তানজিনা তাইসিন: যেসব নিয়ে কথা বলে লাভ নাই, সেইসব নিয়ে কথা বলতে ইদানিং খুব অস্বস্তি হয়! চুপ করে থাকি। নয়তো ভেতরে এমন নিস্ফল আক্রোশ তৈরি হয়, অসুস্থ হয়ে পড়ি। ফেসবুকে দু’চারটা জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখার পর আরও অসহায় লাগে!
আমার এইসব আবেগ, অনুভূতি, ক্ষোভ, আক্রোশ কোনো জানোয়ারের একটা রোমকূপের গোড়ায় এতটুকু বাতাসও লাগাতে পারবে না জানি। তনুর পর তনু আসবে, যাবে, তনুর পর রিশা আসবে, যাবে।
বেনাপোলের দোলা খাতুন, মাদারীপুরের সাথী আখতার, পিরোজপুরের শারমিন, নারায়ণগঞ্জের সিমি, গাইবান্ধার তৃষা…‘বখাটেদের’ অত্যাচারে, অপমানে, ছুরিকাঘাতে মরে যাওয়া এক-একটা নাম। কারা এইসব বখাটে? আমাদেরই সমাজে বাস করা আমার ছোট ভাই, আমার প্রতিবেশি, আমার বন্ধু, পাশের বাড়ির ছেলেটা? রোজ যাওয়া আসার পথে যে ছেলেগুলোকে গলির মাথায় আড্ডা দিতে দেখি, ক্রিকেট খেলে যেই ছেলেগুলো তারা? ভ্যানে করে সবজি ব্যাচে যে ছেলেটা, সকালবেলা স্কুলে যায় আর বাকি সময়টা বাবার দোকানে বসে, সে? দর্জির দোকানে চুপচাপ কাজ করে যায়, ফ্লেক্সির দোকানে রিচার্জ করে, ফার্মেসিতে ওষুধ বেচে, ওরা? নাকি কোন অন্য গ্রহের কোন প্রাণী?
এতো সবকিছু মনে হওয়ার কারণ আজ আমার ফেসবুকে বন্ধুতালিকায় একজনের মিউচুয়াল বন্ধু হওয়ার সূত্রে দেখতে পেলাম, ’এক দায়িত্ববান এদেশের নাগরিক’ রিশার হত্যাকারী ওবায়েদুলকে হাতের কাছে পেলে সে কী করতো তাকে কি করা উচিৎ এইসব হম্বি তম্বি করে বিশাল স্ট্যাটাস ফেঁদেছেন। চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমার স্কুল-কলেজের দিনগুলো। এই ছেলে আমাদেরই আগে বা পরের ব্যাচের হবে। আমাদের জুনিয়র এক মেয়েকে কী বিরক্তটাই না করেছে।
মেয়েটা কাঁদতো, না পারতো ছেলেটাকে বুঝাতে, না পারতো বাবা-মাকে বুঝাতে, রেজাল্ট খারাপ করতে শুরু করল। দলবল নিয়ে যখন- তখন পথ আটকে দিত মেয়েটার, কথা বলতে হবে, চকলেট নিতে হবে, চিঠি লিখতে হবে। শেষ পর্যন্ত মেয়েটা বাধ্য হয়ে একটু-আধটু সায় দিতে থাকে। একটা অসম প্রেম হয়। কিছুদিন পর জানতে পারি প্রেমের অপরাধে মেয়েটি স্কুল থেকে টিসি পায়।

মেয়েটা আত্মহত্যা করতে পারতো। সে সময় প্রেমটা নাহলে হয়ত রিশার মত ছুরিকাঘাতে লাশ হয়ে পরে থাকতে পারতো।
এই বখাটেরা ভিন্ন গ্রহের মানুষ না। মেয়েদের উত্ত্যক্ত করাকে তারা অপরাধ মনে করে না। বরং ঢালিউড, বলিউড তাদের শিখিয়েছে মেয়েদের জ্বালানো বা ‘লাড়কি ছেরনা’ খানিক নায়োকোচিতও বটে!
আমাদের সমাজ একে ছেলেছোকরাদের একটু-আধটু দুষ্টুমি হিসেবে নিয়েছে। খুন হয়ে যাওয়ার আগ পর্যন্ত এর ভয়াবহতা টের পাই না। একটা মৃত্যুর পর আরেকটার জন্য অপেক্ষা করি। এইসব বখাটেদের সকলেই কি অভিভাবকহীন? পরিবারের অভিভাবকের কথা বাদ দিলাম। তারা হয়তো জানেনই না। এলাকার মুরুব্বি, বড় ভাই, বন্ধু, আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী কেউ কিচ্ছু করতে পারে না? এতো এতো তাজা প্রাণ, এ কীরকম অপচয়!
বেদনাহত হওয়া অক্ষমের আশ্রয়! আমি রিশার জায়গায় নিজেকে দেখতে পাই। পেটে ছুরি নিয়ে কিশোরী আমি বিস্ময়ে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকি…তোমরা আমাকে মরে যেতে দিলে! তোমরা এখনও ওই খুনিটাকে ধরতে পারোনি?
আমি জানি না খুনি ধরা পড়বে কি না! আর ধরা পড়লেও যে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, এবং সেই শাস্তি দেখে আর কোন ওবায়েদুলের জন্ম হবে না- সে ব্যপারে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারি না। তবু আসুন, অনলাইনে-অফলাইনে যে যেভাবে পারি রিশা হত্যাকারীর বিচারের দাবী তুলি এবং ফলোআপ রাখি ( আজকাল প্রতিনিয়ত এত এত ইস্যু থাকে যে আমাদের গোল্ডফিশ মেমোরি পুরোনোকে ঠেলে ফেলে নতুন কে জায়গা দেবে এটাই স্বাভাবিক)।
একটা ছোট্ট আপডেট দিয়ে শেষ করি। গাইবান্ধার তৃষার কথা মনে আছে তো তাই না? ঐযে ক্লাস ফোরে পড়া ছোট্ট তৃষা! স্কুল ছুটির পর বাড়ী ফেরার পথে তিন বখাটে যুবকের ধাওয়া খেয়ে পালাতে গিয়ে পুকুরে ডুবে মরে গিয়েছিল। ২০০২ সাল। উত্তাল হয়েছিল গাইবান্ধা, গোটা দেশ! খুনিরা ধরাও পড়েছিল। হাইকোর্ট ৭৫ দিনের মাথায় রায় দিয়েছিল মৃত্যুদণ্ড!
তারপর কি হয়েছিল জানেন? সেই রায় কিন্তু বহাল থাকে নাই। রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল করেন। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিন আসামির আপিল আংশিক মঞ্জুর করেন আপিল বিভাগ। আদালত আসামিদের মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন করে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেন।
আসুন, আমরা পরিবারের শিশুটির ছোটখাটো সকল অসুবিধার কথা আমলে নেই, তার নিরাপত্তার ব্যাপারে চিন্তা করি। পুলিশে জানিয়ে রাখি। নয়তো তৃষা, রিশার পর আপনার পরিবারের শিশু নিশার এমন পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকুন।