একজন ড. ইউনূস ও ১৬ কোটি বাঙালী

বিথী হক: কয়দিন আগে ভয়াবহ বন্যার সময় আমাদের দেশের একমাত্র নোবেল বিজয়ী ব্যক্তি ড: মুহাম্মদ ইউনূস অলিম্পিকে দৌড়াতে গেলেন। পাবলিক তো মহা ক্ষ্যাপা! এই বন্যার সময় বন্যার্ত মানুষগুলোকে এভাবে ছেড়ে কেউ বুঝি দৌড়াতে যায়!

বিষয়টা এমন, বন্যার সময় বন্যাকবলিত মানুষ সব ড: ইউনূসের মাথার উপর আশ্রয় নিয়েছিল। ঊনি মাথা ঝাড়া দিয়ে দৌড়ানোর সময় সবাই তার মাথা থেকে পানিতে পড়ে ডুবে মরেছে। সুতরাং এমতাবস্থায় দেশের মানুষগুলোকে এমন দূরাবস্থার মধ্যে ফেলে অলিম্পিকের মত বিলাসবহুল গেমসের অনুষ্ঠানে যাওয়া মহাপাপ। এর বাইরে আমি আর কোনো লজিক পাইনি, যেখানে ড: ইউনূসের অলিম্পিকে যাওয়ার সাথে বন্যার কোন সম্পর্ক থাকতে পারে।

Yunus and Rioপরের ঘটনা আরো ভয়াবহ। অলিম্পিকে যাওয়াটা কোনরকম সহ্য করা যেতে পারে, কিন্তু হিলারি ক্লিনটনকে নির্বাচনের জন্য ২০ কোটি টাকা দান করা কী চাট্টিখানি কথা নাকি! দেশের মানুষ ঠিক করে খেতে পায় না, আর নোবেল পেয়ে ব্যাটা ইউনুস যায় ক্লিনটনকে টাকা দিতে! ক্লিনটন কী এতোই গরীব যে তাকে নির্বাচনের জন্য টাকা না দিলে সে নির্বাচন করতে পারবে না? নাকি তাকে টাকা দেওয়ার মানুষের অভাব পড়েছে?

গরীব দেশের টাকা বাইরে এমনি এমনি দান-খয়রাত করলে দেশের অবস্থা না জানি কী হয় এই চিন্তা করে ফেসবুকের জ্ঞানী-গুণী মিলে ড: ইউনূসের মুখে জুতা মেরে, নিজের মুখ খারাপ করে বেতাল হয়ে গেলেন। তাদের কারো একবারের জন্যও মনে হয়নি কাউকে ঘাঁটানোর আগে নিজের দিকেও একবার তাকানো উচিত।

আপনার যদি পিজা হাটে গিয়ে পাঁচ হাজার টাকার পিজা খাবার সামর্থ্য থাকে এবং আপনি বন্যার্ত মানুষদের সে টাকা দিয়ে সাহায্য না করে পিজা খাওয়াকেই বেশি প্রাধান্য দেন এবং মনে করেন গণতন্ত্র বলে আপনার টাকা দিয়ে যা খুশি করার অধিকার আপনি রাখেন, তাহলে সে সূত্র সবার উপরই খাটবে। ড. ইউনূস শুধুমাত্র ইউনূস বলে দেশের সব দায়-দায়িত্ব তারই নিতে হবে এমন তো কথা নেই। আপনার পাঁচ হাজার টাকার সামর্থ্য যা, ড. ইউনূসের পাঁচ কোটিও তা। শুধু শুধু মানুষকে টেনে তার জনপ্রিয়তাকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।

তবে হ্যাঁ, আমার বন্ধু নাদিয়া ইসলামের মতো মানুষজনকে আমার কিছু বলার নেই, তারা যদি ড. ইউনূসের সমালোচনা করেন তো তার যুক্তি আছে। তিনি ওয়েস্টিনে বসে একবেলায় ১০ হাজার টাকা বিল যেমন দেন, তেমনি থানচির দুর্ভিক্ষের সময় তাদের জন্য ১০/১৫ হাজার টাকা ডোনেশনও দেন। তারা অন্যের সমালোচনা করবার আগে নিজের দিকটা ঠিক রাখেন। কিন্তু আপনি আগ বাড়িয়ে কাউকে কিছু বলার সময় নিজের দিকটাই সবার আগে ভাবতে হবে।

আপনি মানেন আর না মানেন, ড. ইউনূসকে গালি দেন বা না দেন, আপনার মানতেই হবে ক্রিকেটের পর ড. ইউনূসই একমাত্র টপিক যার জন্য পৃথিবী আমাদের দেশ চেনে, আপনাকে আমাকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ দিয়ে চেনে। আপনি তাঁর পরিচয়ে নিজেকে পরিচিত করেন আর না করেন, আপনার দেশ চেনার আগে তামাম দুনিয়া ড. ইউনূসকে চেনে। স্বভাবতই সাধারণ মানুষ যত সহজে সবকিছু করতে পারেন, ড. ইউনূস বা সাকিব আল হাসান বা মুসা ইব্রাহীমদের মতো মানুষরা তত সহজে সবকিছু করতে পারেন না। তারা কোন দেশে যান, কার সাথে কথা বলেন, কোন হোটেলে ঘুমান, তার প্রত্যেকটা খবর সবাই জানতে পারেন।

