রোকসানা ইয়াসমিন রেশনা: রিশা। ইস্! যতোবার মেয়েটার কথা ভাবছি, ততোবার চোখ দিয়ে পানি চলে আসছে। আর রিশার মা এর আর্তনাদ মনে হচ্ছে যেন আমারই আর্তনাদ।
সময়টা বড্ড বেশী স্বার্থপর এখন। যেকোনো ঘটনা যতোক্ষণ না প্রত্যক্ষভাবে নিজের ঘাড়ে এসে পড়ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউ সেটা নিয়ে মাথা ঘামানোর চেষ্টা করে না। না হলে আজ যে শিক্ষক রিশাকে হসপিটালে নেয়ার জন্য গাড়ি দিলো না, তার নিজের মেয়ে হলে কী পুলিশ কেস না কী কেস তা ভাবতো?
আমিই বা এতো ভাবছি কেন? রিশার মা এর আর্তনাদে আমার চোখ দিয়েই বা এতো পানি আসছে কেন? সেখানেও তো সেই আমিই জড়িত। রিশা, নামটা কেমন যেন রেশনার সাথে মিলে যায় না? সেটাও না হয় গেল। রিশা যে ক্লাসে পড়তো আমার মেয়েও সেই ক্লাসেই পড়ে। মেয়ের সাথে যে মেয়েগুলো পড়ে, কী সুন্দর চঞ্চল পায়ে গল্প করতে করতে হেঁটে বেড়ায়, দেখা হলে ‘হাই আন্টি’ বলে মিষ্টি একটা হাসি দেয়, এরা সবাই তো একেকজন রিশা।
ভাবা যায়(?) এদের কেউ একজন কোন অশুভ ছায়ার আড়ালে পড়ে নাই হয়ে যাবে? ভাবা যায় না, সত্যিই ভাবা যায় না। তাহলে কী চোখের পানির কারণ এটাই? না, সেটাও না।
আমার স্কুল জীবনের একটা ঘটনা বলি। তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। বাড়ি থেকে স্কুল দেড় কি.মি.। ভ্যানে করে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যাওয়া আসার ভাড়া এক টাকা। যৌথ পরিবারে নিজেরা একগাদা ভাইবোন, সমবয়সী চাচা, ফুফাতো-চাচাতো ভাইবোন মিলে যতোজন লেখাপড়া করতাম, তাতে করে ভ্যান ভাড়ার সাথে আবার টিফিনের টাকা পাওয়াটা ছিল দুষ্কর। যার জন্য ভ্যানে যাওয়ার থেকে ঐ এক টাকা বাঁচিয়ে টিফিনের সময় বন্ধুদের সাথে বাদাম খাওয়া অনেক উপভোগ্য ছিল। এর জন্য প্রয়োজন হতো আধা কিমি পথ বাইপাস করে গ্রামের পায়ে হাঁটা পথ দিয়ে হেঁটে স্কুলে যাওয়া আসা করা। যেতে আসতে একটা ছেলে প্রায়ই আমার পিছন পিছন হেঁটে যেতো। দেখতাম। ভাবতাম আমাকে তো কিছু বলছে না। তাছাড়া সাথে অন্য যারা আছে, তাদের পিছন পিছন ওতো আসতে পারে।

কিন্তু সমস্যা শুরু হলো, যেদিন আমি একা পড়ে যেতাম। বিভিন্ন ধরনের কথা বলতো। অবাক হতাম এই ভেবে, এই টাইপের একটা ছেলে কিভাবে আমাকে এসব কথা বলে? লজ্জায় কাউকে বলতে পারতাম না। তখনকার সময় এমনিতেই তো মা বাবাকে কিছু বলা যেতো না। তার উপর যৌথ পরিবারে মা-বাবারা সন্তানদের সাথে কেমন যেন একটা ফাঁপা দুরত্ব বজায় রাখতো। আর বখাটে একটা ছেলের কথা বন্ধুদেরও বা কেমনে বলি?
আমার চোখ দিয়ে পানি আসছে এই জন্য যে, সেদিনও যেমন উত্যক্তকারীদের অভয়ারণ্য ও আমাদের জন্য নিরাপত্তাহীন পরিবেশ ছিল, আজকের পৃথিবীটা রিশাদের জন্য আরো বেশী অনিরাপদ হয় উঠেছে। ওদের না দিতে পারছি পরিবেশ, না শেখাতে পারছি কিভাবে এই ভয়ংকর পরিবেশে বেঁচে থাকতে হয়। আজ থেকে ২৭ বছর আগে আমি নিজে নিজে বুঝেছিলাম, অপরাধীরা খুব দুর্বল মন মানসিকতার হয়। ওদেরকে মোকাবেলা করতে হয় সাহসিকতার সাথে। যার ফলে উত্যক্তকারীকে শিক্ষা দিতে দেখে পাশে ধান কাটায় ব্যস্ত চারজনকে ছুটে আসতে হয়েছিল তাকে বাঁচাতে। আর আজ রিশাকে প্রাণ দিতে হচ্ছে অকালে। কেউ এগিয়ে আসেনি তাকে বাঁচাতে। ওসময় কি একজন ‘মানুষ’ও ছিল না আশপাশে?
আসলে যুগ যুগ ধরে উত্যক্তকারী ছিলই। এক সময় তারা আমাদের মায়েদের উত্যক্ত করেছে, আমাদের করেছে, এখন করছে আমাদের মেয়েদের, পরে করবে তার মেয়েদের। এইভাবে চলতেই থাকবে। সময় বদলাবে, সব কিছু উন্নত থেকে উন্নততর হবে, কিন্তু মেয়েদের ভাগ্য কেউ বদলে দেবে না।
আমাদের ভাগ্য আমাদেরই বদলাতে হবে। তাই রিশার জন্য আর কান্না নয়। ভবিষ্যতে আর কোন রিশাকে যাতে অকালে প্রাণ দিতে না হয়, সেইজন্যই বেঁচে থাকা রিশাদের আমরা আত্মপ্রত্যয়ী করে গড়ে তুলবো, এটাই হোক আমাদের একমাত্র স্বপ্ন ও সাধনা।
সাথে প্রার্থনা করবো, ধরাপড়া রিশার খুনির যতো দ্রুত সম্ভব দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক।