বিত্তের অপচয়, নাকি রুচির দৈন্য!  

ফারহানা আনন্দময়ী: আশি’র দশকের প্রথমভাগ, নিতান্তই বালিকা বয়স আমার তখন। বিচিত্রায় একটা খবর পড়ে পুলকিত, আন্দোলিত এবং অভিভূত, ওই বয়সেই… হুমায়ূন ফরিদী আর মিনু নামের দু’জন নারী-পুরুষ বিয়ে-বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন বেলি ফুলের মালা বিনিময় করে। কল্পনাবিলাসী আমি তখন থেকেই কল্পনা করতে শুরু করেছি, বিয়ে যেদিন করবো ফুলের মালা দিয়েই করবো।

14159668_1253275638030391_228165620_nযেভাবে চেয়েছি, হয়নি। যদি কোর্টশিপ করতাম, নিশ্চয়ই এভাবেই করতাম। নিজের পছন্দ যখন পারিবারিক সম্মতি পেল, তখন পারিবারিক আয়োজনেই বিয়েটা হলো। সমাজে আর পঞ্চাশটা বিয়ের অনুষ্ঠান যেমন হয়, তেমন। জৌলুসে জমজমাট আয়োজন নয় মোটেই, তবে আনন্দ-আনন্দ, উৎসব-উৎসব। ছোটবেলা থেকেই দেখেশুনে বেড়ে উঠেছি, জন্মদিন-বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজনের নিমিত্তে অপচয় আমার মা-বাবা একেবারেই পছন্দ করতেন না। তাঁদের এই অপছন্দের বিষয়টা তাঁরা জীবনের চর্চাতেও ধরে রাখার চেষ্টা করেছিলেন।

এতো কিছুর ভূমিকা করতে হলো বিশেষ একটা বিষয়ে আলোকপাত করার জন্যে। আজকাল খুব কাছের আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠান ছাড়া বিয়ের দাওয়াতগুলো এড়িয়ে চলতে চেষ্টা করি। বেশিরভাগ বিয়ের দাওয়াতে গেলে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, বিশ্বাস করুন। এতো আয়োজন, এতো আলো, এতো অলংকার, এতো সাজগোজ… আমি হাঁপিয়ে উঠি। এতো ক্যামেরা, এতো লাইট, এতো প্রপ্‌স, বর-কনের অভিনয়, পার্শ্বচরিত্রদের মঞ্চে ওঠার প্রতিযোগিতা… বিয়ের উৎসব নয়, যেন সিনেমার স্যুটিং চলছে।

সব মেকি, আন্তরিকতার এতোটুকু ছোঁয়া কোথাও পাই না। নির্বাক দর্শক আমি, নিজের মনেই হাসি আর ভাবি অর্থবান হলেই তো আর রুচিবান হবে, এমন তো নয়। বিত্তের নির্লজ্জ প্রদর্শনে যে রুচিহীনতারও প্রকাশ পায় সেটা উপলব্ধি করার বোধটুকুও তাঁদের নেই।  

হিন্দী আর উর্দু টিভি সিরিয়াল দেখে নতুন নতুন নামের পর্ব আমদানী হয়েছে, অনুষ্ঠানের পর্বেরও তো শেষ নেই। পানচিনি বা এনগেইজমেন্ট থেকে শুরু। মাঝে মাঝে এমনও হয়েছে, এনগেইজমেন্টে গিয়ে আয়োজন দেখে ভ্রম হয়েছে বিয়ে বলে। ভেবেছি, দাওয়াত দিতেই হয়তো ভুল করেছে। এরপর একে একে সঙ্গীত, মেহেদী, হলুদ… এক গায়ে-হলুদেরই তিন সন্ধ্যার পর্ব। তারপর মূল অনুষ্ঠান, বিয়ে আর বৌভাত।

অনুষ্ঠান স্থলের আধা কিলোমিটার পথ আগে থেকে আলোকসজ্জা। পরবে পরবে খাওয়ার আয়োজন, বিদেশ থেকে শিল্পী ভাড়া করে এনে গানের আয়োজন। আর বর-কনের সাজসজ্জার কথা নাই বা বলি। এমনও নাকি হয় শুনেছি, শুধু মাথা থেকে পেট পর্যন্ত স্বর্ণ-হীরকের অলংকার নয়, কনের শাড়ি বা লেহেঙ্গাও নাকি স্বর্ণসুতোয় কাজ করা থাকে। বরের শেরওয়ানীতেও নাকি এমন হীরের বোতাম লাগানো থাকে।

ধারণা করুন তো, এমন একটা বিয়ের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে একটা পরিবারের কত টাকা ব্যয় হতে পারে? কমের পক্ষে পঁচিশ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা তো হবেই। এটাকে আপনি কী বলবেন? আনন্দ-উৎসব? অপচয়, নাকি বিত্তের নির্লজ্জ প্রদর্শন?

