‘অনন্যা শীর্ষ দশ ২০১৫’- উইমেন চ্যাপ্টার এর পথচলা

লীনা হাসিনা হক:

আমাদের বন্ধু সুপ্রীতি ধর অনন্যা শীর্ষ দশ ২০১৫ পুরষ্কার পেয়েছে সাংবাদিকতায়। উইমেন চ্যাপ্টার নামে একটি অনলাইন পোর্টাল চালানোতে সুপ্রীতি নেতৃত্ব দেয়, আর আমরা কয়েকজনা তার পাশে থাকি। মোটা দাগে এই হলো পরিচিতি। তবে এটাই কি সব?

8সুপ্রীতির সাথে আছে অনেকজন, কিন্তু হাতেগোনা কয়জন আমরা পরস্পরের পাশে থাকি। সবাই যখন আনন্দ শেষে চলে যায়, আমরা কয়জন শেষ পর্যন্ত থাকি আনন্দাশ্রু পরস্পরের আঁচলে মুছে ফেলবার জন্য।
আজ এই সুখের দিনে হাসি আনন্দে ভেসে যেতে যেতে কত কথা মনে পড়ে যায়। একটুখানি ব্যক্তিগত কথা না বলে পারছি না।

খুব সম্ভবত ১৯৯৯ বা ২০০০ সালে আমাদের পরিচয়। তখন থেকেই আলাদা কিছু একটা করার কথা সবসময়ই বলাবলি করতাম আমরা। সু তখন প্রথম আলোতে কাজ করে আর আমি বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থায়। শুধু পরিকল্পনা করেই কেটে গেলো প্রায় একযুগেরও বেশি সময়। আমাদের দুজনের জীবনের উপর দিয়েই বয়ে গেছে নানা ঝোড়ো হাওয়া, এলোমেলো হতে হতেও সামলে নিয়েছি। কিন্তু এতোকিছুর পরেও সুপ্রীতির মাথা থেকে আলাদা করে মেয়েদের জন্য কিছু করার চিন্তার উপরে পলি পড়তে পারেনি। আমি অনেকটা সময় দেশে-বিদেশে ঘুরাঘুরির চাকরি করে কাটিয়ে দিলেও আমার বন্ধুটি সেই স্বপ্ন জিইয়ে রেখেছিলো তার প্রাণের গভীরে।

অবশেষে ২০১৩ সালে শাহবাগ আন্দোলন এবং পরবর্তীতে হেফাজতে ইসলাম এর উত্থানের পরপরই উইমেন চ্যাপ্টারের যাত্রা শুরু। যত সহজে বলে ফেললাম তার থেকে অনেক অনেক গুণ বেশি কঠিন ছিলো সেই যাত্রা শুরুর বিষয়টি। পোর্টালের জন্য ডোমেইন তো নিয়ে ফেলা হলো, ‘উইমেন চ্যাপ্টার’ নাম। এখন কাজ শুরু করতে হবে। কী কাজ? টাকা-পয়সা যোগাড় করতে হবে? বিজ্ঞাপন আনতে হবে? প্রজেক্ট প্রপোজাল জমা দিতে হবে কোথাও?

না না, এসব কঠিন কাজ কিছুই করতে হবে না। খুব সোজা কাজ করতে হবে, লিখতে হবে। কে লিখবে এতো সব লেখা একটা ওয়েব পোর্টাল সচল রেখে পাঠকের ইন্টারেস্ট ধরে রাখতে? সুপ্রীতি, মন্টি, নাহিদ, লাইলী বা আমি কেউই তো লেখক নই। যদিও সুপ্রীতি, মন্টি এবং লাইলী পেশায় সাংবাদিক, কিন্তু লেখা কি এতো সোজা! আর আমি তো এমেচার লেখক।

বন্ধু সুপ্রীতি সাহস যোগায়, ‘লেখ তোর যা খুশি, জীবনে দেখছিস তো কম না, সেইসব কথা লিখে ফেল।“  

আর কে আমার মতন নবিশ লেখককে এই সুযোগ দিতো? কোন মেইনস্ট্রিম পত্রিকার সম্পাদক একলা থাকা নারীদের সামাজিক অসুবিধার কথা খোলা হাতে লিখতে উৎসাহী করতো? কোন পত্রিকা সমাজের সকল স্তরের নারীদের কথা বিনা দ্বিধায় ছাপাতো? ছাপতো না বলেই উইমেন চ্যাপ্টার এগিয়ে আসে এই কাজে। ফলে জনপ্রিয়তাও পায় অল্প সময়েই।
ঠিক এক বছরের মাথায়ই উইমেন চ্যাপ্টার এর ডয়চে ভেলে আয়োজিত গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম অ্যাওয়ার্ড এর অধীনে বেস্ট অফ অনলাইন অ্যাক্টিভিজম অ্যাওয়ার্ড জেতা। ওহ, সে এক সময় বটে!