সে সুবাদে সবাই জেনেছেন ড. ইউনূস নির্বাচনের জন্য ক্লিনটন ফান্ডে ২০ কোটি টাকা ডোনেশন দিয়েছেন। এতোক্ষণ যা বলেছি তা শুধুমাত্র যুক্তিখণ্ডন বৈ অন্য কিছু নয়। আসুন জানি ড: ইউনূসের হিলারি ক্লিনটনকে টাকা দিয়ে পাপ কামানোর দরকারটা কী ছিল! আপনারা জানেন কিনা জানিনা হিলারির সাথে ড. ইউনূসের ৩০ বছরের বন্ধুত্ব। হিলারি যখন আরাকানসাসের ফার্স্ট লেডি ছিলেন, তখন একবার তাঁকে ইনভাইট করে নিয়ে যান মাইক্রো ক্রেডিট দিয়ে সেখানকার গরীব মানুষদের সাহায্য করা সম্ভব কিনা তা যাচাই করার উদ্দেশ্যে। বলা বাহুল্য হিলারি একজন সমাজকর্মী। হিলারি ফাউন্ডেশনে দেশি-বিদেশী বহু ডোনার রয়েছেন, ড: ইউনূসও তাদেরই একজন। হিলারিও বিভিন্নভাবে বিভিন্ন সময়ে ড: ইউনূসকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন তাদের এই দীর্ঘ সময়ের বন্ধুত্বে।

ড. ইউনূস একবার রাজনৈতিক হুমকি হয়ে বাংলাদেশ সরকারের চোখে পড়লেন। ঠিক করা হলো তক্ষুনি তাঁকে তার পদ থেকে নামিয়ে দেয়া হবে। ধারণা করা হয়, হিলারির নাক গলানোর কারণেই সিনেট কমিটির ফরেন রিলেশনস থেকে জন কেরি ড. ইউনূসকে স্বপদে বহাল রাখার জন্য তাদের মাথা ঘামানোর বিষয়টা উল্লেখ করে চিঠি পাঠান। উল্লেখ্য ড. ইউনূস কিন্তু এখনো ড. ইউনূসই আছেন।

Bithi Haque
বিথী হক

এবারে আসা যাক, সময়ের বিষয়ে। কেন এখনই এই টাকাটা দেয়ার ছিল? এমন অসময়ে! হিলারির চেয়ে এই টাকা এখন বন্যার্তদেরই বেশি দরকার ছিল! হ্যাঁ ছিল হয়তো। কিন্তু এই টাকার খবর সম্প্রতি উইকিলিকস ফাঁস করেছে বলেই আপনি আমি এখন জানতে পেরেছি। উইকিলিকস আগে প্রকাশ করলে আমরাও আগেই জানতে পারতাম।

আরেকটা বিষয়, আপনারা জানেন কিনা জানি না ড. ইউনূসের বাংলাদেশী গ্রামীণ ব্যাংকের মতো আমেরিকায় “গ্রামীণ আমেরিকা” নামেও একটা ফাউন্ডেশন আছে। আসলে এই টাকা এখনকার দেয়া টাকা নয়, বা আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংক কিংবা ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত ফান্ড থেকেও দেয়া নয়। এই টাকা সম্ভবত এ বছরের প্রথম দিকে গ্রামীণ আমেরিকা ফাউন্ডেশন থেকে হিলারি ফান্ডে ডোনেট করা।

দু:খজনক যে এতোকিছুর পরেও বাঙালীরা কোনো না কোনোভাবে ড. ইউনূসকে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নামিয়ে এনে হেনস্থা করবে। আমাদের জন্য যে মানুষটা গর্ব, দেশের জন্য যে মানুষটা সম্মান বয়ে নিয়ে আসে, তার প্রাপ্য সম্মানটুকু তিনি না দেশ থেকে পাচ্ছেন, না দেশের মানুষ থেকে। এ দেশ আসলে এমন মানুষদের জন্য নয়, এমন মানুষ তাই এ দেশে জন্মানোও উচিত নয়।

এমন হোপলেস জাতি, হোপলেস কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে দিন আনে- দিন খায় স্ট্যাটাসে কোনমতে বেঁচে থাকতে থাকতে বার্ধক্যে পা দিতে পারলেই হয়। এ দেশের মানুষ না জানে সম্মান নিতে, না জানে দিতে। তাদের কাছে সাকিব আল হাসান, মাশরাফি, নাসির, ড. ইউনুস, তসলিমা নাসরিন কাউকেই গালি দেয়াটা লজ্জার বা কঠিন কিছু নয়।

দু:খের বিষয়, রক্ত আর জাতীয়তা এই দুটো জিনিস কেউ চাইলেও পরিবর্তন করতে পারে না। জাতীয়তার তবু পরিবর্তন ঘটে কাগজে-কলমে, কিন্তু শেকড় থেকে নয়।  ড. ইউনূসও তাই ষোল কোটি বাংলাদেশীর মধ্যে একজন বাংলাদেশী, যেমন আপনি এবং আমিও!

রেফারেন্স:

https://www.theguardian.com/…/clinton-foundation-bill-hilla…

http://washingtonmonthly.com/…/how-the-ap-spun-the-story-a…/

https://en.wikipedia.org/wiki/Grameen_America

 

শেয়ার করুন: