আসমা আক্তার সাথী: গত তিন দিন ধরে ভাবছি লিখবো। কিন্তু কোনভাবেই পারছিলাম না। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কারণ আমি আজ এমন একজনকে নিয়ে লিখতে বসেছি, যে আমার অতি আপন, আমার কাছে তিনি অনেক সম্মানের, শ্রদ্ধার এবং ভালবাসার।
তাঁর নাম নাজমা খানম ঝর্ণা। যিনি গত ৩১ আগস্ট নিউইয়র্কের কুইন্সে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হয়েছেন। এমন ঘটনার শিকার হতে হবে আপাকে অথবা খালাম্মাকে, এবং তা নিয়ে লিখতে হবে, কখনও ভাবিনি।
আপা বলছি এ কারণে যে ঊনি আমার ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষক ছিলেন। অতি প্রিয় শিক্ষক। আর খালাম্মা বলতাম, ঊনি আমার বাবার সহকর্মী ছিলেন। প্রায় দুই যুগ তাঁরা একসাথে শরীয়তপুর সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে চাকরি করেছেন। সেই সুবাদে খালাম্মার সাথে আমাদের পারিবারিক বন্ধনটা বেশ দৃঢ় ছিল। শুধু শরীয়তপুরেই নয়, পরবর্তীতে যখন খালাম্মারা ঢাকায় পশ্চিম রাজাবাজারে থাকতেন তখন আমরা পূর্ব রাজাবাজারে থাকতাম। আব্বা ঢাকায় এলেই সে বাসায় যেতেন।
আজ আব্বাও নেই খালাম্মাও নেই। মাও নেই। আমার মায়ের সাথেও খালাম্মার খুবই বন্ধুত্বপূর্ণ এবং আন্তরিক সর্ম্পক ছিল। নাজমা আপা সেই আমলেই বেশ সচেতন ছিলেন নারী শিক্ষার বিষয়ে। হাসিমুখে ক্লাসে আসতেন সব সময়। আহা, আপা কেন যে ডিভি লটারি পেয়ে চলে গেলেন যুক্তরাষ্ট্রতে। আর বলি হাড়ি এই যুক্তরাষ্ট্রই যে কেন বা ডিভির নামে আমাদের মেধাবী নাগরিকদেরকে তাদের দেশের নাগরিক করে নিয়ে যায়? নইলে আপা একজন শিক্ষক, তাঁর স্বামী একজন অধ্যাপক, তারা জীবনের শেষ প্রান্তে এসে ২০০৮ সালে চলে গেলেন নিউইয়র্কে। সেখানে তারা একটি ডিপারমেন্টাল স্টোর চালাতেন। পারিবারিকভাবে জানতাম যে, ছোট ছেলে শুভকে ওখানে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য তাঁরা এই ঝুঁকিটা নিয়েছিলেন। বাংলাদেশে থাকলেই যে স্বাভাবিক মৃত্যু হতো, তাও নিশ্চিত করে বলার জো নেই।
বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্র্রেরও সেই একই অবস্থা। ২০০৭ সালে আমি যখন আরটিভি থেকে জাতিসংঘের ৬২তম সাধারণ সভায় প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দিন আহমদের অংশগ্রহণ কভার করতে গিয়েছিলাম, তখন ডিএস অথাৎ ডিউ টু সার্ভিস টাইপ ভিসা পাবার পরও কাজ শেষ করে চলে এসেছিলাম। আপনজনসহ অনেকেই বলেছিলেন আমাকে নিউইয়র্কে থেকে যাবার জন্য। আজ মনে হচ্ছে না থেকে খুবই ভাল করেছি।
কে জানে হেইট ক্রাইমের শিকার হতাম কিনা! নিউইয়র্কে বসবাসরত বাঙালীরা নাজমা খানমের মৃত্যুর ঘটনাকে ‘হেইট ক্রাইম’ বলেই ধারণা করছেন এবং তারা সকলে আতঙ্কে আছেন। আতঙ্কিত না হবারও কোন কারণ নেই। মাত্র দুই সপ্তাহ আগে গত ১৩ আগস্ট কুইন্সের ওজন পার্কে বাংলাদেশিদের পরিচালিত একটি মসজিদের ইমাম মাওলানা আলাউদ্দিন আখুঞ্জি ও তাঁর বন্ধু তারা মিয়া খুন হন।
এবার ধান ভানতে একটু শীবের গীত গাই। জন কেরি, (পররাষ্ট্রমন্ত্রী, যুক্তরাষ্ট্র) আপনি বাংলাদেশে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্ত হতে চান, ভাল কথা। আপনাকে স্বাগতম। আপনি বলেছেন, এ বিষয়ে আপনাদের পর্যাপ্ত সংখ্যক বিশেষজ্ঞ রয়েছে এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা আপনারা করতে পারবেন, সেটাও ভাল কথা। তো, এখন আপনার দেশে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাংলাদেশীরা খুন হচ্ছে, সে ব্যাপারে কী করছেন আপনি? কোথায় এখন আপনার বিশেষজ্ঞ বাহিনী?
নিজের দেশকে নিয়ন্ত্রণ না করে, নিজের দেশের সন্ত্রাসবাদ বন্ধ না করে আপনি আপনাদের বিশেষজ্ঞদেরকে দিয়ে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে চাইছেন। ব্যাপারটা কেমন হাস্যকর হয়ে গেল না? আমি তো জানি নিজের চরকায় আগে তেল দিতে হয়। বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশ সফরে এসে এবার সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ দমনের বিষয়ে অধিক গুরুত্বারোপ করে গেছেন। এভাবেই। অথচ তার দেশেই মুসলিম নিধন চলছে। নিজে দেশের জঙ্গিবাদকে দমন না করে আপনি ঢাকায় এসে সবক দিয়ে গেলেন যে, উচ্চবিত্ত পরিবারের মা-বাবা বাইরে চলে যাবার সাথে সাথেই সন্তানেরা ভিডিও গেমস খেলতে ব্যস্ত হয়ে যায়। যার অধিকাংশই সন্ত্রাসে পরিপূর্ণ থাকে। তো আপনার দেশে সন্ত্রাসী, জঙ্গিরা কোন পথ দিয়ে তৈরি হচ্ছে, সেটা একটু বলুন দেখি।
লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক।