রাহিমা আক্তার: সম্প্রতি এক হাতি নিয়ে সারাদেশে মিডিয়ার মাতামাতিতে ভাবছিলাম যে দেশে শত হাতির আবাসস্থল ধ্বংস করার জন্য কথা বলার লোকের অভাব, সে দেশে একটি হাতির মৃত্যু নিয়ে এত মাতামাতি কতোটা শোভনীয়?
অন্তত এটুকু বুঝেছি আমাদের প্রতিবেশী দেশের হাতিটির সৌভাগ্য অনেক বেশী, কারণ নিজেদের সুন্দরবন ধ্বংস করে রামপাল কয়লা প্রকল্প নিয়েও গত দুই সপ্তাহে এতোটা হইচই হয়নি, যতোটা এই হাতিটি নিয়ে হলো। আমরা একটা সংরক্ষিত বন ধ্বংস করে দেওয়ার মতোন প্রকল্প বাস্তবায়নে চলছি কিন্তু সেখানে দেশব্যাপি কোন বড় ধরনের প্রতিবাদ নেই, অথচ একটা হাতির মৃত্যু নিয়ে আমাদের মায়া-কান্না দেখে আমার বড় বেশী অদ্ভুত লাগে।
না ভাববেন না যে ঐ হাতির মৃত্যুতে আমি খুব খুশি, আমি ভাবছি যে দেশে একসাথে চারজন শ্রমিক মারা গেলে পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় বড় করে একটা খবরের জায়গা হয় না সেই দেশের বেশিরভাগ পত্রিকার প্রথম পাতায় এই হাতির মৃত্যু নিয়ে টানা সপ্তাহ জুড়ে খবর আর শোরগোল চোখে লাগে বৈকি! নিজের কাছেই নিজের ভাবনায় এ নিয়ে লজ্জা পাচ্ছিলাম।
অন্যদিকে দেখলাম স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে এক বৃদ্ধের শরীরে পচন ধরেছে চিকিৎসার অভাবে, কেউ নেই পাশে দাঁড়াবার। আহা কী পশুপ্রেম আমাদের, অথচ পাশের মানুষটির জন্য এতটুকু মায়াদয়া আর প্রেম ভালবাসা নেই – কতোটাই দানবীয় মানবিকবোধ আমাদের!
আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ রক্ষায় কাজ করার জন্য বিভিন্ন বৈশ্বিক ফোরামে কথা বলেন, আর আশ্চর্য হলেও সত্য যে তার হাত ধরেই আবার এই দেশে রামপাল কয়লা প্রকল্পের চুক্তি সাক্ষরিত হয়, যা কিনা আমাদের পরিবেশের সবচেয়ে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এই আমরাই কিনা হাতে আর কাপড়ে সেচে জলের ভেতরের তেল পরিষ্কার করি জলজ প্রাণী বিপন্ন হওয়ার আশংকায় আবার এই আমরাই শত বছরের পুরনো জাহাজ ভাঙ্গার কাজ নেই আমাদের সমুদ্র বন্দরের ভাল মন্দের বাছ-বিচার না করেই! কী অদ্ভুত পরস্পর বিরোধী আচরণ আমাদের মাঝে !
একইভাবে নিজের জানা কেউ অন্যায় করলে সেটা সহজেই স্বীকার করতেও আমাদের বাঁধে। কেন আমরা আমাদের ছাত্র সংগঠন কোনও অন্যায় করলে সেটা মেনে নিতে পারি না? কেন নির্দ্বিধায় বলতে পারি না যে হ্যাঁ, অন্যায়কারীর শাস্তি হবেই তা সে যে দলেরই সদস্য হোক না কেন? কেন এখনও একজনের করা অন্যায় আমরা গোষ্ঠীগতভাবে নিজের করে নিয়ে তা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো করেই লুকাতে চেষ্টা করি আর নীরবে আরও শত অন্যায়ের প্রশ্রয় দেই? কেন এই আমি অফিসে সারাদিন শিশু অধিকার নিয়ে গলা ফাটাই, আর রাতে এসে নিজের ঘরে কাজ করা ছোট শিশুটিকে দুবেলা খেতে দেই না? কিংবা পাম্প করে পায়ুপথে গ্যাস ঢুকিয়ে আমার গ্যারেজের কর্মজীবী শিশুটিকেই মেরে ফেলি? কেন আমি আমার সংস্কৃতি তুলে ধরা নিয়ে সারাদিন উন্নয়নের কর্মশালায় দিন পার করি, আর নিজে কেবল কেনার সময় ঐ ভারতীয় পাখি থ্রি পিসের ওপরই নির্ভরশীল হই?
কিংবা আমি সারাদিন লালন, পল্লীগীতি আর জীবনমুখী গান গেয়ে মানুষের কথা বলতে চাই, আর যখন নিজের ঘরেই নিজের স্বামীর হাতে ঘরের গৃহকর্মীর মৃত্যু হয়, তখন তার বিচার আমি টাকার বিনিময়ে কিনে নেই?
ভেবে দেখলাম আমাদের বসবাস আর বেড়ে উঠা আজন্ম এক বৈপরীত্যের মাঝে। কেন এই বৈপরীত্য? এই একই ব্যক্তি আমি কেন দ্বৈতের টানাপোড়নে বড় হই? কেন আমার মাঝেই এক ভাল আর মন্দ মানুষের পরস্পর সহঅবস্থান? সমস্যার মূল কোথায়? আসলে সমস্যার মূল আর এই সহঅবস্থান হলো আইনের সঠিক বাস্তবায়নের অভাব।
এবার উদাহরণে আসি রামপাল কয়লা প্রকল্পের পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষায়। আজ যদি পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষার ফলটা (ইআইএ) সঠিকভাবে করা হতো আর তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা হতো কোন রকম পরিমার্জন ছাড়াই, তাহলে হয়তো এই চুক্তি স্বাক্ষরিতই হতো না। গোড়ায় যদি গলদ রেখে দেয়া হয়, তাহলে সেটা সংশোধনের আর কোন উপায় থাকে না।
তেমনি এখন যদি আফসানা হত্যার সঠিক বিচার না হয় তাহলে এরকম অনেক আফসানাকেই হত্যা ধর্ষণের শিকার হলে তার বিচার হবে না তা নিশ্চিত। আর এ সুযোগে ধর্ষণকারী সোনার ছেলেরা আরও আশ্রয় প্রশ্রয়ে বেড়ে উঠবে সেটাই স্বাভাবিক। যেমনি হয়েছে তনু, ত্বকী, সাগর-রুনিদের ক্ষেত্রে।
যে সরকার আদর্শ রাজনীতির কথা বলে, তার মন্ত্রীরাই শিক্ষকের অপমান করে আবার তার ছাত্র সংগঠন ধর্ষণ চাঁদাবাজিতে মেতে উঠে। তাই প্রাথমিক বা এসসসিতে এ প্লাস এর ছড়াছড়িতে আমার মাঝে উচ্ছ্বাস আসে না, কারণ এই ভাল ফলাফল নৈতিক কোনো পরিবর্তনে সহায়ক হচ্ছে না, বরং একই সাথে ভাল ফলাফল আর খারাপ চরিত্রের গুণাবলির সংমিশ্রণ ঘটাচ্ছে। আগে মেধাকে যাচাই-বাছাই করা হতো ভাল ফলাফল, ভালো গুণাবলি দিয়ে, কিন্তু এখন তা যাচাই হয় নাম্বার দিয়ে। নাম্বার কখনও আপনার ভেতরকে পরিবর্তন করতে পারে না। বরং ওটা আমাদের মাঝে আরও বেশী বৈপরীত্যের জন্ম দেয়।
আসলে এক কথা বলতে গিয়ে নানান কথা চলে আসছে, বলতে চাইছিলাম যে আমাদের এবং আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে স্ববিরোধী আচরণের বিকাশ রোধে সঠিক আইনের বাস্তবায়নের কোন বিকল্প নেই। দ্বৈত সত্ত্বার টানাপোড়েনে বেড়ে উঠা প্রজন্ম কোনভাবেই জাতিকে সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারবে না যা আমাদের ভবিষ্যতের জন্য এক অশনি সংকেত।
ভুর্যবুর্গ, জার্মানি থেকে।