সাংবাদিক এবং শিক্ষক মাসকাওয়াথ আহসান তখন দলেবলে এগিয়ে না এলে হয়তো সে যাত্রায় জেতাই হতো না। উইমেন চ্যাপ্টার শব্দটা তখন ‘বাংলাদেশ’ শব্দের সমার্থক হয়ে উঠেছিল। বিজয়ের পরদিন সৃষ্টি হয় ‘মেল চ্যাপ্টার’ বলে একটা ফান পেজ। প্রবল প্রতাপে বিরাজমান সেই পেজ। আর মেল এবং উইমেন চ্যাপ্টারের বন্ধুত্বও সেই থেকে অটুট।

‘অনন্যা’ পত্রিকায় অনলাইন উইমেন এক্টিভিজম নিয়ে কভার স্টোরিতে আমাদের উইমেন চ্যাপ্টার। আর্টিকেলটি লিখেছিলেন স্বনামধন্য সাংবাদিক ফারুখ ফয়সল। গ্লোবাল মিডিয়া ফোরাম অ্যাওয়ার্ড জেতার আনন্দ উদযাপন স্টার রেস্টুরেন্টে। সুব্রত ধর দাদা সেই আয়োজনের স্পন্সর। নারী সাংবাদিক বা নারী অধিকার কর্মীরা ছাড়াও সেদিন উপস্থিত ছিলেন শাহবাগ আন্দোলনের অনেকে।

আহ… সময়ই ছিল বটে! উইমেন চ্যাপ্টারের একেবারে গোড়াতে ছিল মিজান এবং নক্ষত্র নামের দুই তরুণ আইটি এক্সপার্ট। বিনা পারিশ্রমিকে যে নক্ষত্র গত সাড়ে তিন বছর ধরে উইমেন চ্যাপ্টারের একজন হয়ে যাবতীয় আইটি সহায়তা দিয়ে আসছে, শুধুই উইমেন চ্যাপ্টারকে ভালবেসে। মাঝে মাঝে বিরক্তও হয়, কিন্তু পোর্টালটিকে সে নিজেও ওওন করে ফেলেছে না চাইলেও।  

উইমেন চ্যাপ্টারের যেহেতু কোন আয় নেই, তাই এখানে যা হয় সবই স্বেচ্ছাশ্রম।

বর্তমানে উইমেন চ্যাপ্টারে কত মেয়েরা লেখেন, কত চমৎকার সব লেখা। সাহসী সব লেখা। বুকটা আসলেই ভরে যায় গর্বে। প্রথমদিকে আমরা কয়েকজন নিজের নামে, ছদ্মনামে লিখে লিখে পোর্টালটিকে সচল রাখতাম। এমনও সময় গেছে যে সুপ্রীতি নিজে এবং আমি মিলে দিনে তিন-চারটা করে লেখা লিখতাম একেকজনে। সালেহা ইয়াসমীন লাইলী, ইশরাত জাহান ঊর্মি লিখেছে বিরামহীনভাবে। মুনমুন শারমিন শামস এসে যোগ দিলো আমাদের সাথে। নাহিদ নাওয়া-খাওয়া ভুলে উইমেন চ্যাপ্টারের বিজ্ঞাপন যোগাড়ে ছুটে চলেছে নিরলস। আছে শামীম আরা শিউলীও। লেখা দিয়ে না হোক, ভালবাসায় মিশে থাকা একজন মানুষ। আরেকটি নাম মারজিয়া প্রভা, বয়স মাত্র ২৪, অথচ কী তার লেখনী, কী ক্ষুরধার সেই লেখায়। সেও আছে এই পরিবারে।

টাকা নেই, প্রথম বছর সুপ্রীতি নিজের গাঁটের টাকা খরচ করেই পোর্টাল ডিজাইন এবং একজনকে সহায়ক হিসেবে নিয়ে চালিয়েছে। পরের বছর আমরা নিজেরা চাঁদা তুলে ডোমেইন আর হোস্টিংয়ের বাৎসরিক ফি শোধ করি। কিন্তু লেখাগুলো পড়া, সম্পাদনা করা, লেখা আপ করা সবকিছুই আমাদের হরফুন-মৌলা সুপ্রীতি ধর।

এই সেদিনও যখন ছাপার জন্য লেখা পাওয়া যেতো না, আজ ছাপা হওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে না হলেও গোটা দশেক লেখা! ভালো লাগে, খুব ভালো লাগে! নতুন যোগ হয়েছে বিথী হক, সাদিয়া নাসরিন, শাশ্বতী বিপ্লব, জেসমিন চৌধুরী, শান্তা মারিয়াসহ আরও অনেকে। তুখোড় সব লেখক।

সবচেয়ে মজার বিষয় একটা অনলাইন পত্রিকার সাথে সবার আত্মিক বোধ। সবাই নিজের করে ভাবা পোর্টালটিকে, সর্বাত্মক এফোর্ট দেয়া, একটা পরিবার হয়ে যাওয়া। সুপ্রীতির কিছু নেই, অর্থ নেই, বিত্ত নেই, নেই স্পনসর, নেই বিজ্ঞাপন, অফিসও নেই অফিসিয়ালি, কিন্তু সবার মনের জায়গা এক করে সে এক বিশাল স্থান।

‘অনন্যা’ সম্পাদক তাসমীমা হোসেন আপা যখন পুরষ্কার ঘোষণা করতে গিয়ে বলেন, উইমেন চ্যাপ্টার এমন সব সাহসী লেখা ছাপায়, যা তিনি অনন্যাতে ছাপাতে সাহস করেন না, সারা হল করতালিতে ফেটে পড়ে, বোঝা যায় আমাদের শক্তি। আমি আর বন্ধু সালেহা ইয়াসমীন লাইলী পরস্পরের হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরি। সামনের সারি থেকে  সহযোদ্ধা ছোটবোন মুনমুনের ক্যামেরার অবিরত ক্লিক ক্লিক। পাশে থাকা  সুখ-দুঃখের আরেক সাথী তাহেরা জাবীন আমার কাঁধে হাত রাখে।

আমরা তো জানি, কী পরিমাণ পুরুষতান্ত্রিক নোংরামির মুখোমুখি সুপ্রীতিকে পড়তে হয়েছে, এখনও হচ্ছে। হয়তো আমরা পাশে ছিলাম সেই লড়াইয়ে, আছি সবসময়ই, কিন্তু মূল লড়াইটা আমাদের এই বন্ধুটিকেই করতে হয়। শেষপর্যন্ত ছোটখাটো মিষ্টি মুখের এই মানুষটার ভিতরে যে আগুন আছে সেই আগুনে পুড়ে ছাই হয় সকল অপশক্তির অপচেষ্টা।  

যেকোনো সামাজিক অন্যায়ের প্রতিবাদে উইমেন চ্যাপ্টার প্রতিবাদে সরব সবার আগে সবার উপরে। এর পেছনে যে সাহসী হৃদয়টি সবসময় জাগ্রত তার নাম সুপ্রীতি ধর। এর জন্য সুপ্রীতি এবং ওর সন্তানদেরকেও এই সমাজের নোংরা কিছুু কীট তাদের বিষদাঁত দিয়ে আক্রমণ করতে ছাড়েনি।

এতোকিছুর পরেও পোর্টালটি একদিনের জন্যও বন্ধ থাকেনি, বরং এইসব আঘাতের কষ্ট-অপমানকে আক্ষরিক অর্থেই শক্তিতে পরিণত করে উইমেন চ্যাপ্টার আরও দুর্বার গতিতে এগিয়েছে।
উইম্যান চ্যাপ্টারে লেখা প্রকাশ হওয়ার জন্য কোনো লেখককে কোনো পারিশ্রমিক দেবার ক্ষমতা এর সম্পাদক বা উইমেন চ্যাপ্টার টিমের নাই, তবু মানুষ উইমেন চ্যাপ্টারে লিখছেন। তাঁরা লিখছেন সমাজের প্রতি, বাংলাদেশের নারীর অগ্রযাত্রায় তাঁদের দায়িত্ববোধ থেকে, যুগের পর যুগ ধরে নারীর প্রতি অপমানের প্রতিবাদ হিসেবে, তাঁরা লিখছেন তাঁদের প্রাণের টানে।

