বিথী হক: আগের দিনে ঋতুমতী হবার আগেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে পরের ঘরে পাঠানোর এক অনবদ্য নিয়ম ছিল। সেটা বিভিন্নভাবে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমান সমাজের শেকড় পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করেছে। গ্রামাঞ্চলে যদিও এখানো প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিকে পা দেয়ার আগেই মেয়েকে পাত্রস্থ করার জন্য পাড়া-পড়শীর ঘুম হারাম হয়ে যায়; বাধ্য মা-বাবার তো মাথা এমনিতেই ভার থাকে।
তারা বলেন “বেটি না মাটি” হা হা হা! যতদিন বাড়ি থেকে বের না হচ্ছে, ততদিন মাথার উপর বোঝা হয়ে থাকে সেই মাটি অর্থাৎ বেটি।
হাতে গোনা কিছু সভ্য পরিবার এখন তৈরি হয়েছে, যারা ভদ্রতা করে হলেও একবার জিজ্ঞেস করেন মেয়ের কী কোন পছন্দ আছে কি না। নাহলে বেশিরভাগ পরিবার নিজেরা সব সিদ্ধান্ত নিয়ে মেয়েকে শুধু জানিয়ে দেন, বিকেলে সুন্দর করে সাজগোজ করে মাথানিচু করে যেন পাত্রপক্ষের সামনে গিয়ে বসে, যা কিছু প্রশ্ন করে তার সুন্দর করে গলা নিচু করে জবাব দিতে।
তারপর মেয়েকে একটা হাইফাই ফিচারের আকর্ষণীয় প্যাকেজ বানিয়ে বসে পড়েন মেয়ে বেচতে। এ বাজারে মেয়ে যত সুন্দরী, যত কর্ম পটু, ঝি-গিরি করার মানসিকতার ধারক যে যতো, তার ততো ভাল চাহিদা। তার জন্য তত বড় বড় চাকুরীওয়ালা, পয়সাওয়ালা, গাড়িওয়ালা, বাড়িওয়ালা পাত্রের ভিড়।
মেয়ের বয়স যত বাড়তে থাকে, বুদ্ধি বাড়তে থাকে তত বিয়ের বাজারে তাদের চাহিদা কমতে থাকে। কারণ, বয়স হলে মেয়েরা বুড়ো হয়ে যায়। বুড়ো হলে চেহারা নষ্ট হয়ে যায়, বুড়ো হলে অনেক চালাকও হয়ে যায়। জেনেশুনে কেউ নিশ্চয়ই নিজের পায়ে কুড়াল মারতে চাইবেন না; না মেয়ে বেচতে আসা অভিভাবক, না কিনতে আসা খদ্দের।
এই পুরো প্রসেসে মেয়ের নিজের বলে কোন কিছু থাকে না, বলার মত কিচ্ছু না, প্রতিবাদের মত কিচ্ছু না। সে চুপচাপ বাবা-মা খারাপ চান না বাক্যের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে। এর কারণও অবশ্য কম না। মা-বাবা যা চাইছেন তার বিপরীতে দাঁড়ানোর জন্য নিজের যে রসদ লাগে সেটাই তো তৈরি হয় না তার, কী করে চলবে বিপরীতে? কে ধরবে তার হাত? বাধ্য হয়ে তার মা-বাবার সকল সিদ্ধান্তে মত না দিয়ে উপায় থাকে না। ধুরু, মতের তোয়াক্কাই বা করে কে যে মত দেয়ার প্রশ্ন আসবে!
এতো গেল পরিবারের জন্য বিয়ে করা, নিজের জন্য কি তাহলে মানুষ আবার বিয়ে করবে? -সামাজিকভাবে, না।
তাহলে যে পরিবারের জন্য বিয়েটা সে করলো, তার তো অনেক কিছুই পছন্দ না হতে পারে, তার নিজের কল্পনার পুরুষ থাকতে পারে, এক জীবনে সেই পুরুষের সাথে সে কিভাবে একত্রিত হবে? সমাজ তো বলেই দিয়েছে “না”, বিয়ে একবার! তাহলে যে বিয়ে মেয়েটা না করে তার পরিবার করলো তার কী হবে?
যে বিয়ে মেয়েটা নিজে না করেও সংসারে আকন্ঠ নিমজ্জিত হতে থাকে, তার কী হবে? তার জীবনটা কি তাহলে তার নিজের, নাকি তার বাবার? নাকি তার মায়ের? নাকি ভায়ের? নাকি কারো না, শুধু স্বামীর? আচ্ছা মেয়েটার একটা জীবনের দাবিদার যদি এতো মানুষ হয়, তো মেয়েটারও একটা না একটা জীবন দাবি করার অধিকার থাকার কথা।
কোন জীবনের দাবিদার হবে সে? স্বামীর, মায়ের, বাবার নাকি ভায়ের? সে তো কারো সামনে গলা খুলতেই পারে না, তাহলে জীবন দাবি করার কথা কিভাবে বলবে সে?
প্রিয় বিবাহযোগ্য ঢ্যাঙা মেয়েরা, ভালবাসা নিন। সারাজীবনে এই ভালবাসাটারই বড় অভাব আপনাদের। সবাই ভালবাসার নামে আপনাদের কব্জির ভেতর লুকিয়ে রাখতে চায়। আপনি ভাবতে থাকেন এটা ভালবাসা, এটা প্রেম, এটা স্বপ্নসহ আরো অনেক কিছু। সত্যিটা হলো আপনি কারো জন্য কিছু হতে পারেন নিশ্চয়ই, তবে ভালবাসা নন।
ভালবাসা আপনাকে ভাল থাকতে দেয়, আপনার মতামতকে প্রাধান্য দেয়, আপনার কথার গুরুত্ব দেয় এবং সবচেয়ে বেশি যেটা দেয় সেটা হচ্ছে জীবনের গুরুত্ব। কারো মিষ্টি কথায় গলে যাবার আগে ভাল করে ভেবে দেখুন, গলে গেলেই কিন্তু মানুষ হারিয়ে যায়।
অ্যারেঞ্জ মেরেজের আগে তাই নিজেকে একটু ভাববার মতো সময় দিন। বিয়েটা কী পরিবার করছে নাকি আপনি? বা স্বয়ং আপনি বিয়ের জন্য আদৌ প্রস্তুত কিনা? যদি বিয়েটা নিজের জন্যই করতে হয় তো নিজের পছন্দেই করুন। আপনি যতোই পরিবারের বাধ্য মেয়ে হন, পরিবারের সবকিছুই কি আপনার পছন্দ হয়?
সবচেয়ে বড় কথা আপনি যা চান তা আপনার মতো ভাল কেউ বুঝবে না। আর মা-বাবার সাথে তো প্রজন্মগত একটা গ্যাপও আছে। দু’য়েকটা ব্যতিক্রমী কেইস ছাড়া তাদের সাথে আপনার মানসিকতা কোনভাবেই পুরোপুরি মিলে যাওয়া সম্ভব নয়। নিজের জীবনের দায়িত্ব তাই অন্য কারো ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়ার চেয়ে এতবড় গুরুত্বপূর্ণ কাজটা নিজেই করুন।
রান্না পারেন কি না, সেলাই পারেন কি না, ঘর গোছাতে পারেন কি না এসব প্রশ্ন করলে ঝেঁটিয়ে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসুন। এসব তার পরিবারের মাথাব্যথার কারণ হলেও হতে পারে, তার জন্য ঘটা করে দেখতে এসে প্রথম দিনে জিজ্ঞেস করতে হবেই বা কেন? পাত্রপক্ষকে আপনাকে বাজারের আলু-পটল ভাববার মতো ধৃষ্টতা দেখাতে দেবেন না। বিয়েটা শুধুমাত্র ছেলেটাই করছে না, আপনিও করছেন।
সুতরাং, তার যেমন আপনি কী কী পারেন সেসব জিজ্ঞেস করার অধিকার আছে, সে কী কী পারে সেটা জিজ্ঞেস করার অধিকারও আপনার আছে। মাথা নিচু করে বসে থেকে নিজেকে ভাষাহীন অবলা পশুর মতো গরু-ছাগল মনে করবেন না। সে রান্না পারে কিনা, ঘরের কাজ করে কিনা সেসব কিন্তু আপনারও প্রশ্ন হওয়া উচিত, যদি না আপনি তার ঘরে ঠিকা ঝি এর কাজ করতে যান।
আবার বিয়ে করতে না চাওয়া মানেই আরেকজনের সাথে প্রেম করা নয়। বিয়ে ছাড়াও জীবনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করার আছে। নিজের ক্যারিয়ার আছে, নিজের স্বপ্ন আছে, নিজের পরিবার এর প্রতি কিছুটা দায়িত্ব আছে।
সবশেষে, যখন আপনি নিজেই সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করবেন তখনি শুধুমাত্র বিয়ে করবেন। বাবা, মা, পাড়া, প্রতিবেশী, বিদেশী আত্মীয়-স্বজন বলল বলেই বিয়ে করে ফেলতে হবে এই মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসুন। জীবন যা দেবে তার প্রত্যেকটা হিসেব-নিকেষ আপনার এবং কেবল আপনারই কষতে হবে। সে সময় কেউ পাশে থাকবে না কিন্তু, যত কাঠ খড় পোড়ানোর সব আপনার একলারই পোড়াতে হবে।
অনুরোধ রইল, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে নিজের পছন্দে একজন মানুষকে বিয়ে করুন, যে আপনার মনিব হতে চায় না, আপনার স্বামী হতে চায় না, প্রভু হতে চায় না, তাকেই বিয়ে করবেন। বিয়ে করবেন যে আপনার সঙ্গী হতে চায়, বন্ধু হতে চায় আর হাত ধরে থাকতে চায়। শুভ কামনা।
It’s only possible if you able to give your daughter enough knowledge about life. REMEMBER KNOWLEDGE IS POWER!
চমৎকার লেখা।
আপনাকে ধন্যবাদ।