we call the moon. It cannot be questioned. It has divine right of sovereignty. It makes princes of those who have it.’