শারমিন শামস্: চাঁদপুরে সাথী নামে একটা বাচ্চা মেয়ে আত্মহত্যা করেছে। পরীক্ষার ফি মাত্র চারশ টাকা। কিন্তু দরিদ্র বাপ-মা তার পুরোটা একবারে দিতে পারেনি। আশি টাকা কম পড়েছিল। শুধু সাথী না, আরো কয়েকটা বাচ্চাও সেই স্কুলে পুরো ফি একবারে জমা দিতে পারেনি।

ফলে এদেশের কুশিক্ষিত, অসভ্য শিক্ষকরা বরাবর যা করে থাকে, তাই-ই করেছে। বাচ্চাগুলোকে শাস্তি দিয়েছে। ১৩/১৪ বছরের কয়েকটা বাচ্চা রোদের মধ্যে ঘণ্টাখানেক দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হয়েছে। পরে অন্য শিক্ষকরা তাদের সরিয়ে নেয়। কিন্তু অপমানটা বুকের খুব গভীরে গিয়েই নিশ্চয়ই বেজেছিল সাথীর। বাড়ি ফিরে সে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলে পড়েছে। তারপর মরে গেছে।
এদেশে শিক্ষক সমাজকে খুব উচ্চে তুলে ধরা হয়। নিশ্চয়ই শিক্ষকদের শিক্ষা, মূল্যবোধ আর মানবিকতায় অনেক উঁচুতে অবস্থান করার কথা, সেটা ভেবেই তাদের উঁচুতে রাখা হয়। কিন্তু যখন এ ধরনের ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকে, তখন এদেশের শিক্ষক শ্রেণী কোন বিশেষ ধাতু দিয়ে তৈরি, তা জানার ইচ্ছে আম পাবলিকের হয়, যারা চিরকাল শিক্ষককে উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে রেখেছে।
যদি আমি আমার নিজের জীবনের কথা বলি, আমার শৈশব-কৈশোর আর তারুণ্যের অভিজ্ঞতা বয়ান করি, তবে আমি বলতে বাধ্য হবো, এদেশে, এই সমাজে শিক্ষকদের অধিকাংশই শিশু-কিশোরদের প্রতি অসংবেদনশীল, অমানবিক এবং তাদের বেশিরভাগেরই শিক্ষক নামে মর্যাদা পাবার কোন ধরনের যোগ্যতা নাই।
আমি যখন স্কুলে পড়তাম, তখন আলম স্যার নামে একজন শিক্ষক ছিলেন যিনি আমাদের নিয়মিত স্কেল দিয়ে হাতে বাড়ি দিতেন। একবার আমি ভয় আর আতঙ্কে তার হাত থেকে স্কেল কেড়ে নিয়েছিলাম। তারপর পুরো একঘণ্টা ক্লাসের বাইরে নিলডাউন নামের এক ভয়াবহ শাস্তি আমার কপালে জুটেছিল।

এই ধরনের ঘটনা হরহামেশা ঘটতো, এখনো ঘটে। এসব প্রকাশও পায়। তবে যেগুলো খুব একটা প্রকাশ পায় না তার মধ্যে দু’একটা উল্লেখ করি। নজরুল স্যার নামে আমারই স্কুলে এক বিখ্যাত ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন, যিনি আমার বড় তিন বোনেরও শিক্ষক। পর্যায়ক্রমে আমারো। স্কুলের পর তার বাসায় প্রাইভেট পড়তে যেতাম। ৮/১০ জন ছেলেমেয়ে একসাথে পড়তাম। স্যার আমাকে বা অন্য কোনো পছন্দের মেয়েকে পাশে বসাতেন আদর করে। এবং কোন ভুলভাল করলেই স্নেহের ছলে আমাদের পিঠ থেকে পশ্চাৎদেশ অবধি ক্রমাগত হাত বুলাতে থাকতেন। সেই ১৩/১৪ বছর বয়সে এই অভিজ্ঞতা ছিল ভয়ংকর। সেটা সহ্য করেই স্যারের কাছে পড়তে হতো। বাবা-মা বা আর কাউকে বলতে পারতাম না।
এটা যে বলা যায়, সেটা ধারণাতেই ছিল না। সাহস তো দূর কী বাত!
বড় হয়ে বোনদের কাছে জেনেছি, তারা দুইজনও এই ব্যাপার সহ্য করে দাঁতে দাঁত চেপে পড়তো নজরুল স্যারের কাছে। এরশাদ স্যার ছিলেন। ব্যাচে পড়াতেন না, বাসায় এসে পড়াতেন। ভুল করলেই খপ করে ধরতেন হাত, আর ছাড়তেন না। পরে জেনেছিলাম, আমার ক্লাসমেট, যারা তার কাছে পড়তো, সবার কাহিনী এক। সবার হাত খপ করে ধরে নিজের হাত ঘষতেন প্রায় ৬০ বছর বয়সী ওই বৃদ্ধ শিক্ষক। তবে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে ওই শহরে এক নামে ওই দুইজনকেই চিনতো সবাই।

এতো গেল স্কুল শিক্ষকের লাম্পট্যের কাহিনী। এবার অন্য জিনিস বলি। স্কুলে চিরকাল দেখতাম ভালো স্টুডেন্টদের প্রতি শিক্ষকদের পক্ষপাতিত্ব, বাড়তি স্নেহ। কচি মনে কষ্ট হতো। তবে এই সমাজে বাচ্চারা ছোট থেকেই এসবে খাপ খাইয়ে নেয়। নিতাম। ভেবে নিতাম, এসব আদর-ভালোবাসা আমার বা আমাদের মত মিডিওকারদের পাওনা নয়। কিন্তু যখন ক্লাসে প্রকাশ্যে তুলনা টেনে টেনে অপমান করতেন খোদ শিক্ষক-শিক্ষিকারা, যা তা বলতেন, হাসি চওড়া হতো আমার সহপাঠী উজ্জ্বল নক্ষত্রদের, আর আমি বা আমার মতো সাধারণ মানের যারা, বুঝতাম তীব্র এক বিষন্নতার ঢেউ আছড়ে পড়ছে বুকের গভীরে, যা আর কাউকে বুঝিয়ে বলার সাধ্য সেই বয়সে ছিল না। এই অপমান আরো ভালো করার অনুপ্রেরণা জোগানো তো দূরের কথা, দিন দিন আরো মাটির সাথে মিশিয়ে দিতো আমাদের।
আব্বু সরকারি চাকরি থেকে অবসর নেবার পর ঢাকায় এসে ভর্তি হলাম ভিকারুন নিসা নূন কলেজে। ইংরেজি কবিতা পড়াতেন কড়া মেকাপ করা এক ডাকসাইটে মহিলা। ক্লাসে কথা বলেছিলাম পাশে বসা বন্ধুর সাথে। বকাঝকা শুরু করলেন। ‘কোত্থেকে এসেছো? ওহহ ঢাকা না? ওহহ স্কুল ভিকারুননিসা নাহহ? অ্যা্হহহ…এইজন্যই তো এই অবস্থা!’ এই জাতীয় কিছু বাক্য আমার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে তিনি এমন ঘেন্নাভরা দৃষ্টিতে তীব্র ভর্ৎসনা শুরু করলেন যে আমার ক্লাসে বসে কথা বলার অপরাধ গৌণ হয়ে, ঢাকার বাইরে থেকে আসা এবং ভিকারুননিসা স্কুলের ছাত্রী না হবার ‘অপরাধ’ বিশাল আকারে ক্লাসরুম জুড়ে প্রকম্পিত হতে লাগলো।
তিনি আমার হাতের নখে নেইলপলিশের কিছু অংশ আবিস্কার করে বলতে লাগলেন, আমি ভিকারুননিসা কলেজে ভর্তি হলেও, স্কুল ভিকারুননিসা নয় বলেই আমার হাতে এমন আধাখেচরা নেইল পলিশ লেগে আছে।