আর এযুগের নারীদেরও বলিহারি! বিয়ের দিনে পার্লারে সাজতে গিয়ে যে তাঁদের চেহারাই পালটে দিচ্ছে, এতোটুকু বিকার নেই তাতে! খুব সুশ্রী মুখ হয়তো নয়, শ্যামল বর্ণ, তাঁকে আটা-ময়দা গুলিয়ে-মাখিয়ে ফর্সা রূপবতী বানানোর চেষ্টা। সেই নারীরও আত্মবিশ্বাস এতো কম যে সে নিজেও মাথা উঁচু করে বলে না, আমার যা আছে তা আমার আছে, ক্ষণিকের জন্যে আমাকে মুখোশ পরিয়ো না।

কারণ, ওই মেয়েটাও সমাজকে চেনে, সমাজের কাছে সুন্দরের সংজ্ঞা কী, তা জেনে গেছে। আবার উল্টোটাও দেখেছি। কী মিষ্টি মুখশ্রীর এক মেয়েকে বিয়ের মঞ্চে চেনাই যায় না, সাজের আধিক্যে প্লাস্টিকের মূর্তির মতন দেখায়। কে জানে, আজকাল কি কেউ আর চন্দন দিয়ে কপালে আঁকে? এসব বিষয়ে যাদের ধারণা আছে, আমি জিজ্ঞেস করে জেনেছি, নামকরা কোনো পার্লারে নাকি কনে সাজাতে লাখখানেক টাকা খরচ হয়। ইশ্‌, কী অপব্যয়!

আমার বিশ্বাস করতে খুব ইচ্ছে করে, এই প্রজন্মের মেয়েরা বিয়ে-বাহুল্যের এই ধারাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে পরিবারকে বলবে, “আমি চাই না এমনতরো বিয়ের আয়োজন। আমার মেধা আমার অলংকার, আমার যোগ্যতা আমার আভরণ… আমি চাই না স্বর্ণ-হীরকের অলংকার, আমি চাই না সোনায়-বোনা শাড়ির আভরণ।

আমার সবচেয়ে যে প্রিয় বন্ধুটি, মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে উঠেছে, ও তো তোমাদের প্রদর্শিত বিত্তের প্রাচীর পেরিয়ে আমার কাছে পৌঁছুতে পারছে না, আমার আনন্দে শামিল হতে পারছে না। আনন্দের ফুল ফোটাতে ওকেও আমার পাশে চাই, আসতে দাও।”

আমি চাই, আগামী প্রজন্মের রুচি তৈরি হোক। বর-কনেই তাঁদের নিজ নিজ পরিবারকে শেখাক, আনন্দ ভাগাভাগি করে নেয়া আর উৎসব আয়োজনের নামে বিত্ত-প্রদর্শনের মধ্যে বিস্তর ফারাক।

Show off এ কেবল রুচির দৈন্যই প্রকাশিত হয়। সত্তর-আশির দশকে ফরিদী-মিনু যতটা আধুনিক মননে  ভাবতে পেরেছে, একুশ শতকের ডিজিটাল যুগের প্রজন্ম তাঁদের থেকে এগিয়ে গিয়ে ভাববে সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? অপরপক্ষে, দরিদ্র রাষ্ট্রেরও উচিৎ নাগরিকের এমন ব্যয় (অপব্যয়) এর ওপর মূল্য সংযোজন কর ধার্য করা।

শেয়ার করুন:

লেখাটা বেশিরভাগ-ই ভালো লেগেছে, শুধু একটা যায়গায় একেবারেই লাগেনি। শ্যামলা বর্ণ মানে বিশ্রী আর ফর্সা মানে রূপবতী, এইরকম বিকৃত মানসিকতার প্রতিবাদ না করে বরং সেটাকে মেনে নিয়ে আত্ববিশ্বাসী হতে বললেন লেখক।