এই যে ভালোবাসা উইমেন চ্যাপ্টারের প্রতি, এটেই আমাদের মূল শক্তি। পরিণত বয়সী, অভিজ্ঞ প্রফেশনাল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্রই পা রাখা তরুণ ছাত্রী, সবাই লিখছেন। এখানে যেমন আছে ১৪ বছরের কিশোর লেখক, যে কিনা নারী ইস্যুটি এই বয়সেই গেঁথে নিয়েছে মনে, তেমনি আছেন ৬৭-৭০ বছরের মা-মাসীরা। তারাও লেখেন সমাজে নারীর প্রতি সকল অসঙ্গতির কথা। এ যেন এক মহা উৎসব!

নারীর অর্থনৈতিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সংগ্রামের কথা, সকল বাঁধা ঠেলে নারীর এগিয়ে যাওয়ার কথা নিয়ে কত লেখা। নারীর বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিবাদের, মানুষকে নারীর প্রকৃত অবস্থা জানানোর এক সর্বজনীন প্ল্যাটফর্ম উইমেন চ্যাপ্টার। যেসব কথা এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কোনো নারী কোনো জায়গায়ই বলতে পারে না, তা সে সন্তানের কাস্টডি, পরিবারে যৌন হয়রানি, সমাজের সকল স্তরে নারীর প্রতি স্ট্রাকচারাল ডিস্ক্রিমিনেশন, উত্তরাধিকার আইন থেকে শুরু করে নারীর যৌনতার অধিকার, সেইসব কথা আজ জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে উইমেন চ্যাপ্টারে।

সত্যি বলতে উইমেন চ্যাপ্টার আমদের ঘূণে ধরা সমাজ ব্যবস্থার মেকি সাজসজ্জা করা মুখের উপরে জোরে সত্যের জানালার কপাট খুলে ধরেছে। এসবই মূলত সম্ভব হয়েছে সুপ্রীতি ধর নামের অনেক আবেগী, ভুল করা, অর্থনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে অপারগ, সাহসী এক নারীর কারণে। এই সুপ্রীতি আমাদের বন্ধু। নাকি আমরা সুপ্রীতির বন্ধু।
আজ উইমেন চ্যাপ্টার আর সুপ্রীতি ধর সমার্থক হয়ে উঠেছে। অবশ্যই সকল সময়ে পাশে থাকা, বুদ্ধি দিয়ে, সাহস দিয়ে, প্রয়োজনে অর্থ দিয়ে সহায়তা করা সকল বন্ধুর কথাই আমরা অনেক ভালবাসায় মনে করি। অনন্যা শীর্ষ দশ ২০১৫ পুরস্কারটি আসলে শুধু সুপ্রীতি ধর নয়, আমরা সবাই সমানভাবে নিজের মনে করি।

আজ এই আনন্দক্ষণে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত উইমেন চ্যাপ্টার পরিবারের সকল সদস্য, শুভানুধ্যায়ী, লেখক, পাঠক সবাইকে শুভেচ্ছা। উইমেন চ্যাপ্টার তথা সুপ্রীতির জন্য আপনাদের ভালোবাসা সবসময় কাম্য। এই পোর্টালটি এখন বাংলাদেশের সকল নারীর। উইমেন চ্যাপ্টার বাংলাদেশের সকল মানবাধিকার কামী মানুষের।
জয় হোক নারীর, জয় হোক মানুষের, জয় হোক মানবতার।

(একজন উইমেন চ্যাপ্টার পরিবারের সদস্য)

 

শেয়ার করুন:

আমি উইমেন চ্যাপ্টারের সম্পর্কে জানতে পরেছি কিছুদিন হল। এখন এর নিয়মিত পাঠক।
“অনন্যা শীর্ষ দশ ২০১৫” পুরস্কার লাভ করেছে। এই জন্য সুপ্রীতি ধর সহ সকলকে আমার আন্তরিক অভিনন্দন।
আর অনেক শুভ কামনা।