পুরো সময়টা আমি চুপ করে তার বক্তব্য শুনলাম। তারপর ধীরে হেঁটে তার টেবিলের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, ম্যাম, কথা বলা এবং এই অপরিস্কার নখের জন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী। আমাকে ক্ষমা করে দিন।
ঝলমলে জর্জেট শাড়ি আর কটকটে মেকাপের ওই শিক্ষক সম্ভবত ছাত্রীর এতো বিনয় ও স্থিরতা আগে দেখেননি তার বিখ্যাত ভিকারুননিসা নূন স্কুলের শিক্ষকতা জীবনে। তিনি থতমত খেলেন। কিছুটা মিইয়েও আসলেন। আর আমি ফিরে আসলাম আমার ডেস্কে।
কিন্তু কলেজে প্রবেশের কয়েকদিন পরেই ঘটা এই ঘটনার পর বাদবাকি সময়টাতে আর কখনো আমি আমার কলেজ ক্যাম্পাসকে আপন করে দেখি নাই।
আমাদের দেশে স্কুল-কলেজের বাচ্চাদের সাথে এইসব অহরহ ঘটে। তাদেরকে মানসিক শারীরিকভাবে প্রতিনিয়ত অ্যাবিউজ করা হয়। তাদের অপমান করা হয়। শিশু-কিশোরদেরও যে আত্মসম্মানবোধ আছে, এইসব শিক্ষকদের তা মনে থাকে না। ক্রমাগত অপমান আর ভর্ৎসনা করে তারা শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাসের ভিতটাও নড়বড়ে করে দেন। তারাই শেখান শ্রেণীভেদ আর বৈষম্য।
হয়তো এমন অমানবিক পিশাচমনা শিক্ষকের তুলনায় মহৎ হৃদয়, ভালো, সংবেদনশীল শিক্ষকও আছেন। কিন্তু যে শিক্ষকরা শিশু মনে ক্রমাগত আঘাত দিয়ে দিয়ে শিক্ষকতার গায়ে কলংকের কালি ছিটান, তাদের সংখ্যাও একেবারে কম নয়।

কিন্তু সবচেয়ে দুঃখজনক হলো, এসব শিক্ষক চিহ্নিত হয় না, চিহ্নিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না, তারা বছরের পর বছর বহাল থাকেন শিক্ষকতা পদে এবং যুগ যুগ ধরে ছাত্রছাত্রীদের সাথে একের পর এক অন্যায্য অমানবিক ব্যবহার চালিয়ে যান।
উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের ছাত্রী রিশা বখাটের ছুরিতে মারাত্মক আহত হয়ে ছুটে এসেছিল স্কুল কম্পাউন্ডে, শিক্ষকদের কাছে আশ্রয়ের জন্য। পেয়েছে? না। মহান পেশার মহতী শিক্ষকরা তাকে বাঁচাতে এগিয়ে আসা তো দূরের কথা, স্কুলের গাড়িটাও দেয়নি তাকে হাসপাতালে পাঠানোর জন্য। সহপাঠিরা রিশার শরীরের ক্ষত কাপড়ে বেঁধে রিকশায় করে তাকে হাসপাতালে নিয়েছে। তো এই হলো রাজধানীর একটি বিখ্যাত স্কুলের বিখ্যাত মহতী শিক্ষকদের প্রকৃত রূপ।
এদের কাছে আমরা আমাদের সন্তানদের জন্য কী আশা করবো? মানসম্মত শিক্ষা? নিরাপত্তা? সুন্দর ভবিষ্যত? কোনটা?
valo likhechen. ei dhoroner ghotona onek hoy. kintu choto chele meyera kichu bolte pare na bidhay chapa thake.