রিশা তো আমাদেরই কন্যা

ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী: গত দুইদিন ধরে এক অদ্ভুত অস্থিরতায় সময় কাটছে। বিষণ্ণতা গ্রাস করছে আমার একাকি সময়গুলো। আমার দুই কন্যা স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছে, আমি ওদের নাশতা দিচ্ছি, চুলে বেণী গেঁথে দিচ্ছি, জামা ইস্ত্রি করে দিচ্ছি, টিফিন গুছিয়ে দিচ্ছি – সবই রোজকার মতো।

Rishaতবু বুকের মধ্যে রিশার ছবিটা থেকে থেকে ভেসে উঠছে। আমার কন্যাকে আমি রিশা ভাবছি, নিজেকে ভাবছি রিশার মা। কেবলই মনে হচ্ছে, রিশার মাও হয়তো সেদিন এভাবেই মেয়েকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন! পরম মমতায় টিফিন ভরে দিয়েছিলেন বক্সে। তার ফিরে আসার অপেক্ষায় ছিলেন! হয়তো আদরের মেয়েটি মায়ের সাথে কখনো কখনো ঝগড়াঝাঁটিও করতো, মাকে খুব যন্ত্রণাও দিতো, আবার স্কুল থেকে ফিরে ইউনিফর্ম না ছেড়েই মাকে জড়িয়ে আদর নিতে আসতো, হয়তো তার প্রিয় কোনো খাবার টেবিলে দেখে হাত-মুখ না ধুয়েই খেয়ে দেখতে চাইতো, মায়ের বকুনি খেয়েও হাসতে থাকতো, স্কুলের নানা গল্প বলে মায়ের কান ঝালাপালা করতো!

সেদিনও হয়তো মায়ের জন্য গল্পের ঝুলি নিয়ে বাড়ি ফিরতো!

হয়তো বা বাড়ি ফিরেই বলতো, “মা, আমার খিদে পেয়েছে।”  
ঘূণাক্ষরেও মা কী জানতেন যে স্কুল থেকে মেয়ের আর বাড়ি ফেরা হবে না? বাড়িতে ঢুকেই বাড়ি মাথায় তুলতো যে মেয়ে, সে আর বাড়িই ফিরবে না? তার জন্য বেড়ে রাখা গরম ভাত-তরকারি খাওয়াই হবে না আর??

একটা বাচ্চা স্কুলে গিয়ে আর বাড়ি ফিরলো না – একজন মায়ের তখন কেমন লাগে? – আমার মাতৃহৃদয় ভেঙে খানখান হয় – থেকে থেকে নিজেকে রিশার মা মনে হতে থাকে।
সন্ধ্যেবেলায় আমার এগারো বছর বয়সী কন্যা বই নিয়ে পড়তে আসে। একটি অধ্যায় সে বুঝতে পারছে না- “নারী-পুরুষের সমতা” – ” নারী – পুরুষ ” সবাই তো মানুষ, তাহলে সমতায় কী সমস্যা?” তার সরল প্রশ্ন। তার নিষ্পাপ মস্তিষ্কে আমাকে তুলে ধরতে হয় ইভ টিজিং,যৌতুকের বলি, এসিড সন্ত্রাসের মতো ভয়াবহতম উদাহরণ। রিশাকে কেন মেরে ফেলা হবে, তার ছোট্ট মাথায় তা বোধগম্য হয় না কিছুতেই।

আমি মেয়েকে বলি, “যে ছেলেটা এই জঘন্যতম অপরাধটা ঘটালো, তার যদি এতোটুকু শিক্ষা থাকতো যে নারীরাও মানুষ, তাদেরকে কীভাবে সম্মান করতে হয়, যদি সে একবার চিন্তা করতো যে তাকে যিনি গর্ভে ধারণ করেছেন, জন্ম দিয়েছেন, তিনিও একজন নারী – তাহলে কী সে এই পাপ করতে পারতো?”
এই সহজ- সরল বাচ্চাদেরকে আমাদের শিখাতে হয়,
“মাগো, স্কুলের ক্যান্টিনে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া যেও না, গেলেও একা কখনো না। টাকা দেবার সময় সাবধানে দূরত্ব রেখে দেবে যেন ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ তোমার হাত স্পর্শ করতে না পারে।”

রিশাকেও নিশ্চয় শিখতে হয়েছিল এসব। মায়ের সাথে স্কুলের জামা বানাতে দর্জির দোকানে গিয়েছিল রিশা। ক্যাশমেমোতে মায়ের মোবাইল নম্বর আর বাড়ির ঠিকানা দেয়াটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় তার জীবনে। দর্জির দোকানে ফোন নম্বর তো আমরা অহরহ দিয়েই থাকি। এটা যে রিশার জন্য মরণফাঁদ হবে তাই বা কে জানতো?

ওই সাক্ষাৎ ইবলিশটা যখন রিশাকে উত্যক্ত করছিলো, নিশ্চয় ছোট্ট রিশার গা গুলিয়ে উঠেছিল ঘৃণায়। রাগে সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠেছিল।
একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে যখন বিশ্বময় নারীদের দৃপ্ত পদচারণা, তখন রিশার মতো একজন কোমল কিশোরীর এমন করুণ পরিণতি আমাদের বড্ড ভাবিয়ে তোলে।

সেই ভাবনার দরজায় রক্তাক্ত রিশা এসে দাঁড়ায়, বাঁচার আকুতি জানায়। আমার কন্যার মুখে আমি রিশার মুখ দেখি, নিজেকে ভাবি রিশার মা। লেখাপড়া করে বাবা-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করার কথা ছিল ঝকঝকে,হাসি-খুশি চেহারার মিষ্টি মেয়েটির। বহুদূর পথ পাড়ি দেবার ছিল তার। যে বয়সে পৃথিবীর রূপ-রস-ঘ্রাণ প্রাণ ভরে উপভোগ করার কথা, সেই রঙিন বয়সে পৃথিবীর একী বীভৎস রূপ দেখে বিদায় নিতে হলো তাকে??

তনু, মিতু, আফসানা, রিশারা বারবার মরে আমাদের বুঝিয়ে দিয়ে যাচ্ছে- কী কদর্য, নৃশংস, ভয়ংকরতম খুনিরা আমাদের আশেপাশে ওঁৎ পেতে বসে আছে। সুযোগ পেলেই এই নপুংসকের দল দেখিয়ে দিচ্ছে কী করতে পারে ওরা। ওদের কী পরিবার নেই? ওরা কী মায়ের স্নেহে বেড়ে ওঠেনি? কোন পৃথিবীর জীব ওরা??
.. আমি আর ভাবতে পারি না। রিশাকে নিজের কন্যা মনে হয়.. নিজেকে রিশার মা…

রিশার খুনি ধরা পড়েছে, আমরা চাই ওক যেন কোনরকম ছাড় না দেওয়া হয়। ওকে যেন এমন শাস্তি দেয়া হয়, যাতে ভবিষ্যত অপরাধীরা একটা বার্তা পেয়ে যায়। আর যেন সাহস না পায় এমন করতে। খুনি যত বড় ক্ষমতাধরই হোক- কোনো ছাড় পাবে না, দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পাবে – এদের ঘটানো অপরাধের পরিপ্রেক্ষিতে এটা কী খুব অন্যায় দাবী? ওদের মেরুদণ্ড যদি আমরা ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে চাই, বিষাক্ত নখ আর বিষদাঁত উপড়ে ফেলতে চাই – সেই চাওয়াটা কী অপরাধ হবে?
রিশা তো আমাদেরই কন্যা। আমরা তো রিশারই মা।

শেয়ার করুন: